চীনের হাতে ২৫ বছরে কেমন আছে হংকং

চীনকে হস্তান্তরের ২৫ বছরের বার্ষিকীতে ওড়ানো হয় হংকং ও চীনের পতাকা
ছবি: রয়টার্স

১৯৯৭ সালে চীনের কাছে হস্তান্তর করা হয় হংকং। এতে বড় ধরনের রাজনৈতিক পরীক্ষার মুখে পড়ে হংকং। অনেকেই উদ্বিগ্ন ছিল কমিউনিস্ট চীনা শাসনের অধীনে  পুঁজিবাদী, ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে আলাদা হওয়া হংকং কেমন থাকবে।

সেই উদ্বেগ কিছুটা প্রশমিত হয়েছিল বেইজিং এর  প্রতিশ্রুতিতে।  যুক্তরাজ্যের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী হংকংয়ে ‘এক দেশ, দুই ব্যবস্থা নীতি’ বাস্তবায়ন করা হয়েছিল। এর আওতায় হস্তান্তরের ৫০ বছর পর্যন্ত অর্থাৎ ২০৪৭ সাল পর্যন্ত অঞ্চলটিতে ব্যাপক স্বায়ত্তশাসন, অবাধ ব্যক্তি অধিকার ও বিচারিক স্বাধীনতা বজায় রাখার অঙ্গীকার করেছিল চীন।

তবে ২৫ বছর পর বেইজিং সেই  প্রতিশ্রুতি কতটা রক্ষা করতে পেরেছে তা নিয়ে বিবিসি এক বিশ্লেষণ তুলে ধরেছে।

২৫ বছর পর কোথায় হংকং

বড় প্রশ্ন হলো বেইজিংয়ের দেওয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী হংকং কতটা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করতে পেরেছে। হস্তান্তরের আগে অনেকেই আশা করেছিল চীন হংকংয়ের গণতন্ত্র রক্ষায় অনেক বেশি উদার থাকবে।

তবে কয়েকজন সমালোচক মনে করেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বেইজিং প্রতিশ্রুতি থেকে অনেকটাই সরে এসেছে। বেইজিং হংকংয়ে নিরাপত্তা আইন চালু করেছে। সেই সঙ্গে নির্বাচনী সংস্কার করেছে।

২০১৯ সালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যাপক বিক্ষোভের পরে ২০২০ সালে নিরাপত্তা আইন প্রতিষ্ঠিত হয়। হংকং থেকে পালিয়ে যাওয়া সাবেক গণতন্ত্রপন্থী আইনপ্রণেতা টেড হুই বলেন, ‘হংকংয়ের বেশির ভাগ মানুষের ধারণা এক দেশ দুই নীতি অদৃশ্য হয়ে গেছে। কর্তৃপক্ষ বলছে নিরাপত্তা আইন সংখ্যালঘুদের স্বার্থরক্ষায় প্রভাব ফেলবে। তবে হুই বলছেন, এটি হংকংয়ের একসময়ের গতিশীল সমাজকে দমিয়ে দিয়েছে।’

টেড হুইয়ের এই বক্তব্যকে সমর্থন করে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরেছে বিবিসি। নিরাপত্তা আইনের প্রভাবে হংকংয়ের অনেক রাজনৈতিক দল ও সংগঠন ভেঙে গেছে। ১৯৮৯ সালে তিয়ানেনমেন স্কয়ারে গণহত্যার স্মরণে মোমবাতি প্রজ্বালন ও ১ জুলাই হংকং হস্তান্তরের বার্ষিকীতে মিছিলের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে।
এ ছাড়া গত কয়েক বছরে গণতন্ত্রপন্থী বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম যেমন অ্যাপল ডেইলি ও স্ট্যান্ড নিউজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।

এশিয়ায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতায় একসময়ের আলোকবর্তিকা ছিল হংকং। এ বছর গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সূচকে হংকংয়ের অবস্থান দাঁড়িয়েছে ১৪৮ তম। আগের বছরের তুলনায় হংকংয়ের অবস্থান ৭০ ধাপ পিছিয়েছে।

জাতীয় নিরাপত্তা আইন কার্যকর হওয়ার পর থেকে বিক্ষোভের শহর নামে পরিচিত হংকং অনেকটা থমকে গেছে। যদিও হংকংয়ে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হংকং ডেমোক্রেসি কাউন্সিলের নীতি ও গবেষণা বিষয়ক ফেলো জেফরি এনগো বলেন, ‘এটা বলা যায় যে অদূর ভবিষ্যতে হংকংয়ে মাঠে ময়দানে বড় ধরনের কোনো বিক্ষোভ হবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘২০২০ সালের শুরু থেকে হংকংবাসীর একাংশ কারাগারে থাকে বলে কিছু করতে পারছে না অথবা কেউ কারাগার থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে আবার কেউ ভালো থাকার জন্য স্বআরোপিত নিষেধাজ্ঞার মধ্যে রয়েছে।’

চীনের কর্মকর্তাদের দাবি ‘এক দেশ দুই নীতি বলবৎ’ রাখতে এ ধরনের পরিবর্তনগুলো প্রয়োজন ছিল। আর এই ধারাবাহিকতা ২০৪৭ সাল পর্যন্ত চলবে বলে দাবি তাঁদের।
বেইজিং সমর্থিত আইনপ্রণেতা ডমিনিক লি দাবি করছেন হংকংবাসী এখনো নাগরিক স্বাধীনতা ভোগ করছে। তিনি বলেন, ‘মানুষ বিভিন্ন ইস্যুতে নিজের মতামত দিতে পারছে।

জাতীয় নিরাপত্তা আইন এ বিষয়ে কোনো বাধা দিচ্ছে না। জাতীয় নিরাপত্তা আইন নিয়ে আদালতে আরও শুনানি হবে। আদালতই এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বেইজিং জাতীয় নিরাপত্তা আইন পাস করেছে। হংকংয়ের নির্বাচন পদ্ধতিতে বদল এনেছে। কারণ হংকংয়ে রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠেছিল। গণতন্ত্রপন্থীদের কারণে হংকংয়ের আইনসভায় অচলাবস্থা তৈরি হয়েছিল।’

আইনপ্রণেতা ডমিনিক লি আরও বলেন, ‘আমি কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে বলতে পারি না। তবে আমি মনে করি এসব কাজের মূল উদ্দেশ্য হলো হংকংয়ের উন্নতি বজায় রাখা।’

আন্তর্জাতিক না চীনা বাণিজ্যমুখী

আরেকটি প্রশ্ন হলো হংকং কি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে তাদের অবস্থান ধরে রাখতে পারবে? ১৯৯৭ সালে ‘প্রাচ্যের মুক্তা’ ছিল হংকং। হংকংয়ের জিডিপি চীনের প্রায় এক পঞ্চমাংশের সমান ছিল। আর এখন হংকংয়ের জিডিপি মাত্র ২ শতাংশ। হংকং চীনের অনেক শহর বিশেষ করে সাংহাইয়ের সঙ্গে তীব্র প্রতিযোগিতার মুখে পড়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্রেডিট রেটিং এজেন্সি এস অ্যান্ড পি গ্লোবাল রেটিংসের এশিয়া প্রশান্ত মহানগারের প্রধান অর্থনীতিবিদ লুইস কুজিস বলেন, ‘২৫ বছর আগে চীন এখনকার চেয়ে কম উন্নত ছিল। সে সময় হংকং খুবই উন্নত ও আন্তর্জাতিকভাবে সমন্বিত একটি শহর ছিল। অনেক শহর অর্থনৈতিকভাবে হংকংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘হংকং এখনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্রের অবস্থান ধরে রেখেছে। হংকং এখনো চীনের প্রবেশদ্বার। কারণ হংকংয়ে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইনি ব্যবস্থা রয়েছে। হংকংয়ের আর্থিক বাজার বাকি বিশ্বের জন্য একেবারেই উন্মুক্ত।’

তবে বেইজিংয়ের সঙ্গে সাম্প্রতিক উত্তেজনা ও শূন্য করোনা নীতির কারণে অনেকের আশঙ্কা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের কাছে হংকং আবেদন হারাতে পারে। হংকংয়ে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর আঞ্চলিক সদর দপ্তর ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২১ সালে প্রায় ১০ শতাংশ কমেছে। তবে চীনের মূল প্রতিষ্ঠানগুলো ২৮ শতাংশ বেড়েছে। কুজিস আরও বলেন, ‘হংকংয়ের বাণিজ্য আন্তর্জাতিক কম হয়ে উঠছে এবং চীনকেন্দ্রিক বেশি হয়ে উঠছে।’

হংকংবাসীর পরিচয় কী

হংকংবাসীদের পরিচয় নিয়েও সংকট রয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হংকংয়ের স্থানীয়দের বিদেশে পাড়ি জমানোর হার বাড়ছে। যেসব স্থানীয় হংকং ছেড়েছেন তাদের অনেকেই যুক্তরাজ্যে যেতে চান। বিবিসি বলছে, ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের মার্চ মাস পর্যন্ত ব্রিটিশ নাগরিকত্বের জন্য এক লাখ ২৩ হাজারের বেশি আবেদন জমা পড়েছে।

১৯৮৪ সালে চীন-ব্রিটিশ যৌথ ঘোষণা সই ও ১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ে তিয়ানেনমেন স্কয়ারে গণহত্যার পরে অভিবাসন বেড়ে গিয়েছিল। তবে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হংকং ডেমোক্রেসি কাউন্সিলের নীতি ও গবেষণা বিষয়ক ফেলো জেফরি এনগো মনে করেন, ‘এবারের কারণটা আলাদা। সে সময় যারা হংকং থেকে অভিবাসী হতে চেয়েছে তাদের মধ্যে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে শঙ্কা ছিল। তবে তারপরও পরিস্থিতি অত খারাপের দিকে নাও যেতে পারে এমন প্রত্যাশা ছিল। আর এখন পরিস্থিতি ভালো হওয়ার প্রত্যাশা কম। এখন মানুষ আর ফিরবে না বলেই হংকং ছাড়তে চাইছে।’ তাতে অবশ্য হতাশ নন এনগো। তিনি মনে করেন অভিবাসীরা বাইরে থেকেই হংকংয়ের গণতন্ত্রের জন্য লড়াই চালিয়ে যাবে।

তবে বেইজিং সমর্থিত আইনপ্রণেতা ডমিনিক লির ভাবনা ভিন্ন। তিনি মনে করেন হংকংয়ের নতুন প্রজন্ম অনেক বেশি দেশপ্রেমিক হবে। তিনি বলেন, তার সন্তান তাকে চীনের পতাকা উত্তোলন সম্পর্কে জানাতো। তিনি মনে করেন, এই প্রজন্মের হংকংবাসীদের ২০১৯ সালে রাস্তায় নেমে বিক্ষোভকারীদের মতো অনুভূতি নাও থাকতে পারে।

লির এই ভাবনার আশঙ্কা থেকে এনগোর মতো অনেকের আশঙ্কা , ২০৪৭ সালের মধ্যে হংকং ও চীনবাসীকে একে অন্যের থেকে আলাদা করাটা কঠিন হয়ে পড়তে পারে।