ডেলটায় বিপর্যস্ত ইন্দোনেশিয়ায় অক্সিজেন সংকটে ৬৩ জনের মৃত্যু
করোনাভাইরাসের ডেলটা ধরনের সংক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ইন্দোনেশিয়া। দেশটিতে করোনা শনাক্তের হার ও মৃত্যুর সংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। হাসপাতালগুলো কোভিড–১৯ রোগীতে ভর্তি। চাহিদা বেড়েছে অক্সিজেনের। রোগীর চাপ সামলাতে প্রায় বিপর্যস্ত ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্যব্যবস্থা। চরম সংকট দেখা দিয়েছে অক্সিজেনের।
অক্সিজেনের সংকটে দেশটির একটি হাসপাতালে গত শনিবার পর্যন্ত ৬৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হাসপাতালগুলোয় অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছে ইন্দোনেশিয়া সরকার।
আজ সোমবার সংবাদমাধ্যম রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার জাভা দ্বীপের সারদজিতো জেনারেল হাসপাতালে অক্সিজেনের সংকটে গত শনিবার পর্যন্ত অন্তত ৬৩ করোনা রোগীর মৃত্যু হয়েছে। হাসপাতালের কর্মকর্তারা জানান, কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহব্যবস্থা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর স্বাস্থ্যকর্মীরা সিলিন্ডারের মাধ্যমে করোনা রোগীদের অক্সিজেন দেওয়ার চেষ্টা করেন। এরপরও ৬৩ জনকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
বিশ্বের চতুর্থ জনবহুল দেশ ইন্দোনেশিয়া। বর্তমানে দক্ষিণ–পূর্ব এশিয়ার এই দেশে করোনার ডেলটা ধরন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। আর রোববার করোনায় আক্রান্ত হয়ে দেশটিতে রেকর্ড ৫৫৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। এ পর্যন্ত করোনায় মারা গেছেন ৬০ হাজার ৫৮২ জন। আজ সোমবার ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রতিদিনই ইন্দোনেশিয়ায় ২৫ হাজারের বেশি নতুন কোভিড–১৯ রোগী শনাক্ত হচ্ছে। মোট শনাক্তের সংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ।
গত ঈদে লাখো মানুষ ইন্দোনেশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে স্বজনদের সঙ্গে উৎসব উদ্যাপনে যোগ দেন। দেশটিতে করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার পেছনে সেটা ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হচ্ছে। ইন্দোনেশিয়া মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশনের মুখপাত্র আহমাদ ইপুল সাইফুদ্দিন বলেন, ঈদের তিন সপ্তাহ পর থেকে সংক্রমণ বাড়তির পথে রয়েছে।
আর এখন ছড়িয়ে পড়েছে করোনার অতিসংক্রামক ভারতীয় ডেলটা ধরন।
জাভা ও পর্যটনকেন্দ্র বালিতে গত সপ্তাহে লকডাউন ঘোষণা করেছে ইন্দোনেশিয়া সরকার। তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, রাজধানী জাকার্তার বাইরে করোনার পরীক্ষার হার তুলনামূলক কম। এ কারণে দেশটিতে মোট শনাক্তের সংখ্যা সরকারি হিসাবের তুলনায় আরও বেশি হতে পারে।
দেশটির বান্দুং শহরের দুটো হাসপাতালের কর্তৃপক্ষ আজ সোমবার জানিয়েছে, তাদের অক্সিজেন ফুরিয়ে এসেছে। এ কারণে জরুরি বিভাগে নতুন রোগী এলেও তাঁরা সেবা দিতে পারছেন না। সপ্তাহজুড়ে বান্দুং ছাড়াও সুরাকারতা, পামেকাসান শহরের হাসপাতালগুলোয় রোগীর উপচে পড়া ভিড় রয়েছে। অনেক হাসপাতালে তাঁবু টানিয়ে বাড়তি রোগীদের সেবা দেওয়া হচ্ছে। অনেক হাসপাতাল রোগীদের ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হচ্ছে।
গত শুক্রবার থেকে বান্দুং রিজিওনাল জেনারেল হাসপাতালের জরুরি বিভাগ কোভিড–১৯ রোগীদের সেবা দেওয়া বন্ধ রেখেছে। এর অন্যতম কারণ অক্সিজেনসংকট। স্মার্ট পামেকাসান হাসপাতালের চিকিৎসক সাইফুল হিদায়েত বলেন, হাসপাতালে রোগীর লম্বা সারি দেখা যাচ্ছে। প্রতিদিনই ১০–১৫ জন কোভিড–১৯ রোগী হাসপাতালে আসছেন।
করোনায় আক্রান্ত বয়স্ক মাকে নিয়ে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরেও একটি শয্যা পাননি সেখানকার একজন নারী। পরে একটি হাসপাতালের বাইরে টানানো তাঁবুতে তাঁর মাকে ভর্তি করাতে পেরেছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই নারী বিবিসিকে বলেন, হাসপাতালগুলোয় ‘যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থার’ মতো পরিস্থিতি বিরাজ করছে।
পরিস্থিতি মোকাবিলায় উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হাসপাতালগুলোয় অক্সিজেন সরবরাহ বাড়ানোর নির্দেশনা দিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সিতি নাদিয়া। একই সঙ্গে তিনি বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার মজুত না করতে দেশটির জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করি, মানুষ অক্সিজেনের মজুত করবে না। এতে যাদের প্রয়োজন, তারা চরম সংকটে পড়বে।’ করোনাকালে বাড়তি চাহিদার জেরে দেশটিতে অক্সিজেন সিলিন্ডার আগের চেয়ে দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে।
এদিকে টিকার দুই ডোজ নেওয়া না থাকলে কেউ ভিনদেশ থেকে ইন্দোনেশিয়ায় ঢুকতে পারবেন না বলে জানিয়েছে দেশটির সরকার। আগামীকাল মঙ্গলবার থেকে দেশটিতে প্রবেশে নতুন এই নিয়ম চালু হচ্ছে। এ ছাড়া দেশটিতে প্রবেশের জন্য করোনার নেগেটিভ সনদ প্রয়োজন হবে। ইন্দোনেশিয়ায় আসার পরে আট দিনের কোয়ারেন্টিনে থাকতে হবে।
করোনার সংক্রমণের লাগাম টানতে ইন্দোনেশিয়া মূলত চীনে উৎপাদিত টিকা সিনোভ্যাকের ওপর ভরসা করে রয়েছে। তবে দেশটির জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিসংক্রামক ডেলটা ধরনের ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে এই টিকার দুটো ডোজ যথেষ্ট নয়। বরং সিনোভ্যাকের বুস্টার ডোজ ডেলটার বিরুদ্ধে সুরক্ষা দিতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। আগামী বছরের শুরু নাগাদ ইন্দোনেশিয়া সরকার দেশটির ১৮ কোটির বেশি মানুষকে টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে।