‘বাচ্চাদের জন্য দুধও কিনতে পারছি না’

ইউনিসেফ বলছে, শ্রীলঙ্কায় জ্বালানি ও জরুরি ওষুধও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে
ছবি: এএফপি ফাইল ছবি

রান্না করা ভাত, ডাল আর পালংশাকের সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। উত্তপ্ত হাঁড়ি থেকে বিতরণ করা হচ্ছে সে খাবার। শিশুদের সঙ্গে নিয়ে প্লেট হাতে খাবারের জন্য লাইনে দাঁড়িয়েছে কয়েকটি পরিবার। এগুলোই হয়তো তাদের অনেকের জন্য সারাদিনের একমাত্র আহার।

তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে থাকা শ্রীলঙ্কার একটি লঙ্গরখানার চিত্র এটি। শ্রীলঙ্কার বর্তমান মানবিক পরিস্থিতি নিয়ে বিবিসিতে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সে চিত্র উঠে এসেছে।

খাবার সংগ্রহের জন্য লঙ্গরখানায় লাইনে দাঁড়িয়েছেন চার সন্তানের মা চন্দ্রিকা মানেল। বিবিসিকে তিনি বলেন, ‘আমরা এখানে এসেছি, কারণ, আমরা ক্ষুধার্ত।’

সন্তানের জন্য ডাল আর শাক দিয়ে ভাত মাখাতে মাখাতে চন্দ্রিকা বলেন, রুটি কেনাও এখন যেন এক সংগ্রামের কাজ।’

আগের অবস্থার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘এমন সময় ছিল যখন তাদের দুধ–ভাত খাওয়াতাম। এখন আমরা কোনো শাকসবজিও রান্না করতে পারি না। এগুলোর দাম অনেক বেশি।

উপায় না পেয়ে জীবনে এই প্রথম খাবারের জন্য লঙ্গরখানায় লাইন দিয়েছেন চন্দ্রিকা মানেল। তিনি বলেন, ‘জীবনযাপনের ব্যয় অনেক বেশি, টিকে থাকার জন্য আমরা ঋণ করছি।’

জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফ বলছে, শ্রীলঙ্কা এখন মানবিক সংকটের মুখে আছে। বছরের শুরু থেকে ৭০ শতাংশ পরিবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার খেতে পারছে না। জ্বালানি ও জরুরি ওষুধও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে।

এক মাস হলো লঙ্গরখানাটি চালু হয়েছে। কাঁঠাল খেয়ে তিন দিন কাটিয়ে দেওয়া এক মায়ের সঙ্গে সাক্ষাতের পর পাস্তর মোসেস নামের এক ব্যক্তি এটি চালু করেন। কলম্বোর একটি গির্জার হলে লঙ্গরখানার কার্যক্রম চলছে।

পাস্তর মোসেস বলেন, ‘আমাদের এখানে এমন মানুষেরা আসেন, যাঁরা গত চার মাসে এক প্লেট ভাতও খাওয়ার পর আরেক প্লেট খেতে পারেননি।’

তাঁর হিসাব অনুযায়ী, খাবারের জন্য প্রতিদিন লঙ্গরখানায় লাইনে দাঁড়ানো মানুষের সংখ্যা ৫০ থেকে বেড়ে ২৫০–এর বেশি হয়েছে। শুধু জুন মাসেই শ্রীলঙ্কায় খাবারের দাম ৮০ শতাংশ বেড়েছে।

পাস্তর মোসেস আরও বলেন, শিশুদের বেশির ভাগই অপুষ্টিতে ভুগছে।

৩৪ বছর বয়সী অন্তঃসত্ত্বা নারী সাহনাও (নামের প্রথম অংশ) খাবারের জন্য তিন সন্তানকে নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছেন। আগামী সেপ্টেম্বরে তাঁর সন্তান প্রসব করার কথা। ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন এ নারী বলেন, ‘আমার সন্তানদের অবস্থা করুণ। তারা সব দিক থেকে ভুগছে। আমার বাচ্চাদের জন্য এক প্যাকেট বিস্কুট ও দুধ কেনারও সামর্থ্য নেই।’

সাহনার স্বামী একজন শ্রমিক। সপ্তাহে তাঁর আয় ১০ ডলার। এ দিয়ে গোটা পরিবারের ভরণপোষণ করতে হয় তাঁকে।

দেশের নেতাদের সঙ্গে নিজেদের জীবনযাপনের বৈষম্য নিয়ে প্রশ্ন তোলেন সাহনা। তিনি বলেন, ‘আমাদের নেতারা আনন্দের সঙ্গে উন্নত জীবনযাপন করছেন। তাঁদের সন্তানেরা যদি আনন্দে দিন কাটাতে পারে, তবে আমার সন্তানেরা কেন তা পারবে না?’

আশঙ্কা করা হচ্ছে, যে সময়ে সাহনা সন্তান জন্ম দেবেন, তখন শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ পর্যায়ে পৌঁছাবে। সম্প্রতি কলম্বোর মেয়র বলেছেন, রাজধানী শহরে যে পরিমাণ খাদ্য মজুত আছে, তা দিয়ে শুধু আগামী সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত চলবে।

জ্বালানি ও রান্নার গ্যাসের ঘাটতি ও দৈনিক বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা দিয়েছে। টাটকা খাবার কিনতে পরিবারগুলো ভ্রমণ করতে পারছে না এবং গরম খাবার তৈরি করতে পারছে না।

শ্রীলঙ্কায় নিয়োজিত ইউসিফের প্রতিনিধি ক্রিশ্চিয়ান স্কুগ বলেন, ‘পরিবারগুলো আগে যা কিনত, তা এখন আর তাঁরা কিনতে পারছে না। সুতরাং আমরা নিশ্চিতভাবে এমন এক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ছি যেখানে অপুষ্টিকে বড় ধরনের উদ্বেগ বলে বিবেচনা করা হয়।’

ক্রিশ্চিয়ান স্কুগ আরও বলেন, ‘আমরা মানবিক বিপর্যয় এড়ানোর চেষ্টা করছি। এখন পর্যন্ত আমাদের শিশুরা যে মারা যায়নি, তা সুখবর। তবে এ ধরনের ঘটনা (শিশুমৃত্যু) এড়াতে আমাদের জরুরি ভিত্তিতে প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে।’

প্রচণ্ড রকমে অপুষ্টিতে ভোগা হাজারো শিশুর চিকিৎসার জন্য জরুরি ভিত্তিতে আর্থিক সহায়তা প্রয়োজন।

শ্রীলঙ্কা মেডিকেল নিউট্রিশন অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট ড. রেনুকা জয়াতিসসা বলেন, তীব্রমাত্রার অপুষ্টির হার ১৩ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০ শতাংশ হতে পারে। প্রচণ্ড রকমের অপুষ্ট শিশুর সংখ্যা বেড়ে দ্বিগুণ হতে পারে। বর্তমানে শ্রীলঙ্কায় ৩৫ হাজার শিশু তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে।

কলম্বোর ক্যাসেল স্ট্রিট হাসপাতালের চিকিৎসক সামান কুমারা বলছেন, অনুদান দাতারা এগিয়ে না এলে তাঁর হাসপাতালের নবজাতক রোগীদের জীবন ঝুঁকিতে পড়ে যেত।

সামান বলেন, জরুরি ওষুধ ও যন্ত্রপাতির জন্য তাঁর হাসপাতাল এখন পুরোপুরি অনুদানের ওপর নির্ভরশীল। রোগীদের জীবন ঝুঁকিতে আছে উল্লেখ করে আরও বেশি করে দাতাদের এগিয়ে আসার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন সামান।

বিবিসির প্রতিবেদনটির শুরুতে যে লঙ্গরখানার কথা বলা হয়েছে, সে লঙ্গরখানায় ফিরে যাওয়া যাক আবার।

লঙ্গরখানা থেকে পাওয়া খাবারের শেষ লোকমাটুকু ছেলের মুখে তুলে দিতে দিতে চন্দ্রিকা মানেল বলেন, ‘আমার ভালো দিনগুলো চলে গেছে। তবে আমাদের সন্তানদের সামনে দিন পড়ে আছে। জানি না তারা যখন বড় হবে তখন কী হবে।’