জাপানের কোবে শহরে বইয়ের অরণ্য

স্থপতি তাদাও আন্দো
ছবি: সংগৃহীত

মুঠোফোন আর ইন্টারনেটের যুগে বিশ্বজুড়ে বইপড়া মানুষের সংখ্যা যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। এ কালের তরুণেরা বই পড়ার চেয়ে কম্পিউটার কিংবা মুঠোফোনে শখের ভিডিও গেম খেলতেই বেশি ভালোবাসেন। আর বাকি সময়টুকু সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেকে তুলে ধরতে কাটিয়ে দেন। ফলে প্রযুক্তির এগিয়ে যাওয়ার এই যুগে বইয়ের সঙ্গে নতুন প্রজন্মের দূরত্ব ক্রমেই বাড়ছে।

এ কারণেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শিশুদের মধ্যে ছোটবেলা থেকে পাঠাভ্যাস গড়ে তোলার ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। ইন্টারনেট কিংবা স্মার্টফোনের পর্দায় ভেসে ওঠা কাহিনির বর্ণনা আকর্ষণীয় হলেও জ্ঞানের প্রকৃত উৎস সেটা নয়। আর এ কারণেই বাল্যকাল থেকে জ্ঞানচর্চা নিয়ে আগ্রহ গড়ে তুলতে বইয়ের বিকল্প হয়ে ওঠেনি ওয়েব জগৎ। চিন্তাশীল মানুষ এটা নিয়ে চিন্তিত, আর এই সমস্যার সমাধান কীভাবে করা যায়, সেই পথ খুঁজে পেতে তারা সচেষ্ট। জাপানের বিখ্যাত স্থপতি তাদাও আন্দো এগিয়ে এসেছেন।

তাদাও আন্দো কেবল স্থাপত্যবিদ্যায় নিজের সৃজনশীল অবদান সীমিত রাখেননি। সাধারণ মানুষ যেন শিল্পকলার সৌন্দর্য কাছ থেকে অনুভব করতে পারেন, সেই উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। এ জন্য বেনেসসে করপোরেশন নামের একটি প্রধান শিশুপণ্য তৈরির প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারকে রাজি করিয়েছেন তাদাও আন্দো। তাঁদের সংরক্ষণে থাকা দেশ–বিদেশের নামী শিল্পীদের শিল্পকর্ম স্থায়ীভাবে প্রদর্শনের ব্যবস্থাও তিনি করে দিয়েছেন। সে জন্য জাপানের অভ্যন্তরীণ সাগরের নাওশিমা দ্বীপের প্রকৃতিঘেরা পরিবেশে যে জাদুঘরের নকশা তিনি করেছেন, সেটা নিজে থেকেই হয়ে উঠেছে চমৎকার এক শিল্প। স্থাপত্যশিল্পের অপূর্ব এক নিদর্শন হিসেবে গণ্য করা হয় নাওশিমার বেনেসসে শিল্পকলা জাদুঘরকে।

‘বইয়ের অরণ্যে’ ছাদ ছুঁয়ে যাওয়া বইয়ের শেলফ
ছবি: সংগৃহীত

তাদাও আন্দো এখন মনোযোগ দিয়েছেন অল্প বয়সী ছেলেমেয়েদের মধ্যে পাঠাভ্যাস ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টায়। সেই উদ্যোগের অংশ হিসেবে পশ্চিম জাপানের বন্দরনগরী কোবেতে তিনি গড়ে তুলেছেন একটি পাঠাগার। ব্যতিক্রমী পাঠাগারের নকশা করেছেন নিজেই। পুরো স্থাপনাটিও নিজ খরচে তৈরি করেছেন। কাজ শেষে স্থাপনাটি তুলে দিয়েছেন কোবের নগর প্রশাসনের হাতে। আর এভাবেই গড়ে উঠছে অসাধারণ একটি পাঠাগার, তাদাও আন্দো যেটার নাম দিয়েছেন, শিশুদের বইয়ের অরণ্য।

কোবে শহরের কোবে ইস্ট পার্কের ভেতরে অবস্থিত পাঠাগারে প্রায় ১৮ হাজার বই আছে। প্রকল্প চালু হওয়ার সময় পাঠাগারে বই দান করতে স্থানীয় লোকজনকে আহ্বান জানানো হয়েছিল। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে অনেকেই নিজেদের সংগ্রহে থাকা বই সেখানে দিয়েছেন। তবে ব্যতিক্রমী দিক হলো পাঠাগারের সব কটি বই অল্প বয়সী শিশুদের উপযোগী। পাঠাগার ভবনের উঁচু ছাদ পর্যন্ত থরে থরে সাজিয়ে রাখা হয়েছে এসব বই।

পাঠাগারে সন্তানকে নিয়ে এসেছেন এক মা
ছবি: সংগৃহীত

সাধারণ পাঠাগারের তুলনায় এখানের পরিবেশটা একটু ভিন্ন। কারণ, বাড়িতে পড়ার জন্য সেখান থেকে বই ধার নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয় না পাঠকদের। পাঠাগারের ভেতরে ও পার্কের খোলা পরিবেশে নিরিবিলি বসে থেকে বই পড়ে নিতে হয়। এ ধরনের পরিবেশের মাধ্যমে তাদাও আন্দো অল্প বয়সী পাঠকদের প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় বন্ধন গড়ে তুলতে সাহায্য করছেন। অভিনব পাঠাগারটি ইতিমধ্যে শিশুদের মনোযোগ আকৃষ্ট করছে। প্রতিদিনই মা–বাবার সঙ্গে শিশুরা সেখানে গিয়ে বই পড়ছে। আনন্দ উপভোগের পাশাপাশি পাঠাগারে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।

প্রকৃতি ও জীবন সম্পর্কে শিশুদের উৎসাহিত করে তোলার ভাবনা থেকে পাঠাগারের সংগ্রহশালা সাজিয়ে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে রূপকথা, কল্পকাহিনি, কবিতা কিংবা গল্পের মতো বিভিন্ন বিভাগে সাজিয়ে রাখা হয়নি, বরং সেগুলো রাখা হয়েছে থিম বা বিষয়বস্তুর ভিত্তিতে। সে রকম বিষয়বস্তুর মধ্যে আছে ‘জীবনের অরণ্য’, ‘সমুদ্রের বাইরের বন’।

প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত এ রকম আরও অনেক বিষয়। এসব বই পড়লে বইয়ের বাইরের জগৎ থেকে যাওয়া জীবন নিয়ে ভাবতে শিশুদের উৎসাহিত করবে। ফলে প্রতিটি শিশুর পক্ষেই নিজের উৎসাহের বই সেখানে সহজে খুঁজে পাওয়া সম্ভব।
জাপানে করোনাভাইরাস সংক্রমণ চলতে থাকায় সীমিতসংখ্যক শিশুকে ৯০ মিনিটের জন্য পাঠাগারটি ব্যবহারের অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির উন্নতি হলে বিধিনিষেধ পুরোপুরি তুলে নিতে চায় পাঠাগারের পরিচালক প্রতিষ্ঠান।