প্রত্যন্ত গ্রামে একাই স্কুলটি চালান আফগান নারী

ফ্রেশতা প্রতিদিন সকালে দুই ঘণ্টা বাচ্চাদের পড়ানছবি: টুইটার

সকাল তখন ছয়টা। আফগানিস্তানের বামিয়ান প্রদেশে নিজের গড়া স্কুলের মেঝে ঝাড়ু দিচ্ছেন ফ্রেশতা। স্কুলের পাশে পাহাড় বেয়ে একদল গাধা পানি খেতে নামছে। পাহাড় কেটে তৈরি গুহার মতো ঘরগুলো থেকে ভেসে আসছে সদ্য ভাজা রুটির গন্ধ। ফ্রেশতা স্কুল খোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। ওই স্কুলে একসঙ্গে ৫০ শিশু পড়তে পারে। স্কুলটিতে যারা পড়ে, তাদের অধিকাংশই মেয়ে। সবাই দরিদ্র পরিবারের সন্তান। এক দশক আগে শুরু ফ্রেশতার স্কুলটিই তাদের একমাত্র ভরসা।

আফগানিস্তানের সবচেয়ে দরিদ্র প্রদেশগুলোর একটি বামিয়ান। বাড়িগুলো দেখলে বোঝা যায়, ফ্রেশতার গ্রামের বাসিন্দারা কতটা দারিদ্র্যপীড়িত। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সেনাদের বিদায়ের মধ্যেই গত বছর দেশটিতে ক্ষমতার পালাবদল ঘটে। তৈরি হয় মানবিক সংকট। বামিয়ানের মানুষ পড়েন সবচেয়ে সংকটে। স্কুলটি এখন ওই গ্রামের মানুষের ‘আশার বাতিঘর’ হয়ে উঠেছে। ফ্রেশতার স্কুলে সন্তানদের পাঠিয়ে স্বপ্ন দেখছেন তাঁরা।

ফ্রেশতার বয়স যখন ১২, তখন এই স্কুল শুরু করেন তিনি। নিজে অন্য গ্রামের স্কুলে পড়ার পাশাপাশি এই স্কুল চালাতেন তিনি। এখন তাঁর বয়স ২২। স্কুলটিতে যারা পড়ে, তাদের বয়স ৪ থেকে ১৭ বছরের মধ্যে। বিভিন্ন গ্রাম থেকে শিশুরা এসে এই স্কুলে পড়ে। ফ্রেশতা প্রতিদিন সকালে দুই ঘণ্টা বাচ্চাদের পড়ান। গত এক দশকে স্কুলটির পরিসরও বেড়েছে।

আমার স্কুলটি ছিল সুন্দর আর রঙিন। কিন্তু যখনই তালেবানেরা আমাদের বামিয়ানের নিয়ন্ত্রণ নিল, তখন খুব ভয় পেয়েছিলাম। তখন আমার বন্ধুরাও পরামর্শ দিয়েছিল যেন দেয়ালের সব পোস্টার নামিয়ে ফেলি। দেয়াললিখন মুছে দিই। তারা ভেবেছিল, আমি বিপদে পড়েছি। তাদের ভয়ের বিশেষ কারণ ছিল। কারণ, আমি তো মেয়েদের পড়াই। তাই আমি সব রং আর কলম প্লাস্টিকের ব্যাগে করে নদীতে ফেলে দিই।
ফ্রেশতা

ফ্রেশতা তাঁর পুরো নাম জানাতে চান না। স্কুল নিয়ে বলেন, ‘গ্রামের মানুষই প্রথম আমাকে গ্রামের শিশুদের পড়ানোর পরামর্শ দেন। বাচ্চাদের ইংরেজি, দারি, গণিত, ভূগোল, পবিত্র কোরআন শেখাতে বলেন। এরপর সময় যত গড়ায়, স্কুলটি ততই বড় হতে থাকে।’

আফগানিস্তানের ক্ষমতায় তালেবানের প্রত্যাবর্তন দেখে শঙ্কিত হয়েছিলেন ফ্রেশতা। এ কথা জানিয়ে তিনি বলেন, ভয়ের যথেষ্ট কারণ ছিল। কারণ ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত তালেবান যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন আফগানিস্তানের নারীদের শিক্ষা গ্রহণ ও চাকরি নিষিদ্ধ করা হয়।

প্রায় দুই দশকের যুদ্ধ শেষে বিদেশি সেনারা আফগানিস্তান ছাড়ায় গত বছর আগস্টে তালেবান আবার রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে। পশ্চিমা–সমর্থিত সরকারের প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনি দেশ ছেড়ে পালান। এরপর আফগানিস্তানে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ তৈরি হয় নারী অধিকার ও নারীর শিক্ষা নিয়ে।

জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বামিয়ান প্রদেশে শিক্ষা তো দূরের কথা, সাক্ষরতার হারও খুবই কম। সেখানকার মেয়েরা, বিশেষত কম বয়সীদের মাত্র ২৫ শতাংশ নিজেদের নাম লিখতে পারেন।

আল-জাজিরার প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপের সময় ফ্রেশতা বলেন, ‘আমার স্কুলটি ছিল সুন্দর আর রঙিন। কিন্তু যখনই তালেবানেরা আমাদের বামিয়ানের নিয়ন্ত্রণ নিল, তখন খুব ভয় পেয়েছিলাম। তখন আমার বন্ধুরাও পরামর্শ দিয়েছিল যেন দেয়ালের সব পোস্টার নামিয়ে ফেলি। দেয়াললিখন মুছে দিই। তারা ভেবেছিল, আমি বিপদে পড়েছি। তাদের ভয়ের বিশেষ কারণ ছিল। কারণ, আমি তো মেয়েদের পড়াই। তাই আমি সব রং আর কলম প্লাস্টিকের ব্যাগে করে নদীতে ফেলে দিই।’

ফ্রেশতা বলেন, ‘তারা (তালেবান) তিনবার এসেছিল। আমার এক প্রতিবেশী পুলিশের হয়ে কাজ করতেন। তাঁকে খুঁজতেই এসেছিল তারা। কিন্তু আমার প্রতিবেশী আগেই পালান। এ নিয়ে আমি খুব ভীত হয়ে পড়ি। তবে তাদের দেখে আমার মনে হয়, তারা আমার স্কুল সম্পর্কে জানতই না।’

স্কুলের একজনই শিক্ষক, ফ্রেশতা। এক দশক ধরে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে শিশুদের পড়াচ্ছেন। এর জন্য কোনো পারিশ্রমিকও নেন না তিনি। মাঝেমধ্যে রাজধানী কাবুল থেকে কেউ ঘুরতে এলে অল্প কিছু সাহায্য করেন। কিন্তু সাহায্যে নয়, স্কুলটি টিকে আছে ফ্রেশতার ঐকান্তিক চেষ্টার ওপর।

আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর শুরু হওয়া সংকট নিয়ে জাতিসংঘ বারবার সতর্ক করে আসছে। সংস্থাটি বলেছে, আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ। অর্থনীতির এমন পরিস্থিতিতে দেশটির অর্ধেক মানুষ চরম খাদ্যসংকট ও অনাহারের ঝুঁকিতে আছেন।

ফ্রেশতার গ্রামের মানুষের আর্থিক অবস্থার বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘এখানকার মানুষ এমনিতেই অনেক অর্থকষ্টে ভোগেন। এসব মানুষ হয় কৃষিকাজ করেন, নয়তো কর্মহীন। সরকারি স্কুলগুলোও এখান থেকে অনেক দূরে। বাচ্চারা সেখানে যেতে পারে না। এ ছাড়া বেসরকারি স্কুলে সন্তানদের পড়ানোর সামর্থ্য এখানকার কোনো পরিবারেরই নেই। তাই স্কুলে বিনা বেতনে শিশুদের পড়াই।’

ফ্রেশতার শিক্ষকতা নিয়ে তাঁর শিক্ষার্থীরাও খুশি। বেশ কিছু শিক্ষার্থীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, বড় হয়ে তারা কী করতে চায়। শিশুদের উত্তর, বড় হয়ে ফ্রেশতার মতোই শিক্ষক হতে চায় তারা।

জাতিসংঘের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বামিয়ান প্রদেশে শিক্ষা তো দূরের কথা, সাক্ষরতার হারও খুবই কম। সেখানকার মেয়েরা, বিশেষত কম বয়সীদের মাত্র ২৫ শতাংশ নিজেদের নাম লিখতে পারেন।

ফ্রেশতা তাঁর গ্রামের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক। সম্প্রতি বামিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিডওয়াইফারির ওপর একটি কোর্স করেছেন। বয়স যখন দুই বছর, তখন তাঁর মা মারা যান। ফ্রেশতার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেছেন। দ্বিতীয় মায়ের সাত সন্তান। ছয়জনই ছেলে। এ ছাড়া ওই মায়ের একটি মেয়েও রয়েছে, যাঁর বয়স ২০ বছর। অবশ্য ইতিমধ্যে বিয়েও হয়ে গেছে তাঁর।

ফ্রেশতা জানান, তাঁর মা ছিলেন রসিক মানুষ। অনর্গল ইংরেজি বলতে পারতেন এবং ইংরেজি শিখতে ভালোবাসতেন। মায়ের প্রসঙ্গে এসব জানিয়ে ফ্রেশতা বলেন, ‘মা সব সময় আমার সঙ্গে আছেন।’

দীর্ঘদিনের যুদ্ধ-সংঘাতের কারণে আফগানিস্তানের অর্থনীতি হয়ে পড়েছিল আন্তর্জাতিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু তালেবান ক্ষমতা দখলের পর থেকে বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সাহায্য বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গোটা আফগানিস্তানের মতো ফ্রেশতার গ্রামের মানুষও সংকটে পড়েন। আয়রোজগার বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়া ফ্রেশতার গ্রামটির বেশির ভাগ মানুষ হাজারা সম্প্রদায়ের। আফগানিস্তানে ঐতিহাসিকভাবে সংখ্যালঘু হাজারারা নির্যাতনের শিকার।

ফ্রেশতার স্কুলে দূরদূরান্তের গ্রাম থেকেও অনেক শিশু আসে। আয়েলা নামের এক নারীর ছেলে পড়ে ওই স্কুলে। বড় হয়ে ছেলে কিছু করবে—এমন আশায় আছেন আয়েলা। তাঁর আশা, ছেলে ফ্রেশতার স্কুলে পড়ে শিক্ষিত হয়ে উঠবে। শিক্ষিত হলে ছেলের সঙ্গে তাঁরও ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।

আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখলের পর শুরু হওয়া সংকট নিয়ে জাতিসংঘ বারবার সতর্ক করে আসছে। সংস্থাটি বলেছে, আফগানিস্তানের মোট জনসংখ্যা ৩ কোটি ৮০ লাখ। অর্থনীতির এমন পরিস্থিতিতে দেশটির অর্ধেক মানুষ চরম খাদ্যসংকট ও অনাহারের ঝুঁকিতে আছেন।

ফ্রেশতা বলেন, বামিয়ানের অনেক মানুষ এখন কর্মহীন। কয়েক মাস ধরে এখানে এটাই সবচেয়ে বড় সংকট। ফ্রেশতা জানান, তাঁর বাবাও তাঁদের পরিবারের জন্য প্রতিদিনকার খাবার জোটাতে পারছেন না। বাবাকে সাহায্য করতে মিডওয়াইফের কাজ খুঁজছেন ফ্রেশতা। এখন নিজের নকশা করা রুমাল স্থানীয় বাজারগুলোয় বিক্রি করে সামান্য যা পান, তা–ই বাবাকে দেন।

ফ্রেশতার স্কুলে দূরদূরান্তের গ্রাম থেকেও অনেক শিশু আসে। আয়েলা নামের এক নারীর ছেলে পড়ে ওই স্কুলে। বড় হয়ে ছেলে কিছু করবে—এমন আশায় আছেন আয়েলা। তাঁর আশা, ছেলে ফ্রেশতার স্কুলে পড়ে শিক্ষিত হয়ে উঠবে। শিক্ষিত হলে ছেলের সঙ্গে তাঁরও ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।

আল-জাজিরার ওই প্রতিনিধির সঙ্গে নিজের গড়া স্কুল নিয়ে গল্প শেষে ফ্রেশতা আবার শিশুদের ইংরেজি ক্লাস নেওয়া শুরু করেন। ফ্রেশতা ইংরেজিতে শিশুদের পড়াতে থাকেন, ‘আমি দৌড়াতে পারি, আমি হাঁটতে পারি, আমি লিখতে পারি, আমি কাজ করতে পারি।’ শিশুরাও তা–ই বলে।