মিয়ানমার জান্তার ‘মনোবল ভেঙে পড়ার’ বিবরণ দিলেন বিদ্রোহীরা

বিদ্রোহীদের কাছে ইতিমধ্যে বিভিন্ন এলাকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে মিয়ানমারের সামরিক জান্তাফাইল ছবি: এএফপি

মিয়ানমারের স্থলবাণিজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রস্থল হিসেবে পরিচিত মায়াবতী। মিয়ানমারের পূর্ব সীমান্তে শহরটির অবস্থান। গত সপ্তাহে মিয়ানমারের জান্তার কাছ থেকে শহরটির নিয়ন্ত্রণ নেয় দেশটির বিদ্রোহী বাহিনীগুলো। থাইল্যান্ডের সীমান্তবর্তী এই শহরের নিয়ন্ত্রণ হারানোটা সামরিক জান্তার জন্য একটা ধাক্কা। শহরটির পতন যুদ্ধক্ষেত্রে জান্তার অবস্থা সম্পর্কেও একটা আভাস দেয়।

মায়াবতীর পরিস্থিতি সরেজমিন দেখতে চলতি সপ্তাহে এলাকাটিতে গিয়েছিলেন রয়টার্সের সাংবাদিকেরা। শহরটির উপকণ্ঠে সবচেয়ে তীব্র লড়াই হয়েছিল।

এই লড়াইয়ের চিহ্ন দেখতে পান রয়টার্সের সাংবাদিকেরা। সেখানকার পরিত্যক্ত বাড়িগুলোয় দেখা যায় গুলির অসংখ্য গর্ত। লড়াইয়ে বিভিন্ন গ্যাস স্টেশন বিস্ফোরণে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিমান হামলায় এলাকার বিভিন্ন অবকাঠামো মাটির সঙ্গে মিশে গেছে।

আরও পড়ুন

মায়াবতীতে জান্তার বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহীরা লড়াই করেছিলেন, তাঁরা মনোবল ভেঙে যাওয়া একটি সামরিক বাহিনীর বর্ণনা দিয়েছেন।

মায়াবতী যুদ্ধে অংশ নেওয়া একটি বিদ্রোহী ইউনিটের কমান্ডার সাও কাও। তিনি রয়টার্সকে বলেন, ‘আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে তিনটি ঘাঁটি দখল এবং এলাকাটি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হই। তারপর তারা (জান্তা সেনা) পালিয়ে যায়।’

জান্তার সামরিক প্রশাসনের প্রতি অনুগত জাতিগত মিলিশিয়াদের প্রহরীরা কিছুদিন আগে পর্যন্ত শহরটির রাস্তায় রাস্তায় টহল দিয়ে বেড়াতেন। কিন্তু এপ্রিলের শুরুর দিকে কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়নের (কেএনইউ) নেতৃত্বাধীন প্রতিরোধ বাহিনী শহরটি অবরোধ করলে এই মিলিশিয়ারা আগের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ায়।

আরও পড়ুন

পার্শ্ববর্তী দেশ থাইল্যান্ডের সঙ্গে মিয়ানমারের বার্ষিক এক বিলিয়ন ডলারের বেশি সীমান্তবাণিজ্য হয় এ এলাকা দিয়ে। রয়টার্সের সাংবাদিকেরা গত সোমবার বিদ্রোহী-নিয়ন্ত্রিত এ এলাকায় প্রবেশের বিরল সুযোগ পান। এলাকা পরিদর্শনকালে তাঁরা জান্তাবিরোধী সাতজন প্রতিরোধযুদ্ধ-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার সাক্ষাৎকার নেন। এ শহরে সংঘটিত লড়াই সম্পর্কে বিস্তারিত জানাশোনা আছে—এমন তিনজন থাই কর্মকর্তা ও চারজন নিরাপত্তাবিষয়ক বিশ্লেষকের সঙ্গে কথা বলে রয়টার্স। এসব সাক্ষাৎকার থেকে সংঘাতের অনেক অন্তর্নিহিত বিষয় উঠে আসে। জান্তাবিরোধী সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো গুরুত্বপূর্ণ জনকেন্দ্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ ধরা রাখতে চায়। তারা চায় জান্তার পতন।

গত বছর বিদ্রোহীরা চীনের সীমান্তবর্তী মিউজ শহর নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার দাবি করেন। এখন তাঁরা কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মায়াবতী শহরেরও নিয়ন্ত্রণ নিলেন। এর মানে দাঁড়ায়, মিয়ানমারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দুটি স্থলসীমান্ত ক্রসিংয়ের নিয়ন্ত্রণ এখন প্রতিরোধযোদ্ধাদের হাতে চলে গেছে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুসারে, ২০১৭ সাল থেকে অর্থনীতির দ্রুত পতন দেখছে মিয়ানমার। দেশটির দারিদ্র্যও দ্বিগুণ হয়েছে।

মিয়ানমারের জান্তা এখন দারুণ অর্থসংকটে আছে। বিদ্রোহীদের সাফল্যের জেরে এখন দেশটির প্রায় সব প্রধান স্থলসীমান্ত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে জান্তা।

আরও পড়ুন

মায়াবতীর পতনের পর এক হিসাব তুলে ধরে থাইল্যান্ডভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজি অ্যান্ড পলিসি-মিয়ানমার (আইএসপি) বলেছে, সামরিক জান্তা এখন দেশটির স্থলভিত্তিক শুল্ক রাজস্বের ৬০ শতাংশ থেকেই বঞ্চিত।

২০২১ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির সরকারকে হটিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে সামরিক জান্তা। পরে এই জান্তা সরকারকে হটাতে লড়াই শুরু করে দেশটির বিভিন্ন সশস্ত্র বিদ্রোহী গোষ্ঠী। গত বছরের অক্টোবরের শেষ দিকে এই লড়াই তীব্ররূপ ধারণ করে। লড়াই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, অক্টোবর থেকে বিদ্রোহীদের বড় কোনো হামলা প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছে জান্তা। ক্ষমতা দখলের পর এখন তারা সবচেয়ে দুর্বল অবস্থানে আছে।

প্রতিবেশী থাইল্যান্ড আগে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার সঙ্গে সম্পৃক্ততার বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে আসছিল। কিন্তু তারা এখন সংঘাতের বিষয়ে নিজেদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করতে শুরু করেছে।

আরও পড়ুন

থাইল্যান্ডের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী সিহাসক ফুয়াংকেটকিও গত বুধবার রয়টার্সকে বলেন, থাই নিরাপত্তাবিষয়ক কর্মকর্তারা কেএনইউসহ মিয়ানমারের অন্যান্য বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখছেন। তাঁরা বিশেষ করে মানবিক ইস্যুতে আরও সংলাপের ব্যাপারে মনখোলা অবস্থানে আছেন।

থাইল্যান্ডের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, তাঁরা অন্ধভাবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর পক্ষ নেন না। কিন্তু তাঁরা শান্তির পক্ষে। তাই মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তাঁদের কথা বলতে হবে।

ঘটনাপ্রবাহের বিষয়ে মন্তব্য জানতে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার একজন মুখপাত্রকে ফোন করেছিল রয়টার্স। কিন্তু তিনি সাড়া দেননি।

আরও পড়ুন