পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপে তলানিতে রাশিয়া-জাপান সম্পর্ক

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

রাশিয়া ও জাপানের সম্পর্ক দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এতটা খারাপ পর্যায়ে কখনো নামেনি। স্নায়ুযুদ্ধের পুরো সময়ে দুই দেশের সম্পর্কে উত্তেজনা বিরাজমান ছিল। এরপরও দুই দেশের দূতাবাসের একাধিক কর্মীকে একসঙ্গে বহিষ্কার ও পাল্টা বহিষ্কারের ঘটনা খুব বেশি ঘটতে দেখা যায়নি, যেমনটি ঘটছে এখন।

ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর পর থেকে মস্কোর বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে রয়েছে জাপান। অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার পাশাপাশি রাশিয়ার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের সম্পদ জব্দের ঘোষণা দিয়েছে দেশটি। একই সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ ও পণ্যের লেনদেনের ক্ষেত্রে সবেচেয়ে সুবিধাভোগী রাষ্ট্রের তালিকা থেকে রাশিয়াকে বাদ দিয়েছে টোকিও।

তেল, গ্যাস ও কয়লার মতো প্রয়োজনীয় জ্বালানি বাদে রাশিয়া থেকে অন্য সব আমদানি নিষিদ্ধ করেছে জাপান। রাশিয়ায় বিনিয়োগ করা জাপানের বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে দেশটি থেকে নিজেদের কর্মকাণ্ড গুটিয়ে নিয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে দেশটিতে জাপানের বিভিন্ন কোম্পানির স্থানীয় কার্যালয় ও কারখানা।

রাশিয়াও পাল্টা আঘাত হেনেছে। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যদেশগুলোর পাশাপাশি জাপানকেও অবন্ধুসূলভ রাষ্ট্রের তালিকায় ফেলেছে। মস্কো বলছে, রাশিয়ার কাছ থেকে যেকোনো পণ্য কিনতে হলে এসব রাষ্ট্রকে এখন রুশ মুদ্রা রুবলে মূল্য পরিশোধ করতে হবে।

মস্কো সরকারের ভালোভাবে জানা আছে যে নিষেধাজ্ঞা বলবৎ হওয়া সত্ত্বেও রাশিয়ার হাতে এমন কিছু পণ্য আছে যেগুলো কিনতে অন্যরা বাধ্য হবে। জাপান অবন্ধুসূলভ রাষ্ট্রের তালিকায় থাকায় তাদেরও রুবলে মূল্য পরিশোধ করতে হবে।

পাশাপাশি জাপানের সঙ্গে ভূখণ্ডগত বিরোধ নিয়ে চলমান আলোচনা বন্ধ করেছে রাশিয়া। দেশটি বলছে, দ্বীপের মালিকানাসংক্রান্ত বিষয়টি নিয়ে স্থায়ী নিষ্পত্তি এরই মধ্যে হয়ে গেছে। অর্থাৎ, মস্কো টোকিওকে বার্তা দিতে চাচ্ছে, হোক্কাইডোর অদূরে অবস্থিত চারটি দ্বীপ রুশ ভূখণ্ডের অংশ। বিষয়টি নিয়ে জাপানের সঙ্গে আর কোনো আলোচনায় যাবে না তারা।

শুধু তা–ই নয়। চলতি সপ্তাহেই এ নিয়ে হুঁশিয়ারি দিয়ে মস্কো বলে, ওই চার দ্বীপের কাছে সামরিক মহড়া চালানোর নামে ‘উসকানিমূলক’ তৎপরতায় জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র জড়িত হলে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া থেকে বিরত থাকবে না রাশিয়া।

জাপানের দিক থেকে ভূখণ্ডগত বিরোধ নিয়ে আলোচনা বন্ধের এ বার্তা সহজে গ্রহণ করার মতো নয়। কারণ, ১৯৫৬ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধপরবর্তী সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে টোকিও বিরতিহীনভাবে দ্বীপগুলো নিয়ে মস্কোর সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেছে।

সেসব আলোচনা ফলপ্রসূ না হলেও দুই দেশের মধ্যে আগামীতে একটি আপোসে পৌঁছানোর পথ খোলা ছিল। প্রথমবারের মতো এখন সেই পথ বন্ধ হতে যাচ্ছে। এর অর্থ একমাত্র যুদ্ধের মাধ্যমে এর সমাধান খুঁজে পাওয়া। তবে বিপজ্জনক সে পথে পা বাড়ানো জাপান কিংবা রাশিয়া—কারও জন্যই কাঙ্ক্ষিত হবে না।

দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা যখন বাড়ছে, এমন পরিস্থিতে চলতি মাসের শুরুতে রাশিয়ার আট কূটনীতিক ও বাণিজ্য কর্মকর্তাকে বহিষ্কারের ঘোষণা দেয় জাপান সরকার। টোকিওর ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আট রুশ কর্মকর্তা ইতিমধ্যে জাপান ছেড়ে চলে গেছেন।

কর্মকর্তাদের বহিষ্কারে জাপানের সিদ্ধান্ত সামনে আসার পর রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছিল, মস্কো যথাসময়ে এর জবাব দেবে। সেই ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে গতকাল বুধবার জাপানের আট কূটনীতিককে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেয় রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের ঘোষণা অনুযায়ী, বহিষ্কার হওয়া আট জাপানি কর্মকর্তাকে আগামী মাসের ১০ তারিখের মধ্যে রাশিয়া ছেড়ে চলে যেতে হবে। এসবের মধ্য দিয়ে জাপান ও রাশিয়ার পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারের খেলা বেশ জমে উঠেছে।

রাশিয়ার এমন পাল্টা পদক্ষেপের পর জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়োশিমাসা হায়াশি বলেছেন, মস্কোর নেওয়া সিদ্ধান্ত কোনো অবস্থাতেই গ্রহণযোগ্য নয়। একই সঙ্গে এ সিদ্ধান্তের কঠোর প্রতিবাদ জানান তিনি। তবে জাপান মস্কোর সিদ্ধান্ত অমান্য করবে কি না, তা বলেননি।

রাশিয়ার ভাষ্য, ইউক্রেন নিয়ে টোকিওর মায়াকান্না এবং এর জেরে রাশিয়াকে শত্রু হিসেবে দেখা জাপানের দিক দিয়ে একেবারেই অযৌক্তিক। পশ্চিমা মিত্রদের সন্তুষ্ট করতে গিয়ে নিজেদের ক্ষতিই ডেকে আনছে দেশটি।

জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা আগামী মাসের শুরুতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার তিনটি দেশ সফরের পরিকল্পনা করছেন। দেশগুলো হলো ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড। সেখানে অর্থনৈতিক বিষয়ের বাইরে ইউক্রেন সমস্যা এবং রুশবিরোধী জোটে যোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করবেন তিনি।

প্রায় একই সময়ে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হায়াশিও অনেকটা একই উদ্দেশ্য নিয়ে উজবেকিস্তান, কাজাখস্তান ও মঙ্গোলিয়া সফর করবেন। জাপানের শীর্ষস্থানীয় নেতাদের এসব তৎপরতার ওপর নজরদারি করে চলেছে মস্কো।

অন্যদিকে তাইওয়ান ইস্যুকে কেন্দ্র করে তলানিতে পৌঁছেছে চীন–জাপান সম্পর্ক। এর ফলে ধারণা করা যায়, আগামীতে এশিয়ার পূর্বাঞ্চলে উত্তেজনা হয়তো আরও বৃদ্ধি পাবে। আর এ সুযোগে অস্ত্র ব্যবসায়ীরা আরও সক্রিয় হয়ে উঠবে।