তালেবান কি নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সহযোগী হচ্ছে

আফগানিস্তান এখন দেশের ভেতরে–বাইরে নানা জটিল সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত। এর ফলাফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা সহজ নয়।

  • আফগান মধ্যবিত্ত ও শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ব্যাপক প্রস্থান ঘটছে।

  • এটা তালেবান শাসনের প্রতি আফগান বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও উদ্যোক্তাদের অনাস্থারই প্রতিফলন।

  • তালেবান শাসনকে স্বীকৃতি না দিয়েই তাদের সঙ্গে ছয়টি দেশ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে।

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর বিভিন্ন সড়কে পতাকা উড়িয়ে টহল দেন সশস্ত্র তালেবান যোদ্ধারা
ফাইল ছবি: এএফপি

আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলে ১৫ আগস্ট প্রবেশের পর তালেবান ক্ষমতার ওপর তাদের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করছে। বাস্তবিক সব উদ্দেশ্যের ক্ষেত্রে তাদের ইসলামিক আমিরাত সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। আফগান সেনাবাহিনী ও রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের পতন তালেবানের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণের প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছে। তবে তারা কিছু গুরুতর সমস্যারও মুখোমুখি হচ্ছে।

এক. আফগান মধ্যবিত্ত ও শহরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনগোষ্ঠীর ব্যাপক প্রস্থান। তার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য দেশের লোকজন সরিয়ে নেওয়ার বড় ধরনের অভিযান চলছে। তারা তাদের সেনা ও কূটনীতিকদের দেশে ফিরিয়ে নিচ্ছে। এতে তালেবানের ক্ষমতা দখলের ১০ দিন পরও কাবুল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নিয়ন্ত্রণহীন জট লেগে আছে। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে এই অভূতপূর্ব প্রস্থানের ঘটনা তালেবান শাসনের প্রতি আফগান বুদ্ধিজীবী, পেশাজীবী ও উদ্যোক্তাদের অনাস্থারই প্রতিফলন। যদিও গতকাল মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে তালেবানের মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ আফগানদের উদ্দেশে বলেছেন, বিমানবন্দরে বিশৃঙ্খল অবস্থা বজায় থাকায় সেখানে আর আফগানদের যেতে দেওয়া হবে না।

দুই. কর্মস্থলে যোগ দেওয়া এবং পুনরায় কাজ শুরু করার বিষয়ে তালেবানের আহ্বানে অধিকাংশ সরকারি কর্মচারী সাড়া দিচ্ছেন না। দ্বিতীয় সপ্তাহের মতো ব্যাংক বন্ধ রয়েছে, যা জনগণের জন্য একটি হতাশাজনক পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছে। কিছু ক্ষেত্রে যেখানে সরকারি কর্মচারীরা উপস্থিত হয়েছেন, সেখানে নারী কর্মচারীদের তাঁদের বাড়িতে ফেরত পাঠিয়েছে তালেবান।

তিন. গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা মোকাবিলার জন্য সরকারি বিভাগগুলো সক্রিয় করার পরিবর্তে তালেবান নিজস্ব কমিশনের ক্ষমতায়ন করছে। এটি ১৯৯০-এর দশকে তাদের একক শাসনের কথাই স্পষ্টভাবে মনে করিয়ে দেয়। যেখানে সশস্ত্র মিলিশিয়া ও রাষ্ট্রব্যবস্থার মধ্যকার পার্থক্য বিপজ্জনকভাবে অস্পষ্ট হয়ে পড়েছিল। যদিও গতকাল তালেবান আফগানিস্তানে নতুন অর্থমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং গোয়েন্দাপ্রধানের নাম ঘোষণা করেছে।

চার. গত দুই দশক পাকিস্তান তালেবানের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রমের বাইরে তাদের কাজের বেশির ভাগই ছিল গোপন। কিন্তু গত ১০ দিনে কাবুলে তালেবানের রাজনৈতিক ও সামরিক কার্যক্রম তাদের সাংগঠনিক রূপকে জনসমক্ষে নিয়ে এসেছে।

তালেবান একক কোনো গোষ্ঠী নয়

তালেবানের মধ্যে বিভিন্ন দলীয় সম্মিলন রয়েছে। উদাহরণ হিসেবে কোয়েটা শুরার (কাউন্সিল) কথা বলা যায়। এখানে কান্দাহার, হেলমান্দ, রোজগান, ফারাহ ও আফগানিস্তানের অন্যান্য দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রদেশের ধর্মীয় নেতা ও সামরিক কমান্ডারদের আধিপত্য রয়েছে। তালেবানের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা ওমর এবং তাঁদের বর্তমান নেতা হায়বাতুল্লাহ আখুনজাদার মতো তাঁরাও তালেবানের মূল শিকড়ের প্রতিনিধিত্ব করেন।

তারপর রয়েছে হাক্কানি নেটওয়ার্ক। যারা শহুরের কেন্দ্রগুলোতে বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলার জন্য কুখ্যাত। এটি পাকিস্তানি নিরাপত্তা সংস্থার ঘনিষ্ঠ মিত্র। ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে মার্কিন শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তা অ্যাডমিরাল মাইক মুলেন একে পাকিস্তানি সামরিক গোয়েন্দা সংস্থা ইন্টার সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (আইএসআই) ‘সত্যিকারের অঙ্গ’ বলে অভিহিত করেছিলেন।

হাক্কানি নেটওয়ার্ক কাবুল দখল করে। তাদের অন্যতম সদস্য খলিল-ইউ-রেহমান হাক্কানি। হাস্যকর হলো, তাঁর মাথার দাম ৫০ লাখ মার্কিন ডলার পুরস্কারের ঘোষণাটি এখনো বহাল রয়েছে। তিনি বড় ধরনের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত। যার মধ্যে মার্কিন সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয়ের বিষয়টিও রয়েছে! এই বিষয়টি স্পষ্টতই কোয়েটা শুরার নেতাদের হৃদয়ে ও মনে উদ্বেগ সৃষ্টি করে, যাঁরা নিজেদের তালেবানের ভ্যানগার্ড বলে মনে করেন।

গত দুই দশকে ঐতিহ্যবাহী আফগান জাতীয়তাবাদ আধুনিক প্রকৃতির জাতীয়তাবাদের দ্বারা শক্তিশালী হয়েছে। এটি দ্রুত নগরায়ণ, নতুন জাতীয় বুদ্ধিজীবীদের উত্থান, ইলেকট্রনিক মিডিয়ার উন্নয়ন (বিশেষ করে সামাজিক মাধ্যম) এবং দেশের বিভিন্ন অংশের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সংযোগ তৈরিকারী সড়ক ও যোগাযোগ অবকাঠামোর ফল।

আফগান তরুণেরা জনতাত্ত্বিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। তাঁরা এই জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে বড় সামাজিক দল। তিন রঙা আফগান জাতীয় পতাকা এই নবজাতক জাতীয়তাবাদের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতীক। আফগান তরুণেরা আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টের সময় তাঁদের জাতীয় ক্রিকেট দলের হয়ে এই পতাকা ওড়ান, যা নতুন আফগানিস্তানের মুখচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

অন্যদিকে তালেবান যোদ্ধাদের বড় অংশই হলো আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী এলাকার পাকিস্তানের বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্র, যারা মূলত বিভিন্ন সময়ে আফগানিস্তান থেকে উদ্বাস্তু হওয়া পশতুনদের সন্তান। তালেবান ধর্মীয় চরমপন্থার প্রতিনিধিত্ব করে। তারা নতুন আফগান জাতীয়তাবাদের যে প্রবণতা, তার বিপরীত বিষয়ের প্রতিনিধিত্ব করে।

এটাই তাদের পাকিস্তানি নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে জনপ্রিয় করে তুলেছে। আর তাদের অনুসারীরা, যারা ৫০ লাখের বেশি পশতুনের মধ্যে জাতীয়তাবাদের উত্থানকে ভয় পায়, তারা পাকিস্তানি অংশের ডুরান্ড লাইনে বসবাস করে।

সাম্প্রতিক সামরিক হামলার সময় তালেবান আফগানিস্তানের বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় ভবন থেকে জাতীয় পতাকা সরিয়ে তার পরিবর্তে তাদের সাদা পতাকা স্থাপন করে। এতে জনগণের মধ্যে, বিশেষ করে দেশটির তরুণদের মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়।

১৯ আগস্ট আফগানিস্তানের স্বাধীনতা দিবসে কুনার, জালালাবাদ, খোস্ত, কান্দাহার ও কাবুলে নারী-পুরুষসহ বিপুলসংখ্যক মানুষ দেশটির জাতীয় পতাকা নিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে। তারা তালেবান ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্লোগান দিতে থাকে।

বন্দুকধারী তালেবান অহিংস বিক্ষোভকারীদের বিরুদ্ধে সহিংসতা চালায়। ফলে কিছু জায়গায় হতাহতের ঘটনা ঘটে। আফগানিস্তানের অধিকাংশ এলাকা দখল করার চার দিন পর এটাই ছিল তালেবানের বিরুদ্ধে প্রথম প্রকাশ্য প্রতিবাদ। এভাবে পশতুন বেল্টে অস্থিরতার আগ্নেয়গিরি ছড়িয়ে পড়ে। শিক্ষিত তরুণীদের অংশগ্রহণ এই বিক্ষোভকে আরও তাৎপর্যপূর্ণ করে তোলে।

তাজিক বংশোদ্ভূত আফগান নেতাদের একটি প্রতিনিধিদল দ্বিতীয় সপ্তাহের মতো ইসলামাবাদে অবস্থান করছে। যেখানে তালেবানের পাকিস্তানি নিয়ন্ত্রকেরা ইসলামি আমিরাতকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য তালেবানের অধীনে একটি ‘ব্যাপকভিত্তিক সরকার’ গঠনে কঠোর পরিশ্রম করছে।

তালেবান নয়—এমন আফগানদের জন্য সরকারে স্থানের সম্ভাবনা অন্বেষণে সাবেক প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ও সাবেক প্রধান নির্বাহী আবদুল্লাহ কাবুলে তালেবানের সঙ্গে আলোচনা করছেন। কিন্তু এই সম্ভাবনাগুলো খুব একটা উজ্জ্বল বলে মনে হচ্ছে না।

ছয় দেশের নজর

ইসলামাবাদের সূত্রগুলো বলছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে গ্রহণযোগ্য করার লক্ষ্যে ইসলামি আমিরাতকে ১৯৬৪ সালের আফগান সংবিধানের আওতায় আনতে তালেবানকে রাজি করানোর চেষ্টা করছে পাকিস্তানের গুপ্ত সরকার।

আফগানিস্তানের শেষ বাদশাহ জহির শাহ তাঁর পূর্ণ রাজতন্ত্রকে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে রূপান্তরের জন্য ১৯৬৪ সালের সংবিধান প্রবর্তন করেছিলেন। প্রস্তাবিত নতুন ব্যবস্থায় তালেবানের শীর্ষ নেতা বাদশার স্থান পূরণ করবেন।

একটি কার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুতর জটিলতায় এই পন্থা কতটা মসৃণভাবে কাজ করবে, তা অনুমান করা কঠিন।

মজার ব্যাপার হলো, তালেবান শাসনকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি না দিয়েই তাদের সঙ্গে ছয়টি দেশ ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছে। সেগুলো হলো পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন ও ইরান। এই রাষ্ট্রগুলোর বৈচিত্র্যপূর্ণ এবং এমনকি পরস্পরবিরোধী স্বার্থ রয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের ক্ষেত্রে তালেবান হলো তাদের নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সহযোগী। এর অংশ হচ্ছে জিনজিয়াংয়ের মুসলিম জনগোষ্ঠীকে জাগিয়ে তোলা, মধ্য এশিয়ায় চীনের রোড অ্যান্ড বেল্ট ইনিশিয়েটিভকে (বিআরআই) আটকানো এবং পূর্বে রাশিয়ার জন্য সমস্যা সৃষ্টি করা।

কিন্তু রাশিয়া ও ইরান মনে করে, তারা মধ্যপ্রাচ্যে তাদের কৌশলগত লক্ষ্য যেভাবে অর্জন করেছে, একইভাবে মধ্য এশিয়াতেও যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যকে পরাজিত করতে পারবে। এটা ইসরায়েল ও সৌদি আরব—উভয়ের জন্য খুবই উদ্বেগের বিষয়।

চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরে (সিপিইসি) যোগদান, অবকাঠামো নির্মাণে চীনা বিনিয়োগ ও বিপুল খনিজ সম্পদ উত্তোলনে আফগানিস্তানকে উন্মুক্ত করতে তালেবানকে বোঝানোর জন্য পাকিস্তানের ওপর নির্ভর করছে চীন। আফগানিস্তান নিয়ে এই তীব্র ও জটিল আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতার ফলাফল সম্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করা সহজ নয়।

কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আফগানদের দুর্দশার দিকে তেমন মনোযোগ দেওয়া হচ্ছে না, যারা চার দশক ধরে ক্রমাগত যুদ্ধ এবং আবারও রাষ্ট্রীয় সুরক্ষা ছাড়াই নৃশংস সশস্ত্র গোষ্ঠীর দয়ার মুখোমুখি।

আফ্রাসিয়াব খটক: পাকিস্তানের সাবেক সিনেটর ও আঞ্চলিক রাজনীতিবিষয়ক বিশ্লেষক

ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সাইফুল সামিন