বাইডেন-পুতিনের সফর: মধ্যপ্রাচ্যে কে কার বন্ধু

সৌদি সফরে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
ছবি: রয়টার্স

ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের প্রভাব সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। হাজার হাজার মাইল দূরের এ সংঘাত থেকেই মধ্যপ্রাচ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত সপ্তাহে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সৌদি আরব, ইসরায়েল ও অধিকৃত ফিলিস্তিন অঞ্চল সফর করেন। এর রেশ কাটতে না কাটতেই গত মঙ্গলবার তেহরান সফর করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তেহরানে তিনি ইরান ও তুরস্কের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন।

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পাশাপাশি ‘আস্তানা ফরম্যাটে’ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানের সঙ্গে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক করেন তিনি। সিরিয়ার বিষয়ে মতপার্থক্য দূর করতে ‘আস্তানা কাঠামোয়’ ত্রিপক্ষীয় আলোচনা চালিয়ে আসছে এই তিন দেশ। তবে তাদের আলোচনায় ইউক্রেন যুদ্ধ–সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় স্থান পায়।

শস্য রপ্তানিতে কৃষ্ণসাগর থেকে অবরোধ তুলে নিতে মস্কোর সঙ্গে চুক্তি নিয়ে আগ্রহ দেখিয়েছিল তুরস্ক। অপর দিকে রাশিয়াও তুরস্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে চায়। তেহরানে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন যে দুই দেশ এখন ‘একক দুর্গে’।

যুক্তরাষ্ট্র অভিযোগ করেছে, ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য রাশিয়াকে শত শত ড্রোন পাঠানোর পরিকল্পনা করছে ইরান। এ ছাড়া রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থা গাজপ্রম ইরানের রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানির সঙ্গে একটি উন্নয়ন চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। মস্কো ও তেহরানের একই রকম স্বার্থ থাকলেও কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখছিল তারা। কিন্তু এখন কেউ মনে করে না যে ঘনিষ্ঠ হওয়ার ফলে তাদের অনেক কিছু হারাতে হবে। ইরানের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখলে নতুন করে নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হতে হবে, এমন উদ্বেগ নেই রাশিয়ার। অপর দিকে ইরান যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব কাটাতে প্রস্তুতি নিচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন মধ্যপ্রাচ্য সফরে গিয়ে বলেছেন, তাঁরা এই অঞ্চলে এমন কোনো শূন্যস্থান রাখবেন না যেটা চীন, রাশিয়া বা ভারত নিতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্র এ অঞ্চলে তাদের প্রভাব ধরে রাখবে। এ ঘোষণা সত্ত্বেও ইরান ও রাশিয়া বুঝতে পেরেছে, মধ্যপ্রাচ্যে পরাশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ কমে যাচ্ছে। পুতিন সেখানে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসেবে রাশিয়ার অবস্থান তৈরি করেছেন।

রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে বাইডেনের পুরো উল্টো সুরের বিষয়টিও সবার নজরে এসেছে। জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের প্রচারণাকালে জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডসহ সৌদি আরবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলেছিলেন। ওই অভিযোগে তিনি সৌদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে একঘরে করতে উদ্যোগ নেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। মার্কিন গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী, জামাল খাসোগি হত্যাকাণ্ডে অনুমোদন দিয়েছিলেন যুবরাজ। ২০১৮ সালের ২ অক্টোবর তুরস্কের ইস্তাম্বুলের সৌদি কনস্যুলেটে প্রবেশ করেন সাংবাদিক জামাল খাসোগি। সেখানে তাঁকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। তাঁর লাশ কেটে টুকরা টুকরা করে গায়েব করে দেওয়া হয়। খাসোগির দেহাবশেষ আর পাওয়া যায়নি। সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের কট্টর সমালোচক ছিলেন সাংবাদিক জামাল খাসোগি। তাঁকে হত্যার নির্দেশদাতা হিসেবে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। কিন্তু গত সপ্তাহে সৌদি যুবরাজের সঙ্গে বৈঠকের পর বাইডেনের নৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

আগামী নভেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচন। এর আগেই বাইডেন জ্বালানির দাম কমিয়ে আনার এবং তাঁর হতাশাজনক সমর্থনের রেটিং উন্নত করতে চাইছেন। সৌদি আরব সফরে আরও বেশি তেল উত্তোলনের জন্য তিনি যে অনুরোধ করেছিলেন, তাতে খুব বেশি সাড়া পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছে না। ওই সফরে তিনি যে ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়তে চেয়েছিলেন, তার খুব বেশি সুফল তিনি পাচ্ছেন না।

এদিকে, ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক সমঝোতা নিয়ে দোহায় আলোচনায় কোনো অগ্রগতি না হওয়া এবং চুক্তিটিকে পতনের দ্বারপ্রান্তে ফেলে দেওয়ার বিষয়টি মধ্যপ্রাচ্য সফরের সফলতাকে ছাপিয়ে বেশি আলোচনায় আসছে। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে চুক্তি থেকে সরে এসে নিষেধাজ্ঞা দ্বিগুণ করেছিলেন।

এরপর থেকে পারমাণবিক কর্মসূচিতে নাটকীয়ভাবে অনেক এগিয়েছে ইরান। পারমাণবিক কূটনীতির পর্যবেক্ষকদের মধ্যে একজন সতর্ক করে বলেছেন, চুক্তিটি পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা সমাপ্তির শেষ পর্যায়ে। ইরান এমন প্রতিশ্রুতি চাইছে, যাতে পরে কোনো মার্কিন প্রশাসন এ চুক্তি লঙ্ঘন করতে না পারে।

ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সঙ্গে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন
ছবি: রয়টার্স

ইরানের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদার করা ছাড়াও ওই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্রদেশ সৌদি আরবের বিষয়েও রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। এর মধ্যে পুতিন ও সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান টেলিফোনে কথা বলেছেন। তাঁরা তেলের বাজার নিয়ে কথা বলেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সৌদি সফরের এক সপ্তাহের কম সময়ের মধ্যে তাঁদের কথা হয়। পরে ক্রেমলিনের বিবৃতিতে বলা হয়, পুতিন ও মোহাম্মদ বিন সালমান আন্তর্জাতিক তেলবাজারের পরিস্থিতি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁরা ওপেক প্লাসে সহযোগিতা জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন। পুতিন তাঁর তেহরান সফর নিয়েও সৌদি যুবরাজের সঙ্গে আলাপ করেন।

বাইডেনের মধ্যপ্রাচ্য সফরকে ইসরায়েল ও আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে সম্পর্ক জোরদার করার প্রচেষ্টা হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এতে ঝুঁকিও আছে। এতে মস্কো ও তেহরান আরও কাছাকাছি আসবে। রিয়াদ ও তেহরানের মধ্যে সংলাপের পরিবর্তে এ অঞ্চলে সংঘাতের আশঙ্কাও বেড়ে যেতে পারে। এতে বৈশ্বিক জ্বালানির বাজার আরও বেশি অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে। আরও জটিলভাবে চিন্তা করলে, এ অঞ্চলে অস্ত্র প্রতিযোগিতা সৃষ্টি ও দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতার ঝুঁকি তৈরি হতে পারে।

গার্ডিয়ান ও এএফপি অবলম্বনে মো. মিন্টু হোসেন