শ্রীলঙ্কায় কেন এত ‘নেই নেই’

জ্বালানির জন্য লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে মানুষরয়টার্স ফাইল ছবি

কয়েক দিন ধরেই আলোচনায় শ্রীলঙ্কার চরম আর্থিক দুর্দশা। দেশটিতে বৈদেশিক রিজার্ভ নেই, ডিজেল, বিদ্যুৎ আমদানির জন্য সরকারের কাছে অর্থ নেই। বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট এত বেশি যে শ্রীলঙ্কার মানুষকে এখন দিনের অর্ধেকের বেশি সময় থাকতে হচ্ছে অন্ধকারে। রাস্তায় চলছে না বাস, গাড়ি। ঘরে বসে অফিস করতে হচ্ছে। কাগজের অভাবে পত্রিকা নেই। আটকে গেছে শিক্ষার্থীদের পরীক্ষা। চারদিকে এত ‘নেই নেই’–এর মধ্যে মানুষের ক্ষোভও উঠেছে চরমে।

এই ক্ষোভেরই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে গত বৃহস্পতিবার। ওই দিন দেশটির প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের বাড়িতে বিক্ষোভকারীরা ঢোকার চেষ্টা করেছেন। রাজাপক্ষে ও ক্ষমতায় থাকা তাঁর পরিবারের সদস্যদের পদত্যাগ দাবি করেছেন। সামরিক যানে অগ্নিসংযোগ করেছেন। বিক্ষোভকারী ও নিরাপত্তাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষ হয়েছে। আর কঠোর নিয়মকানুন জারি করে এই বিক্ষোভ দমানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন রাজাপক্ষে।

আরও পড়ুন

শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থার পাশাপাশি স্থানীয় সময় গতকাল শনিবার ভোর থেকে ৩৬ ঘণ্টার কারফিউ ঘোষণা করা হয়েছে। রাজাপক্ষে রাস্তায়, পার্কে, ট্রেনে, সাগরসৈকতে সরকারের লিখিত অনুমতি ছাড়া কারও বের হওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের কাছ থেকে মুঠোফোন ব্যবহারকারীরা বার্তা পেয়েছেন যে হোয়াটসঅ্যাপ কাজ করছে না।

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়ে রাজাপক্ষের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ
রয়টার্স ফাইল ছবি

প্রেসিডেন্টের বাড়ির সামনের ওই বিক্ষোভের পর গত শুক্রবার ৫৩ বিক্ষোভকারীকে আটক করা হয়েছে। স্থানীয় গণমাধ্যমের খবর বলছে, পাঁচজন আলোকচিত্রীকে আটক করে থানায় নির্যাতন করা হয়েছে। সরকার বলছে, তারা এই অভিযোগের তদন্ত করবে।
জনরোষ সামাল দিতে এমন দমন–পীড়নের পথ বেছে নেওয়ায় প্রশ্নের মুখে পড়েছেন রাজাপক্ষে। বিবিসির এক প্রতিবেদনে শ্রীলঙ্কায় কেন জরুরি অবস্থা জারি করা হলো, তার কারণ খোঁজা হয়েছে।

জরুরি আইন কেন জারি হলো

শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে কঠোর আইনগুলোর মধ্যে একটি হলো জরুরি আইন। হুমকি-ধমকি, বিপদ বা দুর্যোগের সময় এ ধরনের আইন পাস করা হয়।

২০১৯ সালে ইস্টার সানডেতে মারাত্মক বোমা হামলার পর শ্রীলঙ্কায় জরুরি অবস্থার আহ্বান জানানো হয়। এ আইনে কোনো অভিযোগ বা অপরাধের প্রমাণ ছাড়াই মানুষকে আটক করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া এই আইনে চলাফেরা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার মতো মৌলিক অধিকারগুলো সীমিত করা হয়েছে।এই আইনে পরোয়ানা ছাড়াই মানুষকে আটক করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার সরকার জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাধ্যমে বিক্ষোভকারীদের নিষ্ঠুরভাবে দমন করতে চাইছে।

ইস্টার সানডেতে শ্রীলঙ্কায় ভয়াবহ বোমা হামলায় বহু লোক হতাহত হয়
রয়টার্স ফাইল ছবি

জরুরি আইন প্রয়োগ নিয়ে আদালতে কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যায় না। যদিও জরুরি আইন ঘোষণার ১৪ দিনের মধ্যে পার্লামেন্টে এর অনুমোদন দেওয়া প্রয়োজন।
পার্লামেন্টে জরুরি আইন পাসের জন্য সরকারি দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে। এরপর মাসিক ভিত্তিতে জরুরি আইনের মেয়াদ বাড়ানোর প্রয়োজন হতে পারে।

প্রেসিডেন্ট রাজাপক্ষে অবশ্য বলেছেন, জননিরাপত্তা, জনগণের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, সরবরাহ ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতেই জরুরি অবস্থা জারির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় আসেন রাজাপক্ষে। সে সময় শক্ত হাতে দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। তবে এসব বিক্ষোভ প্রমাণ করেছে যে রাজাপক্ষের জনপ্রিয়তায় ধস নেমেছে। আর এর মূল কারণ দেশটির অর্থনৈতিক দুর্দশা। ইকোনমিক টাইমসের এক প্রতিবেদনে কয়েকজন বিশ্লেষক শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দুর্দশার কারণ বিভিন্নভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

আরও পড়ুন

কেন এই অর্থনৈতিক দুর্দশা

ব্যক্তিমালিকানাধীন থিঙ্কট্যাংক লার্ন এশিয়ার সভাপতি রোহন সমরজিভা বলেন, ২০০৭ সাল থেকে রাজস্ব আসে না এমন প্রকল্পে শ্রীলঙ্কা বাণিজ্যিক ঋণ নিয়েছে। ২০১৯ সালে করবিরতির কারণে এই সংকট আরও বেড়ে যায়। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশটির অর্থনীতি অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। কোনো সরকারই এ ব্যাপারে তাগিদ দেয়নি। গত দুই বছরে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব কমে যাওয়ায় ঋণের বোঝা বেড়েছে। আর এই রাজস্ব কমানো অনেকটাই সরকারের স্ব–আরোপিত।

মহামারির প্রাক্কালে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ বলেছে, ইস্টার সানডেতে সন্ত্রাসী হামলা এবং ২০১৯ সালের শেষ দিকে বড় আকারে কর কমানোর নীতির কারণে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল।

আরও পড়ুন

বৈশ্বিক সূচক সংস্থা মুডির ইনভেস্টর সার্ভিস বলছে, পর্যটন খাতের পুনরুদ্ধারে দেরি করায় শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গত বছরের নভেম্বর মাসের হিসাব বলছে, দেশটিতে ১০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক রিজার্ভ রয়েছে, যা দিয়ে এক মাসের কম সময়ের আমদানি বাণিজ্য চালানো সম্ভব।

২০০৭ সাল থেকে রাজস্ব আসে না এমন প্রকল্পে শ্রীলঙ্কা বাণিজ্যিক ঋণ নিয়েছে। ২০১৯ সালে করবিরতির কারণে এই সংকট আরও বেড়ে যায়। স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত দেশটির অর্থনীতি অস্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। কোনো সরকারই এ ব্যাপারে তাগিদ দেয়নি। গত দুই বছরে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব কমে যাওয়ায় ঋণের বোঝা বেড়েছে। আর এই রাজস্ব কমানো অনেকটাই সরকারের স্ব–আরোপিত
ব্যক্তিমালিকানাধীন থিঙ্কট্যাংক লার্ন এশিয়ার সভাপতি রোহন সমরজিভা বলেন

সেন্ট্রাল ব্যাংক আভাস দিয়েছে, পিপলস ব্যাংক অফ চীনের সঙ্গে চুক্তির পর ডিসেম্বরের শেষ দিকে রিজার্ভ বেড়ে ১৫০ কোটি বিলিয়ন ডলারে পৌঁছায়। চীনের সঙ্গে চুক্তির পরও রিজার্ভ খুবই দুর্বল অবস্থায় থেকে গেছে।

ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের ইনস্টিটিউট অব সাউথ এশিয়ান স্টাডিজের সিনিয়র ফেলো গনেশান উইগনারজা বলেন, ২০০০ সালের শুরু থেকে শ্রীলঙ্কার অবকাঠামোগত বিভিন্ন প্রকল্পে বাণিজ্যিক ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে শীর্ষে চীনের অবস্থান। অভিযোগ রয়েছে, এ ধরনের ঋণ নেওয়ার কারণে শ্রীলঙ্কা ঋণের ফাঁদে আটকা পড়েছে। তবে এই ঋণের ফাঁদের জন্য কেবল চীন দায়ী নয়। শ্রীলঙ্কার প্রায় অর্ধেক বিদেশি ঋণ পুঁজিবাজারের কাছে পাওনা ছিল। আর গত বছরের এপ্রিল মাসে চীনের কাছে পাওনা ছিল মাত্র ১০ শতাংশ।

তবে সমরজিভের মতো কয়েকজন বিশেষজ্ঞ বলছেন, চীনের ঋণ সস্তা নয়। ঋণের মোট মজুতের ১০ থেকে ১৫ শতাংশের জন্য চীন দায়ী। তিনি বলেন, চীনের এ ধরনের ঋণ সরকার অরাজস্বখাতমূলক প্রকল্পে ব্যবহার করেছে।

বাঁচার উপায়

প্রবৃদ্ধি পুনরুদ্ধারের জন্য শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক দলগুলোকে দুই বছরের পুনরুদ্ধার পরিকল্পনা প্রণয়নে এগিয়ে আসতে আহ্বান জানানো হয়েছে। ভারতও উল্লেখযোগ্য মানবিক সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছে। সম্ভাব্য ঋণসহায়তা কর্মসূচি নিয়ে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে আবার আলোচনা শুরু করতে পারে আইএমএফ। এ মাসেই শ্রীলঙ্কার অর্থমন্ত্রীর ওয়াশিংটন সফরের সময় এই আলোচনা হতে পারে।

বিবিসি, ইকোনমিক টাইমস, ডেইলি মিরর অনলাইন অবলম্বনে শুভা জিনিয়া চৌধুরী