ফিলিস্তিনে ‘গুপ্তহত্যা’ চালাচ্ছে ইসরায়েল
আল-আমারি শরণার্থীশিবিরে ২৪ বছরের আহমেদ ফাহাদের জানাজা চলছিল। এ সময় আহমেদ ফাহাদের মা উম ফাহাদ অঝোরে কাঁদছিলেন। বললেন, ‘নির্মমভাবে আমার ছেলেকে হত্যা করা হয়েছে। হাসিখুশি ছেলেটি ছিল খুবই বন্ধুবৎসল।’ আল বিরেহ মিউনিপ্যালিটিতে কাজ করতেন ফাহাদ। কয়েক সপ্তাহ পরেই তাঁর বিয়ের কথা ছিল।
আল জাজিরার প্রতিবেদনে জানা যায়, আহমেদ ফাহাদের পরিবার বলছে, ইসরায়েলি গুপ্তচরেরা প্রথমে ফাহাদকে আটক করে। ভোর সাড়ে পাঁচটার দিকে তাঁকে বেশ কয়েকবার গুলি করা হয়। ফিলিস্তিনের রামাল্লার কাছে উম আল শরায়েত এলাকায় একটি রাস্তায় গত মঙ্গলবার তাঁর মরদেহ ফেলে যাওয়া হয়।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মুহাম্মদ আল-আওদা কাতারভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল আল–জাজিরাকে বলেন, রামাল্লা হাসপাতালের চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, ফাহাদকে খুব কাছ থেকে কয়েকটি গুলি করা হয়েছে।
আহমেদ ফাহাদের পারিবারিক বন্ধু সাবরিন আবু লিবদেহ আল–জাজিরাকে বলেন, ইসরায়েলের অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা শিন বেত ফোন করে ফাহাদের পরিবারের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তাঁদের ভাষ্য, ফাহাদকে হত্যা করার পরিকল্পনা তাঁদের ছিল না। সন্ত্রাসী কার্যকলাপে জড়িত থাকার অভিযোগে ফাহাদের ভাই ও চাচার বিরুদ্ধে তাঁরা ব্যবস্থা নিতে চেয়েছিলেন। আহমেদ ফাহাদের বোন কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানতে চান, ‘এভাবে ক্ষমা চাওয়ায় তাঁদের কী লাভ হবে? তাঁরা কি আর ভাইকে ফিরে পাবেন?’
‘ফিলিস্তিনিদের গুপ্তহত্যা’
আহমেদ ফাহাদের ঘটনায় ইসরায়েলি বাহিনী ভুল স্বীকার করলেও তা মানতে নারাজ রামাল্লায় নিযুক্ত মানবাধিকার সংস্থা আল-হক। মানবাধিকারকর্মী শাওয়ান জাবারিন বলেন, ‘ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনী ফিলিস্তিনিদের হত্যা করে যাচ্ছে। গুপ্ত সংস্থার পরিচালিত এসব হত্যাকাণ্ড কোনো দুর্ঘটনা নয়।’
জাবারিন আল–জাজিরাকে বলেন, আহমেদ ফাহাদের হত্যা নিয়ে তাঁরা তদন্ত চালাচ্ছেন। তবে নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি মুসতা’রিবিন নামে ইসরায়েলি গুপ্ত সংস্থার সদস্যরা ফিলিস্তিনিদের হত্যা করছেন।
জাবারিন আরও বলেন, প্রতি রাত দুইটার পরে রামাল্লায় ইসরায়েলি সেনারা এসে ধরপাকড় চালায়। তিনি আরও বলেন, ‘গুলি করে হত্যার পরে ইসরায়েলি শিন বেত গোয়েন্দা কর্মকর্তারা পরিবারগুলোকে ফোন করে। যাদের এভাবে হত্যা করা হয়, তাদের বিরুদ্ধে ইসরায়েলি বাহিনীর ওপর সশস্ত্র হামলার অভিযোগ আনা হয়। এটা স্পষ্ট যে প্রতিশোধ নিতেই এ ধরনের হামলা চালানো হয়।’
জাবারিন বলেন, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ফিলিস্তিনিদের হত্যার অনেক ঘটনার তথ্য তাঁর মানবাধিকার সংস্থা আল-হকের কাছে রয়েছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাকে পরিসংখ্যান ও নথিপত্র দিয়ে জানানো হয়েছে, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের ৯৫ শতাংশ অপ্রয়োজনে হয়ে থাকে।
ইসরায়েলের বিশেষ বাহিনী মুসতা’রিবিন সহিংস আচরণের জন্য পরিচিত। ফিলিস্তিনি বিভিন্ন এলাকায় তারা গুপ্তহত্যা চালায়। মুসতা’রিবিনের কমান্ডোরা আরবদের মতো পোশাক পরে। তারা আরবি ভাষায় কথা বলে।
মুসতা’রিবিনের অভিযান
মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক পরামর্শক গ্যারি স্পেডিং বলেন, ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ও সীমান্ত পুলিশ মুসতা’রিবিনকে বিক্ষোভকারীদের চিহ্নিত করে যাকে ইচ্ছা তাকে আটক করার অনুমোদন দিয়েছে।
ইসরায়েলবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যান্টনি শালহাত বলেন, সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে অভিযান ও গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ মুসতা’রিবিনের প্রধান উদ্দেশ্য।
সর্বশেষ সংঘাতে গাজায় মৃত্যু ও ইসরায়েলের দখল করা পূর্ব জেরুজালেমে সহিংসতার প্রতিবাদে বিক্ষোভে অংশ নেওয়া অনেক ফিলিস্তিনিকে মুসতা’রিবিন অভিযান চালিয়ে আটক করে।
দ্য পাবলিক কমিটি এগেইনস্ট টর্চার ইন ইসরায়েল (পিসিএটিআই) বলছে, মুসতা’রিবিনের কর্মকর্তারা রাস্তা থেকে ফিলিস্তিনিদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি শিশুরাও বাদ যাচ্ছে না। যেভাবে ফিলিস্তিনিদের আটক করা হচ্ছে, তা অনেকটা অপহরণের মতো।
বিচার দাবি
ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা বি’সেলেমের প্রতিবেদন বলছে, ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষের সময়ে অথবা আটক করার সময় মে মাসে কমপক্ষে ২৮ জন ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। ফিলিস্তিনিদের হত্যা করার জন্য ইসরায়েলি নিরাপত্তা বাহিনীর কোনো সদস্যকে বিচারের সম্মুখীন করা হয়নি।
২০০০ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইসরায়েলি সেনাদের হাতে ফিলিস্তিনিদের নিহত, আহত ও মারধরের শিকার হওয়ার ৭৩৯টি ঘটনার তদন্ত দাবি করেছে বি’সেলেম। ২০১৬ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত এক–চতুর্থাংশ ঘটনার বিচার হয়নি। অর্ধেক ঘটনার তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
ইসরায়েলি মানবাধিকার সংস্থা ইয়েশ দিন গাজায় ফিলিস্তিনিদের হত্যার ঘটনার তদন্তের জন্য ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর কাছে দাবি জানিয়ে আসছে।