বাতাসে শুধুই লাশের গন্ধ, তবু অপেক্ষায় স্বজনেরা

ভূমিকম্পে প্রিয়জন হারিয়েছেন এই নারী। তাঁদের কবরের পাশে বসে কাঁদতে দেখা যায় তাঁকে। গত শুক্রবার তুরস্কের কাহারামানমারাসে
ছবি: এএফপি

তুরস্ক ও সিরিয়ায় ভূমিকম্পে ধসে পড়া হাজার হাজার বাড়িঘরের ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে থাকা ব্যক্তিদের জীবিত উদ্ধারের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। তবু উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা, শ্রান্তি-ক্লান্তি নিয়ে অনেকে ধ্বংসস্তূপের পাশে অপেক্ষা করছেন তাঁদের স্বজনদের ফিরে পেতে। এরই মধ্যে বাতাসে ছড়াতে শুরু করেছে লাশের গন্ধ।

তুরস্ক-সিরিয়া সীমান্তবর্তী এলাকায় ভূমিকম্প আঘাত হানে গত সোমবার ভোরে। ৭ দশমিক ৮ মাত্রার এ ভূমিকম্পে গতকাল শনিবার (বাংলাদেশ সময়) রাত ১০টা পর্যন্ত নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ২৫ হাজার ছাড়িয়েছে। তাঁদের মধ্যে বেশি বিপর্যস্ত তুরস্কে মারা গেছেন ২১ হাজার ৮৪৮ জন। আর সিরিয়ায় ৩ হাজার ৫৫৩ জন।

মানবিক বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে তুরস্কে অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটছে। খবর পাওয়া যাচ্ছে লুটপাটের। নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ জানিয়ে উদ্ধারকাজ স্থগিত রেখেছে জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার উদ্ধারকারী দল।

আরও পড়ুন

ভূমিকম্পের উৎপত্তিস্থল তুরস্কের কাহরামানমারাস শহর থেকে আল-জাজিরার সাংবাদিক রেসুল সেরদার জানিয়েছেন, জীবিত লোকজনকে উদ্ধারে এখনো কাজ করে যাচ্ছে উদ্ধারকাজে নিয়োজিত দলগুলো। তবে এখন যদি কাউকে জীবিত পাওয়া যায়, তবে তা হবে ‘অলৌকিক’ ঘটনা। তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সবখানে লাশের গন্ধ পাচ্ছি। অনেকের মরদেহ উদ্ধার হতে দেখা যাচ্ছে। আবার অনেকে রয়েছেন নিখোঁজ।’

এ চিত্র তুরস্ক ও সিরিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত অঞ্চলগুলোর প্রায় সবখানেরই। এসব এলাকায় প্রিয় মানুষের জন্য অপেক্ষার পালা শেষ হচ্ছে না স্বজনদের। শহরে শহরে লাশের গন্ধ, তারপরও প্রিয়জনকে ফিরে পাওয়ার আশায় হাল ছাড়তে নারাজ তাঁরা।

এ নিয়ে গতকাল রয়টার্সের সাংবাদিকের সঙ্গে কথা হয় তুরস্কের একটি শহরের ধ্বংসস্তূপের পাশে অপেক্ষারত সোনের জামির ও সেভদে নুর জামিরের। মা-বাবার জন্য তাঁরা অপেক্ষা করছেন। সোনের জামির বলেন, ‘গতকাল (শুক্রবার) ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে কয়েকজনকে বের করে আনা হয়েছে। তবে এখন আর কোনো আশা নেই।’

শহরের মতো ভয়ানক না হলেও গ্রামের ক্ষয়ক্ষতিও কম নয়। তুরস্কের হাতায় প্রদেশের একটি গ্রামের বাসিন্দা হাসান কুনদুরু বলছিলেন, ‘এই গ্রাম থেকে নয়জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এখন কোনো উদ্ধারকর্মী কাজ করছেন না। আমরা নিজেরাই এ কাজ করছি।’

আরও পড়ুন

ভূমিকম্পের সপ্তাহখানেক পর এসে মূলত মরদেহ উদ্ধার করা হলেও কখনো কখনো জীবিত মানুষ উদ্ধারের ঘটনাও ঘটছে তুরস্কে। দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে গতকাল জানানো হয়েছে, ২৪ ঘণ্টায় ৬৭ জনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এ উদ্ধার অভিযানে কাজ করছেন ৩১ হাজার কর্মী। ভূমিকম্পে আহত ৮০ হাজার মানুষ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। ইতিমধ্যে গৃহহীন ১০ লাখের বেশি মানুষকে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব হয়েছে।

সর্বশেষ জীবিত উদ্ধার ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছে আনতাকিয়া শহরে ১৩ বছরের এক কিশোর। ৭০ বছরের এক নারী ও ৯ বছরের এক শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে কাহরামানমারাস শহর থেকে। দিয়ারবাকির শহরে উদ্ধার হয়েছেন ৫৫ বছরের এক নারী। তবে কিরিখান শহর থেকে যে নারীকে শুক্রবার উদ্ধার করা হয়েছিল, গতকাল তিনি মারা গেছেন।

উদ্ধার অভিযানের সবচেয়ে বড় সুসংবাদটি এসেছে গাজিয়ানতেপের নুরদাগ শহর থেকে। সেখানে একটি পরিবারের পাঁচ সদস্যকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। চাপা পড়ার ১২৯ ঘণ্টা পর তাঁদের উদ্ধার করা হয়।

আরও পড়ুন

সিরিয়ায় সুসংবাদ নেই

তুরস্কে উদ্ধার অভিযানে কিছু সুসংবাদ এখনো পাওয়া গেলেও সিরিয়া থেকে এমন সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না। উল্টো সেখানকার চিকিৎসকেরা দুশ্চিন্তার খবর দিচ্ছেন। গতকাল সিরিয়ার আমেরিকান মেডিকেল সোসাইটির সদস্য ইকরাম হাব্বাউস বলেন, ইদলিব প্রদেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ।

চিকিৎসক ইকরাম বলেন, ‘কোনো খাবার নেই, আশ্রয়শিবির নেই, সুপেয় পানি নেই। একজন চিকিৎসক হিসেবে আমাদের কাছে অস্ত্রোপচার করার মতো যথেষ্ট যন্ত্রপাতি নেই। হাসপাতালগুলো আহত লোকজনে ভর্তি।’ তিনি বলেন, ‘সাহায্য যা আসছে, তা খুব ধীরগতিতে। একটি বাচ্চার যদি জরুরি ভিত্তিতে অস্ত্রোপচার লাগে, তা আমরা করতে পারছি না। কারণ, চিকিৎসা সরঞ্জাম সময়মতো আসছে না।’

এদিকে হাসপাতালগুলোতে এত বেশি আহত মানুষ আনা হচ্ছে যে চিকিৎসকদের সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে কাকে বাঁচানোর চেষ্টা করবেন তাঁরা।

ভূমিকম্পের পর থেকেই সিরিয়ায় ত্রাণ পাঠানো নিয়ে জটিলতা চলছে। ভূমিকম্পের পর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাজ সহজ করতে তুরস্ক সিরিয়ার সঙ্গে তার সীমান্ত খুলে দিলেও সব এলাকায় ত্রাণ পৌঁছাচ্ছে না। কারণ, বিদ্রোহীনিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোয় ত্রাণ বিতরণে হস্তক্ষেপ করছে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো।

গৃহযুদ্ধের কারণে গত প্রায় ১১ বছরে সিরিয়ার উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের লাখো মানুষ গৃহহীন হয়েছেন। তাঁদের মধ্যে অনেকে তুরস্কের সীমান্তবর্তী এলাকায় এসে বসবাস করছিলেন। কিন্তু ভূমিকম্পে আবারও গৃহহীন হলেন তাঁরা। এমনই একজন আলেপ্পোর জানদারিস শহরের বাসিন্দা রামাদান। ভূমিকম্পে শহরটি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আলেপ্পোয় ত্রাণ পৌঁছালেও জানদারিসে খুব কমই পৌঁছেছে।

রামাদান বলেন, ‘ভূমিকম্পের পর প্রথম রাত রাস্তায় ঘুমিয়েছি। পরদিন গাড়িতে ঘুমিয়েছি। এখন অন্যের বাড়িতে থাকছি।’

আরও পড়ুন

উদ্ধারকাজ স্থগিত করল জার্মানি-অস্ট্রিয়া

এদিকে তুরস্কে উদ্ধারকাজ চালাতে গিয়ে বিপাকে পড়েছে অস্ট্রিয়া ও জার্মানির উদ্ধারকারী দল। ‘নিরাপত্তা উদ্বেগ’ জানিয়ে এই দুটি দলই উদ্ধারকাজ গতকাল সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছে।

আনতাকিয়ায় কাজ করছে অস্ট্রিয়ার দলটি। নিরাপত্তাহীনতার কারণে তারা অন্য আন্তর্জাতিক সংগঠনের ঘাঁটিতে আশ্রয় নিয়েছে। দেশটির ফোর্সেস ডিজাস্টার রিফিল ইউনিট গতকাল এক টুইট বার্তায় জানিয়েছে, পরিবেশ নিরাপদ হলে তারা আবারও উদ্ধারকাজ শুরু করবে।

পরিস্থিতি তুলে ধরে অস্ট্রিয়ার লেফটেন্যান্ট কর্নেল পিয়েরে কুগেলওয়েইস বলেন, তুরস্কে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে। এমন গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটছে।

উদ্ধারকাজ বন্ধ রাখা প্রসঙ্গে জার্মানির সংস্থা আইএসএআর জার্মানি বিবৃতিতে জানিয়েছে, হাতায় প্রদেশে নিরাপত্তা পরিস্থিতি বদলে যাওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

তুরস্ক সরকার এ নিয়ে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি। তবে লুটপাটের ঘটনায় বেশ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

শতবর্ষের সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতি

তুরস্ক ও সিরিয়ার পরিস্থিতি নিয়ে প্রথম দিন থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছে জাতিসংঘ। গতকাল জাতিসংঘের জরুরি ত্রাণবিষয়ক সমন্বয়ক মার্টিন গ্রিফিথস তুরস্ক ও সিরিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, সেখানকার পরিস্থিতি গত ১০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ।

গতকাল কাহরামানমারাস শহরে গিয়েছিলেন গ্রিফিথস। সেখানে তুরস্কের উদ্ধারকাজে প্রশংসা করেন তিনি। বলেছেন, ‘যা ঘটেছে ও এরপর যেসব পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে, সবই অবিশ্বাস্য।’

সিরিয়ার পরিস্থিতি তুলে ধরে গ্রিফিথস বলেন, তিনি আশা করছেন সরকার ও বিদ্রোহীরা মিলে মানবিক সহায়তার কাজ করবে।

এদিকে গতকাল আলেপ্পোয় গেছেন বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান তেদরোস আধানোম গেব্রেয়াসুস। সিরিয়া পৌঁছে তিনি বলেন, আরও ত্রাণ সেখানে পৌঁছাবে।