জান্তা সরকারকে ‘ভয়ানক পরিণতির’ হুঁশিয়ারি জাতিসংঘের

ইয়াঙ্গুনে সেনা অভ্যুত্থানের প্রতিবাদে বিভিন্ন রাস্তায় বিক্ষোভ হয়।ছবি: এএফপি

বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিলে মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে ‘ভয়ানক পরিণতি’ ভোগ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছে জাতিসংঘ। মিয়ানমারে জাতিসংঘের বিশেষ দূত ক্রিস্টিন শ্রেনার বার্গেনার এ হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের মুখপাত্র ফারহান হক।

জাতিসংঘের বিশেষ দূত ক্রিস্টিন শ্রেনার বার্গেনার মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রতি হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
ছবি: এএফপি

মিয়ানমারে চলতি মাসের প্রথম দিনে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে হটিয়ে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনাবাহিনী। কিন্তু জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ বাড়ছে দিনে দিনে। বিক্ষোভ রুখতে সরকারও একটু একটু করে চড়াও হচ্ছে। গতকাল সোমবার মানদালা শহরে বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভকারীদের ছাত্রভঙ্গ করতে সেখানে গুলি চালায় নিরাপত্তা বাহিনী। এমন অবস্থায় সেনা সরকারকে ওই হুঁশিয়ারি দিল জাতিসংঘ।

এদিকে স্থানীয় সময় আজ মঙ্গলবার মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি ও প্রেসিডেন্ট উইন মিন্টের বিরুদ্ধে বিচার শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। গতকাল সোমবার তাঁদের আইনজীবী খিন মাউং জ এই তথ্য জানিয়েছেন।

ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বিচারে শুনানিতে অংশ নেবেন সু চি। প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট ও সু চি—দুজনকেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে আজ মঙ্গলবার ও কাল বুধবার।

ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় সেনাবাহিনীর গাড়ির টহল।
ছবি: এএফপি


মিয়ানমারে স্থানীয় সময় গতকাল সোমবার রাতেও ইন্টারনেট সেবা বন্ধ রাখা হয়। যুক্তরাজ্য-ভিত্তিক পর্যবেক্ষক নেটব্লকস বলছে, রাত একটা থেকে ইন্টারনেটের সব ধরনের সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়। স্থানীয় সময় আজ মঙ্গলবার সকাল ৯টার দিকে ইন্টারনেট সচল করা হয়েছে বলে জানায় রয়টার্স।

এর আগে সোমবার ফোনে জান্তা সরকারের উপপ্রধান সোয়ে উইনের সঙ্গে কথা বলেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত ক্রিস্টিন শ্রেনার বার্গেনার। জান্তা সরকারের সঙ্গে বহির্বিশ্বের কারও এই আলাপ ছিল বেশ ব্যতিক্রমী ঘটনা।

জাতিসংঘের মুখপাত্র ফারহান হক জানান, শ্রেনার বার্গনার বলেছেন, ‘শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকতে হবে। বিক্ষোভকারীরা যেন কোনো প্রতিশোধমূলক আচরণের শিকার না হন। তিনি মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর উদ্দেশে বলেছেন, পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে বিশ্ব সম্প্রদায়। বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিলে মিয়ানমারের সরকারকে ভয়ানক পরিণতি ভোগ করতে হবে।’

মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বলেছে, জান্তা সরকারের উপপ্রধান সোয়ে উইন তাঁদের পরিকল্পনার কথা জাতিসংঘের বিশেষ দূতকে জানিয়েছেন। মিয়ানমারের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে তথ্য দেওয়া হয়েছে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বলেছে, বিক্ষোভের কারণে দেশটির স্থিতিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। মানুষ আতঙ্কে রয়েছে।

ইয়াঙ্গুনের রাস্তায় সেনাবাহিনীর গাড়ির টহল।
ছবি: এএফপি

এদিকে বিবিসির খবরে জানা যায়, মিয়ানমারে গতকাল রাতে আবার ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। ১ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে এ নিয়ে চতুর্থবারের মতো ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দেওয়া হলো দেশটিতে। দেশটিতে প্রধান টেলিকম সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান টেলিনর বলছে, ইন্টারনেট সেবা বিঘ্নিত হওয়ার তালিকা তারা আর হালনাগাদ করবে না। টেলিনর এএফপিকে বলেছে, পরিস্থিতি ‘সন্দেহজনক ও অস্পষ্ট’। কর্মীদের নিরাপত্তাকেই সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়ার কথা জানিয়েছে টেলিনর।

রয়টার্সের খবরে জানা যায়, অ্যাসিস্ট্যান্স অ্যাসোসিয়েশন ফর পলিটিক্যাল প্রিজনার্স গ্রুপ বলছে, সেনাবাহিনীর অন্যায় কর্মকাণ্ড ও স্বেচ্ছাচারী গ্রেপ্তারের ঘটনা লুকাতেই এ ধরনের ব্লাকআউট করা হয়েছে। তাদের হিসাবে অভ্যুত্থানের পর থেকে ৪২৬ জনকে আটক করা হয়েছে।

মিয়ানমারের বিভিন্ন এলাকায় সেনাবাহিনীর উপস্থিতি বাড়ছে। বেশ কিছু জায়গায় পুলিশের বদলে সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। ইয়াঙ্গুনে আট চাকার সশস্ত্র গাড়ি নিয়ে যানজট নিয়ন্ত্রণে সেনাবাহিনীকে কাজ করতে দেখা গেছে। বিক্ষোভকারীদের গাড়িগুলোও ঘিরে থাকতে দেখা গেছে।

মিয়ানমারের সেন্ট্রাল ব্যাংক ভবন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের দূতাবাসের বাইরে এবং অং সান সু চির ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির সদর দপ্তরে বিক্ষোভ হয়েছে।

গতকাল সোমবার মিয়ানমারের মানদালায় বিক্ষোভ হয়। বিক্ষোভকারীদের ছাত্রভঙ্গ করতে সেখানে গুলি চালিয়েছে নিরাপত্তা বাহিনী। তবে এতে ঠিক কতজন আহত হয়েছেন, তা জানা যায়নি।

জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে নেতৃত্বদানকারী মিয়ো কো কো আত্মগোপনে আছেন। তিনি বিবিসিকে জানান, কীভাবে তাঁরা নিজেদের জীবন ঝুঁকিতে ফেলেছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে বিশ্বাসী। আমরা জানি আমরা ঝুঁকিতে রয়েছি। পুলিশের তল্লাশির কারণে আমরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে বেড়াচ্ছি। আশা করছি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সহায়তা করবে।’

মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন। সেখানে থেকে বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। পরে তাঁদের মুক্তি দেওয়া হয়।

আমরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারে বিশ্বাসী। আমরা জানি আমরা ঝুঁকিতে রয়েছি। পুলিশের তল্লাশির কারণে আমরা এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় ছুটে বেড়াচ্ছি। আশা করছি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আমাদের সহায়তা করবে।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভে নেতৃত্বদানকারী মিয়ো কো কো

মিয়ানমারে সামরিক অভ্যুত্থান হয় ১ ফেব্রুয়ারি। এর মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত করা হয় অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকারকে। ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণ নেন দেশটির সেনাপ্রধান জেনারেল মিন অং হ্লাইং। এ ছাড়া ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব দেওয়া হয় সাবেক জেনারেল ও বর্তমান ভাইস প্রেসিডেন্ট মিন্ট সোয়েকে। এই অভ্যুত্থানের পেছনে অন্যতম কারণ গত নভেম্বরের নির্বাচন। ওই নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলেছে সেনাবাহিনী। এরপর পার্লামেন্টের প্রথম অধিবেশন শুরুর কয়েক ঘণ্টা আগে ১ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট উইন মিন্ট, সু চিসহ শীর্ষ নেতাদের প্রথমে আটক এবং পরে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়। এরপর এক বছরের জন্য জরুরি অবস্থা জারি করা হয় মিয়ানমারে।

গ্রেপ্তারের পর অং সান সু চির বিরুদ্ধে যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা বেশ অস্বাভাবিক। ক্ষমতাচ্যুত করার দুদিন পর তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, সু চি আমদানি-রপ্তানি আইন ভঙ্গ করেছেন। তাঁর বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ওয়াকিটকি পাওয়ার পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ ছাড়া প্রেসিডেন্ট মিন্টের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়, গত সেপ্টেম্বরে একটি প্রচারণায় অংশ নিয়েছিলেন তিনি। এর মধ্য দিয়ে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবিলায় গৃহীত পদক্ষেপ লঙ্ঘন করেছেন প্রেসিডেন্ট।

এই সেনা অভ্যুত্থানের পর সু চি কিংবা প্রেসিডেন্ট মিন্টকে আর জনসমক্ষে দেখা যায়নি। তবে সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) জানিয়েছিল, সু চি ভালো আছেন। তাঁর আইনজীবী খিন মাউং জ গতকাল বলেন, বুধবার তাঁদের আটকের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। তবে আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই মেয়াদ আরও বাড়তে পারে।