জাপান-দক্ষিণ কোরিয়া তিক্ততা এখন অলিম্পিকে

বিদেশের বিভিন্ন দল এখন নজিরবিহীন কড়াকড়ি আর নিষেধাজ্ঞার মধ্যে টোকিও উপসাগরের কাছাকাছি এলাকায় তৈরি অলিম্পিক ভিলেজে আসতে শুরু করেছে। ২০২০ টোকিও অলিম্পিক শুরু হওয়ার আগে এক সপ্তাহের কম সময় হাতে থাকা অবস্থায় ক্রীড়াবিদেরা চাইছেন, সময় হাতে রেখে ভিলেজে হাজিরা দিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার আগে শেষ মুহূর্তের প্রশিক্ষণ সেরে নিয়ে মাঠে নামার জন্য তৈরি হয়ে যেতে।

স্বাভাবিক অবস্থায় অলিম্পিক ভিলেজ সব সময় প্রাণবন্ত এক মিলনকেন্দ্র হয়ে ওঠে, অ্যাথলেটরা যেখানে পরস্পরের মেলামেশা করা ছাড়াও ভিলেজ চত্বরে আয়োজিত নানা রকম অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তবে এবার অলিম্পিক ভিলেজ একেবারে ভিন্ন চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে। নেই সেখানে বিনোদনের কোনো আয়োজন, নেই সামাজিকভাবে একে অন্যের সঙ্গে মেলামেশা করার সুযোগ। করোনাভাইরাস অলিম্পিকের আয়োজনজুড়ে কালো যে মেঘের ছাপ রেখে যাচ্ছে, অলিম্পিক ভিলেজের এই চেহারা হচ্ছে তারই প্রতিচ্ছবি।

অ্যাথলেটদের ভিলেজে অবস্থানের সময়ও সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রয়োজন ছাড়া ভিলেজ চত্বরের বাইরে যাওয়ার অনুমতি তাদের নেই। প্রতিদিন দুবার নিয়মিতভাবে করোনাভাইরাস পরীক্ষা নেওয়ার বাইরে কেবল প্রশিক্ষণের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বিশেষ ব্যবস্থায় তাঁরা যেতে পারবেন। ফলে অলিম্পিক ভিলেজ অনেকটাই নীরব। তবে তারপরও অবশ্য থেমে নেই ভিলেজকেন্দ্রিক বিতর্কিত কিছু তৎপরতা।

সে রকম একটি ঘটনা নিয়ে চলা বিতর্ক শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) মধ্যস্থতায় নিষ্পত্তি করে নিতে হয়। অলিম্পিক ভিলেজে উপস্থিত হওয়ার পর দক্ষিণ কোরিয়ার খেলোয়াড়েরা যেখানে তাঁরা অবস্থান করছেন, ভবনের সেই তলার বারান্দার রেলিংজুড়ে বিশাল ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন, যেখানে লেখা ছিল ‘এরপরও কোরিয়ার ৫ কোটি মানুষ আমাদের সঙ্গে আছে।’ কোরীয় উপদ্বীপের অতীত ইতিহাস যাদের জানা নেই, তাদের কাছে এটা খুবই নির্দোষ এক স্লোগান মনে হতে পারে। তবে এই স্লোগানকে কেন্দ্র করে পরে দেখা দেওয়া কিছু সমস্যা বলে দিচ্ছে একেবারে নির্দোষ বক্তব্য সেটা ছিল না।

দক্ষিণ কোরিয়ার অলিম্পিক কমিটি শনিবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে যে আইওসি স্লোগানকে উসকানিমূলক হিসেবে রায় দেওয়ার পর সেই বার্তাসংবলিত ব্যানার দক্ষিণ কোরিয়া সরিয়ে নিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার অ্যাথলেটরা ভবনের ব্যালকনিজুড়ে ব্যানার ঝুলিয়ে রাখার পর জাপানের দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক কর্মীদের একটি দল অলিম্পিক ভিলেজের বাইরে সমবেত হয়ে হইচই জুড়ে দিয়েছিল। পাশাপাশি জাপানের পক্ষ থেকে স্লোগান নিয়ে আনুষ্ঠানিক অভিযোগও আইওসির কাছে দাখিল করা হয়। অভিযোগ খতিয়ে দেখে আইওসি সে রকম ব্যানার প্রদর্শন করা গ্রহণযোগ্য নয় উল্লেখ করে রায় দেওয়ার পর দক্ষিণ কোরিয়ার অলিম্পিক কমিটি আজ তাদের ব্যানার সরিয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছে। তবে কমিটি একই সঙ্গে উল্লেখ করে যে স্টেডিয়ামে কিংবা অলিম্পিকের অন্য কোনো ভেন্যুতে জাপানের পক্ষ থেকেও যে ছড়িয়ে পড়া সূর্যরশ্মি-সংবলিত পতাকা প্রদর্শন করা হবে না, সে রকম প্রতিশ্রুতি আইওসি দিয়েছে। ফলে ব্যানার সরিয়ে নিতে দক্ষিণ কোরিয়া এরপর সম্মত হয়। এবার দেখা যাক কেন অতীত ইতিহাসের সঙ্গে সম্পর্কিত এ রকম দুটি বিষয় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এতটা উত্তপ্ত এক ঠান্ডা লড়াই।

দক্ষিণ কোরিয়ার অ্যাথলেটরা ৫ কোটি কোরীয়র সমর্থন তাদের পেছনে আছে উল্লেখ করা যে ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন, সেই উদ্ধৃতি পরোক্ষভাবে ৫০০ বছরের বেশি আগের একটি ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত। দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকা দেশের জাতীয় বীর হিসেবে যাঁরা গণ্য, তাঁদের একজন হলেন ষোড়শ শতকেরই নৌকমান্ডার ই সুন-সিন। ১৫৯২ থেকে ১৫৯৮ সাল পর্যন্ত কোরিয়া দখল করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে জাপানের চালানো আগ্রাসনের সময় জাপানি রণতরির হামলার মুখে কোণঠাসা হয়ে পড়ার পর একপর্যায়ে কোরিয়ার জোসেন সাম্রাজ্যের সম্রাট সেওঞ্জোকে তিনি এ রকম বলেছিলেন বলে বলা হয়, ‘আমার কাছে এখনো ১২টি যুদ্ধজাহাজ আছে।’

এরপর সীমিতসংখ্যক সেই যুদ্ধজাহাজ নিয়ে বীর বিক্রমে শত্রুর ওপর তিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন এবং জাপানের অনেক বেশিসংখ্যক যুদ্ধজাহাজের বহরকে হটিয়ে দিয়ে কোরিয়াকে বিপদ মুক্ত করেন। লোকমুখে পরম্পরায় চলে আসা সেই বীরত্বের কাহিনি দক্ষিণ কোরিয়ার জাতীয়তাবাদীদের আজও অনুপ্রাণিত করলেও ইতিহাসের সে রকম ব্যাখ্যায় জাপান স্বাভাবিকভাবেই সন্তুষ্ট নয়। ধারণা করা হয়, দক্ষিণ কোরিয়ার অলিম্পিক দলের কেউ কেউ হয়তো সেই উক্তি অনুসরণ করে লেখা ব্যানার ঝুলিয়ে দিয়ে জাপানকে বলতে চাইছিলেন যে পরিবেশ প্রতিকূল হলেও অলিম্পিকে তাঁরা জাপানকে পরাজিত করবেন।

অন্যদিকে জাপানের অতীতের যে জাতীয় পতাকা নিয়ে কোরীয়দের অসন্তোষ, জাপানে এখন সেই পতাকা আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত না হলেও কট্টর জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন গোষ্ঠী এখনো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেই পতাকা বহন করে সম্ভবত চীন ও দুই কোরিয়ার কাছে এই বার্তা পৌঁছে দিতে আগ্রহী যে আগের সেই ‘গৌরবময়’ অধ্যায়ে আবারও ফিরে যেতে দেশ দ্বিধা করবে না। ফলে দুই পক্ষের টানাপোড়েন অনেকটাই অতীতকে কেন্দ্র করে।

ব্যানার ঝুলিয়ে রাখা এবং বিতর্কিত পতাকা ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে অলিম্পিক সনদের একটি ধারা লঙ্ঘিত হতে পারে উল্লেখ করে আইওসি বলছে, সনদের দ্বিতীয় ধারায় পরিষ্কারভাবে বলা আছে যে ‘অলিম্পিকের জন্য নির্ধারিত কোনো স্থান, ভেন্যু কিংবা সংশ্লিষ্ট অন্য কোনো জায়গায় বিক্ষোভ প্রদর্শন কিংবা রাজনৈতিক, ধর্মীয় অথবা বিদ্বেষপূর্ণ কোনো ধরনের প্রচারকাজ চালানোর অনুমতি দেওয়া হবে না।’ আইওসির রায় মেনে নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়ার অলিম্পিক দল ইতিমধ্যে ব্যানার সরিয়ে নিয়েছে।

জাপানের জাতীয়তাবাদীরাও অন্যদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে সে রকম বিতর্কিত পতাকা প্রদর্শন করা থেকে বিরত থাকবে, সেই আশা এখন অনেকেই করছেন।