‘পড়তে না পারলে মনে হয় দম বন্ধ হয়ে আসছে’

পড়াশোনা করছে আফগান শিক্ষার্থী (ফাইল ছবি)
ছবি: রয়টার্স

আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখল করে নেওয়ার পর থেকে স্কুলে যেতে পারছে না মাধ্যমিক পর্যায়ের মেয়ে শিক্ষার্থীরা। তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে ঘরোয়া কাজ করেই দিন কাটছে তাদের। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাদাখশান প্রদেশের ১৫ বছর বয়সী কিশোরী মিনা তেমনই এক শিক্ষার্থী। বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজের কষ্টকর অনুভূতি প্রকাশ করে সে বলেছে, ‘লেখাপড়া না করতে পারলে মনে হয় দম বন্ধ হয়ে আসছে।’

মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ বাড়িতে বসে পড়াশোনা করছেন (ফাইল ছবি)
ছবি: রয়টার্স

সম্প্রতি আফগানিস্তানের ১৩টি প্রদেশের বিভিন্ন স্কুলের শিক্ষার্থী ও প্রধান শিক্ষকদের সাক্ষাৎকার নিয়েছে বিবিসি। এসব সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে স্কুলে যেতে না পারা শিক্ষার্থীদের মনোবেদনার কথা। তালেবানের পক্ষ থেকে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, খুব দ্রুতই শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শুরু করতে পারবে। তবে সে আশ্বাসের পর এখনো মেয়েদের জন্য মাধ্যমিক স্কুলে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা থাকায় হতাশ শিক্ষার্থীরা। গত সেপ্টেম্বরে মাধ্যমিক পর্যায়ের ছেলেশিক্ষার্থীদের স্কুলে ফেরত যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে তালেবান সরকার। তবে মেয়েশিক্ষার্থীদের কথা উল্লেখ করেনি তারা। এখন শুধু প্রাথমিক পর্যায়ের স্কুলগুলোতেই পড়তে পারছে মেয়েশিশুরা।

তাখার প্রদেশের ১৬ বছর বয়সী স্কুলশিক্ষার্থী লায়লা। গত আগস্টে তালেবান ক্ষমতা দখল করার পর থেকে তার স্কুল বন্ধ রয়েছে। বিবিসিকে সে বলেছে, ‘ঘরোয়া কাজ ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার নেই। এক জায়গার মধ্যেই আটকে আছি আমরা।’

পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতি আট প্রদেশের মধ্যে সাতটিতে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুল বন্ধ রাখা হয়েছে। প্রাথমিক স্কুলেও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির হার ক্রমাগত কমতে দেখা গেছে। তালেবান সরকার একে সরাসরি নিষেধাজ্ঞা বলতে রাজি নয়। তবে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ভারপ্রাপ্ত শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুল হাকিম হেমাত বলেন, নতুন শিক্ষা নীতিমালা না হওয়া পর্যন্ত মাধ্যমিক পর্যায়ের মেয়েশিক্ষার্থীদের স্কুলে যেতে দেওয়া হবে না। নতুন বছরে নতুন শিক্ষা নীতিমালা অনুমোদন করা হবে।

শিক্ষকদের অভিযোগ, স্কুল বন্ধ থাকার কারণে মেয়েশিক্ষার্থীরা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। এক শিক্ষক বলেছেন, স্কুল বন্ধ থাকার কারণে তাঁর তিন শিক্ষার্থীর বাল্যবিবাহ হয়েছে।
কাবুলের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক হোয়াটসঅ্যাপে তাঁর শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখেছেন। ওই শিক্ষক বিবিসিকে বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা আসলেই হতাশ। তারা মানসিক যন্ত্রণায় ভুগছে। আমি তাদের আশার আলো দেখানোর চেষ্টা করি। কিন্তু তারা যতটা কষ্ট আর হতাশার মধ্যে আছে, সেখানে তাদের আশাবাদী করে তোলার কাজটি কঠিন।’

শিক্ষকেরা বলছেন, প্রাথমিক পর্যায়েও শিক্ষার্থী উপস্থিতি কমতে দেখা গেছে। দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ায় এবং নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগে পরিবারগুলো মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে আগ্রহ বোধ করছে না।

তবে এত কিছুর পরও স্থানীয় তালেবান কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলোচনার পর সাতটি প্রদেশে কিছু বালিকা বিদ্যালয় আবারও চালু করার খবর পাওয়া গেছে। বালখ প্রদেশের উত্তরাঞ্চলীয় শহর মাজার-ই-শরিফের একটি স্কুলের প্রধান শিক্ষক বলেছেন, কোনো সমস্যা ছাড়াই তাঁর স্কুলে মেয়েশিক্ষার্থীরা উপস্থিত হতে পারছে।

তবে একই শহরের এক স্কুলশিক্ষার্থী বিবিসিকে বলেছে, মেয়েশিক্ষার্থীদের পথ আগলে দাঁড়ায় তালেবান সদস্যরা। শিক্ষার্থীরা পর্দা করছে কি না, মুখ ও চুল ঢেকেছে কি না, তা নিশ্চিত করতে থাকে তারা। এ কারণে তার ক্লাসের এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে।

তিনটি ভিন্ন ভিন্ন প্রদেশের স্কুলের প্রধান শিক্ষকেরা বিবিসিকে বলেছেন, তাঁরা স্কুলগুলো পুনরায় সচল করেছিলেন। তবে স্থানীয় কর্মকর্তাদের নির্দেশে এক দিনের মাথায় তা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। এ ব্যাপারে ওই কর্মকর্তারা কোনো ব্যাখ্যাও দেননি। মেয়েরা এখন প্রতিদিন স্কুলফটকের সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। শিক্ষকদের কাছে জানতে চায়, কবে থেকে তাদের আবারও স্কুলে ঢুকতে দেওয়া হবে।

শিক্ষার্থী লায়লা ধাত্রী অথবা চিকিৎসক হতে চায়। স্কুলে নিয়ে যাওয়ার জিনিসগুলো পরিষ্কার করে নিজের রুমে সাজিয়ে রেখেছে সে। কাউকে তা ধরতে দেয় না। আবার কবে স্কুলে যেতে পারবে, অপেক্ষায় আছে সে।

শল্য চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল মিনা। তবে শেষ পর্যন্ত পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবে কি না, তা নিয়ে সন্দিহান সে। এরপরও স্কুলে ফেরার স্বপ্ন দেখে মিনা। তার চোখের সামনে এখন শুধু ভেসে ওঠে স্কুলের মাঠ, যেখানে বন্ধুরা মিলে হাসাহাসি করছে, গাইছে জাতীয় সংগীত।