বই পর্যালোচনা
রিগ্যান থেকে ট্রাম্প: যুক্তরাষ্ট্রের পতন ও চীনের উত্থানের গল্প
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তির জয়ের মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বের দুই পরাশক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। তবে ১৯৯১ সালে সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের পর থেকে যুক্তরাষ্ট্রই বিশ্বের এক নম্বর শক্তি। কিন্তু তাদের সেই স্থান দখল করতে যাচ্ছে চীন। সিঙ্গাপুরের সাবেক কূটনীতিক, শিক্ষাবিদ এবং ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ কিশোর মাহবুবানি ‘দ্য এশিয়ান টুয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ বইয়ে বিশ্বশক্তি হিসেবে ওয়াশিংটনের পতন এবং বেইজিংয়ের উত্থানের গল্প বলেছেন। সেই বই নিয়ে আমাদের এই পর্যালোচনা।
চলতি শতাব্দীর শুরুটা কেমন ছিল, তা গভীরভাবে ভাবলে আমাদের অনেকের মনে হয়তো ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর টুইন টাওয়ারে হামলার কথা মনে পড়ে। কিন্তু ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর নীরবে আরেকটি ঘটনা ঘটেছিল, যার ফলাফলকে ভূরাজনীতির অনেক বিশেষজ্ঞ নাইন–ইলেভেনের হামলার ঘটনার চেয়েও বেশি সুদূরপ্রসারী বলে মনে করেন। তা হলো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় (ডব্লিউটিও) চীনের পদার্পণ।
অবশ্য ডব্লিউটিওর সদস্য হওয়ার আগে থেকে কিছুটা বড় পরিসরে চীনের অর্থনীতি আন্তর্জাতিক পরিসরে উন্মুক্ত হতে শুরু করেছিল। আন্তর্জাতিক সংস্থাটির সদস্য হওয়ায় তাতে রীতিমতো হাইপারসনিক গতি যুক্ত হয়। ২০২০ সাল পর্যন্ত পূর্ববর্তী ৪০ বছরে দেশটির প্রায় ৮০ কোটি মানুষ দারিদ্র্য থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উঠে আসে।
এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে বিশ্বের বৃহত্তম মধ্যবিত্ত শ্রেণির দেশে পরিণত হয়েছে কমিউনিস্ট (সিপিসি) শাসিত চীন। এই বিপুলসংখ্যক মধ্যবিত্ত শ্রেণির ভোক্তা গোষ্ঠী নিয়ে দেশটির খুচরা বাজার যুক্তরাষ্ট্রকে ছাড়িয়ে গেছে। এই সুবিশাল ভোক্তা গোষ্ঠীই চীনের অর্থনীতির প্রাণভোমরা।
তবে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) হিসাবে চীনের অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রের তুলনায় এখনো ছোট। ২০২৪ সালে চীনের মোট জিডিপি (নমিনাল) ছিল ১৮ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার। একই বছর যুক্তরাষ্ট্রের মোট জিডিপি ছিল ২৯ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার। কিন্তু বর্তমানে যে গতিতে বেইজিংয়ের অর্থনীতি সম্প্রসারিত হচ্ছে, তাতে আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের মধ্যে মার্কিন অর্থনীতিকে টপকে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনীতি হয়ে যেতে পারে চীন।
মার্কিন রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ফ্রান্সিস ফুকুয়ামা ১৯৯২ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘দ্য এন্ড অব হিস্টোরি অ্যান্ড দ্য লাস্ট ম্যান’ বইয়ে একটি বাঁক পরিবর্তনকারী সিদ্ধান্তে পৌঁছান। তিনি দাবি করেন, সোভিয়েত রাশিয়ার বিলুপ্তি এবং স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের মধ্য দিয়ে পশ্চিমা সভ্যতা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের শেষ ধাপে পৌঁছেছে। তাই পশ্চিমা সমাজের নতুন বিশ্বের সঙ্গে বড় ধরনের কাঠামো ও কৌশলগত বোঝাপড়া করার কোনো দরকার নেই; বরং পশ্চিমা বিশ্বের বাইরের সমাজকেই প্রতিনিয়ত সমন্বয় ও সমঝোতা করতে হবে।
কিন্তু এই ‘একগুঁয়ে’ ও ‘দাম্ভিক’ সিদ্ধান্ত পশ্চিমাদের পতন ডেকে আনে। পশ্চিমাদের আত্মতুষ্টির ‘মহাঘুমের’ এই কালে চীন ও ভারত ধীরে ধীরে জেগে উঠছে। পুরোনো এই দুই শক্তি চলে আসতে শুরু করছে বিশ্বমঞ্চের কেন্দ্রে।
‘যুক্তরাষ্ট্র কতটা দক্ষতার সঙ্গে বিশ্ববাসীর মধ্যে কিছু প্রয়োজনীয় ধারণ তৈরি করতে পারছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। ধারণাগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি দেশ, যেটি জানে তার কী দরকার, যে নিজের সমস্যাগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করতে এবং বিশ্বশক্তি হিসেবে অর্পিত দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করতে পারছে। যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি দেশ, যার এমন একটি “আধ্যাত্মিক জীবনীশক্তি” রয়েছে, যার মাধ্যমে দেশটি সমসাময়িক প্রধান মতাদর্শগুলোর মধ্যে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারছে।’যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কূটনীতিক জর্জ কেনান (১৯০৪-২০০৫)
সিঙ্গাপুরের বিশিষ্ট কূটনীতিক ও ভূরাজনৈতিক বিশেষজ্ঞ কিশোর মাহবুবানির ‘দ্য এশিয়ান টুয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ বইয়ের পাতায় পাতায় এ রকম তথ্য-উপাত্তের অনেক সরস বিশ্লেষণ দেখা যায়। তাঁর মতে, চলতি শতাব্দী এশিয়ার। এশিয়ার নেতৃত্বেই আগামী ১০০ বছর বিশ্ব, বিশেষ করে বিশ্ব অর্থনীতি পরিচালিত হবে।
চীন হবে এই বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান চালক। ভারত হবে দ্বিতীয় প্রধান নিয়ামক। কোয়াডের মতো সামরিক কোনো জোট নয়, বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় আঞ্চলিক জোট (আসিয়ান) এবং প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিস্তৃত ও প্রগতিশীল অংশীদারত্ব চুক্তির (সিপিটিপিপি) মতো অর্থনৈতিক জোট হবে নতুন শতাব্দীর গুরুত্বপূর্ণ নির্ধারক শক্তি।
চীনে ২০২০ সাল পর্যন্ত পূর্ববর্তী ৪০ বছরে প্রায় ৮০ কোটি মানুষ দারিদ্র্য থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণিতে উঠে এসেছে।
২০২১ সালে সিঙ্গাপুরের প্রকাশনা সংস্থা ‘স্প্রিঙ্গার নেচার’ থেকে প্রকাশিত মাহবুবানির কিছু ছোট-বড় প্রবন্ধ ও সাক্ষাৎকারের সংকলন ‘দ্য এশিয়ান টুয়েন্টি-ফার্স্ট সেঞ্চুরি’ বইয়ে তাঁর একটি প্রধান অনুসিদ্ধান্ত হলো: চলতি শতাব্দীর অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির নেতৃত্ব এশিয়ার হাতে, এর ব্যত্যয় হওয়ার তেমন একটা সুযোগ নেই। তাই পুরো বিশ্বের কল্যাণের কথা চিন্তা করে পশ্চিমাদের এই বাস্তবতা মেনে নেওয়াই শ্রেয়। ‘হ্যাজ দ্য ওয়েস্ট লস্ট ইট?’ কিংবা ‘হ্যাজ চায়না ওআন?’ বইয়ে মাহবুবানি নিজের ধারণাগুলোর আরও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।
গত বছর প্রকাশিত মাহবুবানির আত্মজীবনী ‘লিভিং দ্য এশিয়ান সেঞ্চুরি: অ্যান আনডিপ্লোমেটিক মেমোয়ার’ প্রকাশিত হয়েছে। ১৯৪৮ সালের ২৪ অক্টোবর সিঙ্গাপুরে একটি অভিবাসী সিন্ধিভাষী হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। নিজের আত্মজীবনীতে শৈশব-কৈশোরের দারিদ্র্যের বেড়াজাল ছিন্ন করে কীভাবে দেশ-বিদেশের অভিজাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, তাঁর জীবনের সঙ্গে এশিয়ার উত্থান-পতন কীভাবে যুক্ত, সেসবের মুগ্ধকর বর্ণনা দিয়েছেন মাহবুবানি।
মাহবুবানির মতে, খ্রিষ্টাব্দ ১ থেকে ১৮২০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতিগুলো ছিল এশিয়ায়—কখনো চীন, কখনো ভারত। কিন্তু ঘটনাক্রমে পরবর্তী ২০০ বছরের নেতৃত্ব পশ্চিমাদের হাতে চলে যায়। নেতৃত্ব পেয়ে পশ্চিমারা চীন ও ভারতের মতো কয়েক হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতার ওপর ছড়ি ঘুরিয়েছে, বিভিন্নভাবে তাদের অপমানিত করেছে। সুখবর হলো, এই দিন শেষ হতে চলেছে।
পশ্চিমাদের নেতৃত্ব কীভাবে অস্তগামী হতে চলেছে, তার প্রাঞ্জল বর্ণনা দেওয়ার পাশাপাশি গত ২০০ বছরে কতটা চমকপ্রদভাবে তারা উন্নতির শিখরে পৌঁছেছিল, সেটারও হৃদয়গ্রাহী বর্ণনা দিয়েছেন মাহবুবানি। তিনি বলেন, ১৭৭৬ সালে স্বাধীনতা ঘোষণার পর গত আড়াই শ বছরে অর্থনীতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে বিস্ময়কর সাফল্য দেখিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। মানব জাতির ইতিহাসে এমনটি আর কখনো দেখা যায়নি।
‘নিজ দেশের ধনী-গরিব বৈষম্য, দেশে দেশে সামরিক অভিযান ও যুদ্ধ বা সরকার পতনের নেতৃত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জাতি হিসেবে আধ্যাত্মিক সংকটের মুখে পড়েছে।’কিশোর মাহবুবানি, সিঙ্গাপুরের সাবেক কূটনীতিক
পশ্চিমাদের দান
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাকে ঘিরে নিয়মনীতি-ভিত্তিক যে বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল, সেটার প্রায় সবকিছু পশ্চিমা সভ্যতার দান—এ কথা অকুণ্ঠচিত্তে স্বীকার করেন মাহবুবানি। তিনি মনে করেন, পশ্চিমাদের এসব প্রতিষ্ঠানের কারণেই মানব জাতি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ থেকে রক্ষা পেয়েছে।
তবে নিজেদের অসংগতি, দ্বিচারিতা ও কপটতা উন্মোচনে পশ্চিমা পণ্ডিত ও সংবাদমাধ্যমগুলো যেভাবে ব্যর্থ হয়েছে, তা ভয়ংকর বলে মনে করেন ২০০১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০০২ সালের মে মাস পর্যন্ত জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভাপতির দায়িত্ব পালনকারী সিঙ্গাপুরের সাবেক এই কূটনীতিক।
তবে জর্জ এফ কেনান ও হেনরি কিসিঞ্জারের মতো প্রয়াত ঝানু মার্কিন কূটনীতিক এবং জন এফ কেনেডি ও বিল ক্লিনটনের মতো প্রেসিডেন্টের প্রশংসা করে থাকেন মাহবুবানি। আলোচ্য বইটির অসংখ্য জায়গায় তিনি বলেছেন, সোভিয়েত রাশিয়াকে বন্দুকের একটি দানাও খরচ না করে ভেঙে দেওয়ার বড় কৃতিত্ব জর্জ কেনানের। কারণ, সোভিয়েত রাশিয়াকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়নে ওয়াশিংটনকে তিনিই সবচেয়ে বেশি সহযোগিতা করেছিলেন।
জর্জ কেনান (১৯০৪-২০০৫) ১৯৪৭ সালে তাঁর ‘দ্য সোর্সেস অব সোভিয়েট কন্ডাক্ট’ প্রবন্ধে লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র কতটা দক্ষতার সঙ্গে বিশ্ববাসীর মধ্যে কিছু প্রয়োজনীয় ধারণা তৈরি করতে পারছে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। ধারণাগুলো হলো, যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি দেশ, যেটি জানে তার কী দরকার, যে নিজের সমস্যাগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করতে এবং বিশ্বশক্তি হিসেবে অর্পিত দায়িত্বগুলো যথাযথভাবে পালন করতে পারছে। যুক্তরাষ্ট্র এমন একটি দেশ, যার এমন একটি “আধ্যাত্মিক জীবনীশক্তি” রয়েছে, যার মাধ্যমে দেশটি সমসাময়িক প্রধান মতাদর্শগুলোর মধ্যে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে পারছে।’
‘আধ্যাত্মিক সংকটে’ পশ্চিমা বিশ্ব
মাহবুবানির মতে, জর্জ কেনান ‘আধ্যাত্মিক জীবনীশক্তি’ বলতে মার্কিন নাগরিকদের ধর্মভাবকে বোঝাননি; বরং তিনি দেশটির সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিক সামর্থ্যের কথা বুঝিয়েছেন।
মাহবুবানি মনে করেন, নিজ দেশের ধনী-গরিব বৈষম্য, দেশে দেশে সামরিক অভিযান ও যুদ্ধ বা সরকার পতনের নেতৃত্ব দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র জাতি হিসেবে আধ্যাত্মিক সংকটের মুখে পড়েছে।
এই কূটনীতিকের ধারণা, কেনান জীবিত থাকলে টুইন টাওয়ারে হামলার প্রতিক্রিয়ায় মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ৫ লাখ কোটি ডলার যুদ্ধের বিরোধিতা করতেন। এর বদলে এই অর্থ মার্কিন নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়নে ব্যয়ের পরামর্শ দিতেন। এমনকি মৃত্যুর দুই বছর আগে ২০০৩ সালে ইরাকে হামলারও বিরোধিতা করেছিলেন জর্জ কেনান।
মধ্যপ্রাচ্যে ২০০১ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র যখন ‘সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে’ লাখ লাখ কোটি ডলার ব্যয়ে ব্যস্ত, ঠিক তখন নজিরবিহীন গতিতে নিজেদের অর্থনীতিকে শক্তিশালী ও বিস্তৃত করে চলেছে চীন। ২০২০ সাল পর্যন্ত আগের ৪০ বছরে চীন অর্থনৈতিকভাবে যতটা এগিয়েছে, প্রায় পাঁচ হাজার বছরের পুরোনো সভ্যতাটির ইতিহাসে এমনটি আর কখনো ঘটেনি।
অন্যদিকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পূর্ববর্তী ৩০ বছরে বিশ্বে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নিম্ন আয়ের ৫০ শতাংশ মানুষের আয় ধারাবাহিকভাবে কমেছে। কিন্তু একই সময়ে দেশটির ধনী ও অতিধনী ১ শতাংশ মানুষের আয় লাগামহীনভাবে বেড়েছে। ফলে মার্কিন শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে সীমাহীন অসন্তোষ দেখা দিয়েছে।
২০১৫ সালে অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী মার্কিন অধ্যাপক অ্যাংগাস ডিটন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে ‘হতাশার সাগর’ সৃষ্টি হয়েছে। অর্থনীতিতে নোবেলজয়ী দেশটির আরেক অর্থনীতিবিদ জোসেফ ই. স্টিগলিৎস ও দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান পল ভল্কারের ভাষায়, যুক্তরাষ্ট্রে এখন আর গণতন্ত্র নেই, যা চলছে তা প্লুটোক্রেসি বা ধনিক শ্রেণির শাসন।
রিগ্যানবাদের খেসারত
এমন এক সংকটময় পরিস্থিতিতে ২০১৬ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো ধনকুবের ব্যবসায়ী প্রথমবারের মতো মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পতন শুরু হয়েছিল আরেক রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যানের (১৯৮১-১৯৮৯) হাত ধরে। রিগ্যান প্রশাসনের কর হ্রাস, সরকারি ব্যয় সংকোচন এবং বাজার সংস্কারের ফলে উচ্চ আয়ের মানুষ ও করদাতাদের সুবিধা বৃদ্ধি পেলেও মধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের অবস্থার অবনতি ঘটে, আর্থিক বৈষম্য বৃদ্ধি করে।
১৯৮১ সালে অভিষেক অনুষ্ঠানে রিগ্যান বলেছিলেন, ‘সরকার আমাদের সমস্যার সমাধান নয়, বরং খোদ সরকারই সমস্যা।’ তাঁর সরকারের গৃহীত নীতি রিগ্যানবাদ নামে পরিচিত।
প্রায় একই সময়ে যুক্তরাজ্যে একই ধরনের নীতি শুরু করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচার। রিগ্যান-থ্যাচারের নীতির কারণে বাজারের ‘অদৃশ্য হাতের’ জোরের কাছে সরকারের ‘দৃশ্যমান হাত’ দুর্বল হতে থাকে। কিন্তু দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রতিবেশী সিঙ্গাপুর এবং ভিয়েতনামের মতো চীনও অদৃশ্য ও দৃশ্যমান হাতের মধ্যে ভারসাম্য রেখে এগিয়ে যেতে থাকে।
‘যুক্তরাষ্ট্র যদি মনে করে সে চিরদিন এক নম্বর বিশ্বশক্তি থাকবে, তাহলে তাকে অব্যাহতভাবে একতরফা আচরণ করতে হবে। আর যুক্তরাষ্ট্র যদি দ্বিতীয় হওয়াটাকে মেনে নিতে পারে, তাহলে তাকে দীর্ঘ মেয়াদে জাতীয় স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভালো হয়, এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যেখানে বিধিবিধান, অংশীদারত্ব ও শৃঙ্খলাবদ্ধ আচরণের চর্চা থাকবে।’সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন (১৯৯৩-২০০১), ২০০৩ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষণে
মাহবুবানি মনে করেন, রিগ্যান নতুন উদারনৈতিক অর্থনীতির যেসব চরম বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করেছিলেন, তা যুক্তরাষ্ট্র কখনো আন্তরিকভাবে পুনর্বিবেচনা করে দেখার গরজ বোধ করেনি। তার বদলে পশ্চিমা পণ্ডিতেরা বলতে শুরু করেন, বিশ্বায়নের দিন শেষ। কিন্তু পশ্চিমা পণ্ডিতদের এই মনোভাব কপটতা ছাড়া কিছু নয়।
রিগানের মাধ্যমেই পরাশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের শেষের শুরু। কিন্তু সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের কৃতিত্বের কারণে তাঁর এসব ব্যর্থতা তেমন একটা আলোচিত হয় না। রিগ্যান যা শুরু করেছিলেন, সেটার কফিনে শেষ পেরেক ঠুকছেন ট্রাম্প।
বিশেষ করে চীনের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ, করোনা ব্যবস্থাপনায় চীন ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সাফল্যের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের সামগ্রিক ব্যর্থতা, বাইডেনের কাছে হারার পর ২০২১ সালের জানুয়ারিতে ক্যাপিটল হিলে ট্রাম্প সমর্থকদের হামলাকে ওয়াশিংটনের নেতৃত্বের পতনের কয়েকটি শীর্ষবিন্দু।
ওয়াশিংটনের অভিযোগ নাকচ
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বেইজিংয়ের উত্থান নিয়ে ওয়াশিংটনের উদ্বেগ প্রধানত দুটি। প্রথমটি অর্থনৈতিক। ওয়াশিংটনের দাবি, বেইজিংয়ের অন্যায্য নীতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দ্বিতীয়তটি রাজনৈতিক বা ভূরাজনৈতিক। মাহবুবানির মতে, ওয়াশিংটনের নীতিনির্ধারক ও রাজনীতিকদের এই দুই দাবির কোনোটি সঠিক নয়।
মাহবুবানি যুক্তি দেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় পাল্লা দিতে না পেরেই মূলত সোভিয়েত রাশিয়ার পতন হয়েছিল। ইতিহাস থেকে চীন এই শিক্ষা ভালোভাবে নিয়েছে। তারা এই ভুলের পুনরাবৃত্তি এড়াতে বদ্ধপরিকর। তাই চীন কৌশলী নেতৃত্বের মাধ্যমে নিজেদের অর্থনীতিকে অব্যাহতভাবে চাঙা রাখছে, পরিবেশ-পরিস্থিতির নির্মোহ বিশ্লেষণের মাধ্যমে সংকট উতরাতে চেষ্টা করছে।
চীন অভ্যন্তরীণ বাজার সম্প্রসারিত করে নিজ দেশে আমদানি বাড়ানোর পাশাপাশি সমানতালে রপ্তানিও বৃদ্ধি করে চলেছে। চীনের আত্মবিশ্বাসী অগ্রযাত্রার মুখে নীতিগত দুর্বলতার কারণে চাপ বোধ করছে যুক্তরাষ্ট্র।
চীনের উত্থানকে রাজনৈতিকভাবে ওয়াশিংটন ও তার মিত্ররা যেভাবে হুমকি হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করছে, সেটার ভিত্তি নেই বলে মনে করেন মাহবুবানি। তাঁর মতে, পরাশক্তি মাত্রই স্বার্থপর, নিষ্ঠুর। তারা সব সময় নিজেদের জাতীয় স্বার্থ নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে।
সিঙ্গাপুরের সাবেক এই কূটনীতিক মনে করেন, অতীতের যেকোনো পরাশক্তির মতো চীনও তা–ই। কিন্তু লক্ষ্য অভিন্ন হলেও চীনের ধরন আলাদা। তাঁর মতে, চীন আত্মবিশ্বাসী (এসার্টিভ) হলেও আক্রমণাত্মক (এগ্রেসিভ) নয়।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১২ শতাংশ থাকেন পশ্চিমে, আর ৮৮ শতাংশ থাকেন বাকি বিশ্বে। কিন্তু এই ১২ শতাংশের হাতেই সিংহভাগ সম্পদ ও ক্ষমতা কুক্ষিগত হয়ে আছে। কিন্তু এশিয়ার উত্থান পশ্চিমাদের বৈষম্যমূলক চক্র ভেঙে দিতে যাচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের উত্থানকাল
হার্ভার্ড কেনেডি স্কুলের পরাশক্তির রাজনীতি বিশেষজ্ঞ গ্রাহাম অ্যালিসন সতর্ক করে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিনিয়ত চীনকে উপদেশ দেওয়া বেশ উপভোগ করে। ওয়াশিংটন হরদম বলে যাচ্ছে, আপনারা আমাদের মতো হোন। কিন্তু তাঁদের খেয়াল রাখা দরকার, প্রেসিডেন্ট থিয়োডর রুজভেল্টের আমলে (১৯০১-১৯০৯) গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রশক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থানের শুরুর দিনগুলোতে ওয়াশিংটন স্পেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল।
অ্যালিসন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র পুয়ের্তো রিকো, গুয়াম, ফিলিপাইন অধিগ্রহণ করেছিল, নিজেদের শর্তে চুক্তিতে সম্মত না হলে জার্মানি ও যুক্তরাজ্যকে যুদ্ধের হুমকি দিয়েছিল, নতুন দেশ পানামা তৈরি করতে কলম্বিয়ায় বিদ্রোহে সহায়তা দিয়েছিল।
চীনের উত্থান
উদীয়মান শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের উত্থানকালের এসব কাজকে যদি স্বাভাবিক বলে ধরে নেওয়া হয়, তাহলে সেই তুলনায় চীন গত চার দশকের বেশি সময়ে তেমন কিছুই করেনি। ১৯৮৯ সালে ভিয়েতনামের সঙ্গে সামুদ্রিক সংঘর্ষের পর থেকে সীমান্তের বাইরে একটিও গুলি চালায়নি চীন। অর্থাৎ জাতিসংঘের স্থায়ী পাঁচ সদস্যের মধ্যে চীনই একমাত্র দেশ, যেটি গত ৪৫ বছরে কোনো যুদ্ধে জড়ায়নি।
অবশ্য ২০২০ সালের জুনে লাদাখের গালওয়ান উপত্যকায় চীন ও ভারতের সেনারা সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য ভয়াবহ সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল। কিন্তু তা কারও সহায়তা ছাড়া নিজেরাই দ্রুত বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছিল এবং পরবর্তী সময়ে এমন সংঘাতে না জড়ানোর বিষয়ে সমঝোতায় পৌঁছাতে পেরেছিল।
প্রতিবেশী কয়েকটি দেশের সঙ্গে দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে বেইজিংয়ের দ্বন্দ্ব আছে। উইঘুরে মুসলিম নিপীড়ন, তাইওয়ানের বাক্স্বাধীনতার সংকোচন বা তাইওয়ানে চীনের সম্ভাব্য আগ্রাসনের আশঙ্কা আছে। এসব বিষয়সহ চীনের ‘এক দেশ এক নীতি’ তথা গণতন্ত্রহীনতা নিয়ে পশ্চিমাদের উদ্বেগ ও অভিযোগ আছে।
এসব বিষয় মাহবুবানি নানা যুক্তিতর্ক দিয়ে ভারসাম্যপূর্ণভাবে ব্যাখ্যা করেন। তিনি চীনের মতো প্রাচীন সভ্যতার উত্থানকে উদ্যমের সঙ্গে সমর্থন করেন। তাঁর বিশ্লেষণে যথেষ্ট ফাঁকফোকর আছে, যা আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে কাউকে তেমন একটা বেগ পেতে হবে না।
মাহবুবানির একটি সাধারণ যুক্তি, চীন রাজনৈতিকভাবে কর্তৃত্ববাদী হলেও সে কিন্তু তা অন্য দেশে রপ্তানি করছে না। তাদের মনোযোগ, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তারের চেয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের দিকেই বেশি নিবদ্ধ। বেইজিং কী পরিমাণে পুঁজিবাদী, তা পশ্চিমাদের ঠিকমতো জানা আছে কি না সন্দেহ! চীনে গণতন্ত্র না থাকলেও মেধাতন্ত্র (মেরিটোক্রেসি) আছে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে গণতন্ত্রের ছদ্মবেশে চলছে ধনিক শ্রেণির (প্লুটোক্রেসি) শাসন। সবচেয়ে বড় কথা, চীনের শাসনব্যবস্থা ক্রমেই পরিবর্তিত হচ্ছে, মানবাধিকার নিয়েও তারা নিজেদের মতো করে বিভিন্ন বিষয় ভাবছে। মাহবুবানির এসব বক্তব্য বাগাড়ম্বরের মতো শোনালেও পশ্চিমাদের চোখে বিশ্বস্ত সিঙ্গাপুরের সাবেক এই প্রাজ্ঞ কূটনীতিকের এসব কথার যথেষ্ট গুরুত্ব আছে।
মাহবুবানির পর্যবেক্ষণ, ট্রাম্প যেভাবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ (ডব্লিউএইচও) নানা আন্তর্জাতিক সংগঠন থেকে নিজেদের সরিয়ে নিয়েছেন, তা পক্ষান্তরে চীনকে শক্তিশালী করেছে। তবে তিনি মনে করেন, আগামী এক থেকে দেড় দশকের মধ্যে চীন বিশ্বের এক নম্বর শক্তি হলেই মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র বা তার পশ্চিমা মিত্ররা মুখ থুবড়ে পড়বে, তা কিন্তু নয়।
ইতিহাসে দেখা গেছে, যখন একটি মহাশক্তির উত্থান হয়, তখন পতনশীল শক্তির সঙ্গে প্রায় সময় উদীয়মান শক্তির রক্তক্ষয়ী সংঘাত হয়। কিন্তু সংখ্যায় কম হলেও ইতিহাসে এর কিছু চমৎকার ব্যতিক্রম আছে। মাহবুবানির মতে, নিজেদের পতনশীল অবস্থা এবং চীন-এশিয়ার উত্থানকে মেনে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের উচিত নতুন এই মহাযাত্রা থেকে উপকৃত হওয়া।
ওয়াশিংটনে কি নতুন হাওয়া বইছে
ওয়াশিংটনের প্রতি মাহবুবানির বিনম৶ উপদেশ, দয়া করে চীনের উত্থানকে ঠেকানো বা আটকানোর চেষ্টা না করে এই পণ্ডশ্রমে ‘মুলতবি’ দেন। সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা দেখে মনে হচ্ছে ওয়াশিংটন মাহবুবানির কথা কিছুটা হলেও শুনতে শুরু করেছে। কিন্তু এটা কত দূর গড়াবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
গত জানুয়ারিতে দ্বিতীয় দফায় ট্রাম্প ক্ষমতায় এসে আগের মেয়াদের বাণিজ্যযুদ্ধের ধারাবাহিকতায় সারা বিশ্বের সঙ্গে শুল্কযুদ্ধ শুরু করেন। তবে চীনের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত এই নিষ্ফল যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র ‘মুলতবি’ দিয়েছে বলে মনে হচ্ছে।
সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ার বুসান শহরে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিংয়ের সঙ্গে বৈঠকের পর ট্রাম্প সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঠিক ‘মুলতবি’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এর কিছুদিন পর বাহরাইনে অনুষ্ঠিত বার্ষিক নিরাপত্তা সম্মেলন ‘মানামা সংলাপে’ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গোয়েন্দা পরিচালক তুলসী গ্যাবার্ড বলেন, ওয়াশিংটন ‘সরকার পরিবর্তন (রেজিম চেঞ্জ) বা রাষ্ট্রগঠনের’ নীতি থেকে সরে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের দুই কর্মকর্তার এই দুই ঘোষণায় মাহবুবানির এক দশকের বেশি সময়ের লেখালেখির স্পষ্ট প্রতিধ্বনি রয়েছে।
২০২০ সাল পর্যন্ত পূর্ববর্তী ৩০ বছরে বিশ্বে উন্নত দেশগুলোর মধ্যে শুধু যুক্তরাষ্ট্রের নিম্ন আয়ের ৫০ শতাংশ মানুষের আয় ধারাবাহিকভাবে কমেছে।
সতীর্থদের প্রতি ক্লিনটনের উপদেশ
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন (১৯৯৩-২০০১) হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর ২০০৩ সালে ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাষণ দিয়েছিলেন। সেই ভাষণে তিনি রাজনৈতিক সতীর্থদের উদ্দেশে বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র যদি মনে করে সে চিরদিন এক নম্বর বিশ্বশক্তি থাকবে, তাহলে তাকে অব্যাহতভাবে একতরফা আচরণ করতে হবে।
ক্লিনটন বলেন, আর যুক্তরাষ্ট্র যদি দ্বিতীয় হওয়াটাকে মেনে নিতে পারে, তাহলে তাকে দীর্ঘ মেয়াদে জাতীয় স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য ভালো হয়, এমন একটি বিশ্বব্যবস্থা তৈরি করতে হবে, যেখানে বিধিবিধান, অংশীদারত্ব ও শৃঙ্খলাবদ্ধ আচরণের চর্চা থাকবে। যুক্তরাষ্ট্রকে এমন একটি বিশ্ব গড়তে হবে, যেখানে সে দ্বিতীয় হলেও তার জীবনযাত্রা নিজের পছন্দ অনুযায়ী থাকবে।
মাহবুবানির মতে, মার্কিন পণ্ডিত ও নীতিপ্রণেতারা যত তাড়াতাড়ি ক্লিনটনের কথা আমলে নেবেন, ততই তাঁদের মঙ্গল। ওয়াশিংটনের উচিত কিসিঞ্জারের পরামর্শ অনুযায়ী, উদীয়মান পরাশক্তি চীনের সঙ্গে কীভাবে চলতে হবে, সেই দীর্ঘমেয়াদি কৌশল প্রণয়ন করা।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান থেকে গোপনে চীন সফরের মাধ্যমে কমিউনিস্ট চীনের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেছিলেন কিসিঞ্জার।
সিঙ্গাপুরের সাবেক এ কূটনীতিক মনে করেন, চীন জাতিসংঘসহ পশ্চিমাদের প্রতিষ্ঠিত সংস্থা ও সংগঠনগুলো ধ্বংস করতে চায় না; বরং উদীয়মান পরাশক্তি হিসেবে এসব সংস্থায় নতুন উদ্দীপনা যুক্ত করতে চায়। তাই ‘খাটো’ না করে পশ্চিমাদের উচিত চীনের শান্তিপূর্ণ উত্থানকে স্বাগত জানানো, তার সঙ্গে সমমর্যাদার ভিত্তিতে আচরণ এবং প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা।
বৈশ্বিক গ্রাম থেকে ক্রমশ একটি বড় ‘জাহাজে’ পরিণত হওয়া পৃথিবীতে করোনার মতো মহামারি কিংবা জলবায়ু পরিবর্তনের মতো সংকট মোকাবিলায় পশ্চিমাদের উদীয়মান পরাশক্তি চীনের সঙ্গে মিলেমিশে কাজ না করে উপায় নেই বলে মনে করেন মাহবুবানি।
কিন্তু চীনের শান্তিপূর্ণ উত্থান কি আদৌ সম্ভব হবে? নাকি আগামী এক থেকে দেড় দশকের মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে রক্তগঙ্গা বইবে, সেটা বেশ জটিল এক প্রশ্ন।