মার্কিন সেনা প্রত্যাহার নিয়ে সমস্যায় ইরাকি প্রধানমন্ত্রী খাদেমি

ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা আল-খাদেমি।
ছবি: রয়টার্স

যুক্তরাষ্ট্র ও ইরাকের মধ্যে কৌশলগত সম্পর্কের প্রশংসা করে বেশ সাবধানী ও নির্বাচিত মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা আল-খাদেমি। কিন্তু গত সোমবার তাঁরা হোয়াইট হাউসে বন্ধ দরজার পেছনে যেসব বিষয় আলোচনা করেছেন, তা এখন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বর্তমানে ইরান-সমর্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর চাপে কোণঠাসা ইরাকি প্রধানমন্ত্রী খাদেমি বড় সমস্যার মুখে পড়তে যাচ্ছেন।

আগামী অক্টোবরে তাঁর দেশে নির্বাচন। একদিকে ইরানপন্থীদের খুশি রাখা ও অন্যদিকে আইএসের হামলা জোরদার হচ্ছে। মার্কিন সেনা প্রত্যাহার নিয়ে আল-খাদেমির রাজনৈতিক অস্তিত্ব ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে।

আরব নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, একদিকে যখন যুক্তরাষ্ট্র ইরাকের সঙ্গে কৌশলগত সংলাপ করছে, অন্যদিকে দেশটির পশ্চিমা মিত্ররা ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক চুক্তি উদ্ধারে ভিয়েনায় বৈঠক চালিয়ে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ওপর চাপ তৈরি করতে ইরাকে প্রক্সি সেনা হিসেবে মিলিশিয়াকে ব্যবহার করছে তেহরান। আল-খাদেমি ইরাককে এ ধরনের বদ্ধ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত করতে চান। প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ইরাকে অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের অবস্থান বদলে সময়সীমা নির্ধারণে প্রতিশ্রুতি আদায়ে সফল হয়েছেন তিনি। কিন্তু ইরান–সমর্থিত নেতা ও মিলিশিয়াদের বাগদাদের রাজনীতিতে নাক গলানো বন্ধ করতে আল-খাদেমিকে কঠিন সময় পার করতে হবে।

আল-খাদেমি জানেন, এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হলে আফগানিস্তানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার সব সেনা সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর গত মে মাসের শুরু থেকে তালেবান আফগান সেনাদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করেছে।

বার্তা সংস্থা রয়টার্স জানায়, জো বাইডেন ও ইরাকি প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা আল-খাদেমি গত সোমবার একটি চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রের সেনারা চলতি বছরের শেষ নাগাদ ইরাক ত্যাগ করবে। তবে ইরাকি সেনাবাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ দেওয়ার কাজ অব্যাহত রাখবে তারা।

আরব নিউজের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, আল-খাদেমি যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সামরিক ও অর্থনৈতিক বন্ধন রক্ষার কঠিন পথেই হাঁটছেন। এর পাশাপাশি তিনি ইরানপন্থী রাজনৈতিক নেতাদের সন্তুষ্ট করার প্রত্যাশাও করছেন। ইরানপন্থী নেতারা চাইছেন মার্কিন সেনারা দ্রুত ইরাক ছেড়ে যাক।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ইরাকের প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা আল-খাদেমি।
ছবি: এএফপি

এর আগে ওয়াশিংটনের উদ্দেশ্যে বাগদাদ ছাড়ার আগে আল-খাদেমি ঘোষণা করেছিলেন, ইরাকে আর মার্কিন সেনা বা জোটের সামরিক ঘাঁটি রাখার প্রয়োজন নেই। এর বদলে তাঁদের প্রয়োজন প্রশিক্ষণ, সমর্থন ও দায়েশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে গোয়েন্দা তথ্য।

সম্প্রতি ইরাকে ইরানপন্থী মিলিশিয়াদের পক্ষ থেকে মার্কিন সেনাদের অবস্থান, বাগদাদে মার্কিন দূতাবাস ও ইরবিলে এর কনস্যুলেট লক্ষ্য করে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা বেড়ে গেছে। এর জবাবে যুক্তরাষ্ট্র মিলিশিয়াদের অবস্থান লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালিয়েছে। এখন আল-খাদেমি তাঁর রাজনৈতিক শত্রু ও তেহরানকে শান্ত করার প্রচেষ্টা হিসেবে বাইডেনকে ইরাক থেকে সেনা সরিয়ে নেওয়ার সময়সীমা নির্ধারণের প্রতিশ্রুতি চাইছেন।

কিন্তু আল-খাদেমি জানেন, এই মুহূর্তে সম্পূর্ণ মার্কিন সেনা প্রত্যাহার করা হলে আফগানিস্তানের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র তার সব সেনা সরিয়ে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর গত মে মাসের শুরু থেকে তালেবান আফগান সেনাদের বিরুদ্ধে অভিযান জোরদার করেছে। একই সঙ্গে বেড়েছে দুই পক্ষের মধ্যে লড়াই এবং সহিংসতা। এরই মধ্যে দেশটির প্রায় ৪০০ জেলার অর্ধেক ও গুরুত্বপূর্ণ বেশ কিছু সীমান্ত-ক্রসিং নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে তালেবান। একজন জ্যেষ্ঠ মার্কিন কর্মকর্তা স্বীকার করেছেন, দেশটির প্রায় অর্ধেক এলাকা এখন তালেবানের নিয়ন্ত্রণে।

আইএসের জঙ্গি হটাতে ইরাকি সেনা ও মিলিশিয়া অভিযান শুরু করে।
ছবি: রয়টার্স

গত বৃহস্পতিবার একটি মার্কিন সরকারি কর্তৃপক্ষের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘অস্তিত্বসংকটে’ পড়েছে আফগান সরকার। ইরাক থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করা হলে সেখানেও একই পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। প্রশ্ন হচ্ছে, ইরাক থেকে মার্কিন সেনা সরে গেলে কে বেশি সুবিধা পাবে?

ইরাকে বর্তমানে প্রায় ২ হাজার ৫০০ মার্কিন সেনা রয়েছেন। তাঁরা জঙ্গিগোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটকে (আইএস) মোকাবিলায় স্থানীয় বাহিনীগুলোকে সহায়তা করছেন। ২০১৭ সালে আইএসের পরাজয়ের পর থেকে এ জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যরা সিরিয়া-ইরাক সীমান্তে আবার জড়ো হওয়ার চেষ্টা করছে। ইরাকি সেনা কর্মকর্তা ও বেসামরিক লোকজনকে লক্ষ্য করে গত সপ্তাহে সদর সিটিতে তারা আত্মঘাতী বোমা হামলা চালিয়েছে। এতে ৩৫ জন নিহত হন।

ইরাকে শিয়া যোদ্ধারা আইএস লক্ষ্য করে গতমাসে রকেট হামলা চালায়
ছবি : রয়টার্স

বাইডেন ও তাঁর মিত্রদের ইরাক নিয়ে গৃহীত পদক্ষেপের সমালোচনা করছেন রিপাবলিকানরা। তাঁরা ইরাকে মার্কিন সেনা সীমিত করার বাইডেনের সিদ্ধান্তকে ইরানের জয় বলে উল্লেখ করছেন। অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের আরব মিত্ররা বাগদাদকে তাদের দিকে টানতে চাইছে।

ইতিমধ্যে জর্ডান ও মিসর আল-খাদেমির অধীনে ইরাকের একটি জোটে যুক্ত হয়েছে যাঁকে তিনি ‘নিউ লেভান্ত’ বলে মন্তব্য করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি একটি অর্থনৈতিক এলাকা গড়ে তুলতে চান, যাতে ভবিষ্যতে সিরিয়াকেও যুক্ত করা হবে। সৌদি বাদশা আবদুল্লাহ সম্প্রতি ওয়াশিংটন সফরে ইরান থেকে দূরে থাকতে আল-খাদেমির প্রচেষ্টাকে সমর্থন দিতে বাইডেনকে অনুরোধ জানান।

বাইডেনের কাছ থেকে খাদেমি প্রতিশ্রুতি পেলেও এখন তাঁকে কুর্দি সহযোগীদের সঙ্গে চুক্তি করতে হবে। স্বায়ত্তশাসিত কুর্দিস্তান অঞ্চলের কর্মকর্তারা মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের বিরোধিতা করছেন। তাঁরা মনে করছেন, যেহেতু দেশটি রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল নয়, তাই ইরাকি সেনারা আইএসের সঙ্গে লড়াইয়ে পেরে উঠবে না।

সোমবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ইরাকি প্রধানমন্ত্রী মুস্তাফা আল-খাদেমির বৈঠক হয়।
ছবি: এএফপি

আল-খাদেমি বাইডেনের প্রতিশ্রুতি আদায় করতে পারলেও আগামী অক্টোবর মাসের নির্বাচনে তিনি ক্ষমতায় ফিরবেন কি না, তার নিশ্চয়তা নেই। জনপ্রিয় শিয়া ধর্মীয় নেতা মোকতাদা আল-সদর গত সপ্তাহে ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি নির্বাচনে লড়বেন না বা কাউকে সমর্থন দেবেন না। এতে আল-খাদেমির নির্বাচিত হওয়ার বিষয়ে কী ধরনের প্রভাব পড়ে, তা দেখার বিষয়। অন্যদিকে ইরাক প্রতিনিয়ত নানা সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। দেশটিতে ইরানবিরোধী সংস্কারক ও কর্মীদের হত্যাসহ, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, পানির স্বল্পতা, বেকারত্ব, দুর্নীতির পাশাপাশি করোনাভাইরাসের প্রকোপ বেড়ে গেছে।

ইরাকের উত্তরণের পথ দীর্ঘ হতে পারে। তবে আসন্ন নির্বাচনকে এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, ‘আগামী অক্টোবরে আমরা ইরাকে নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে রয়েছি।’

ওয়াশিংটনে আল-খাদেমির প্রতীকী জয় হলেও তাঁর সামনে যেসব বাধা আছে, তা দূর করা কঠিন প্রমাণিত হতে পারে।