হিমালয়ের কোলে অবস্থিত নেপাল বিশ্বের প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে পর্যটনের এক আকর্ষণীয় জায়গা। ভক্তপুরের প্রাচীন আকর্ষণ, চিতওয়ানের বন্য প্রাণীর বিস্ময় এবং সাগরমাথার সৌন্দর্য ভ্রমণকারীদের আকৃষ্ট করে। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু পর্বতগুলোর কয়েকটির অবস্থানও এখানে। দুঃসাহসী অভিযান পছন্দ করেন, এমন মানুষের কাছে অন্যতম আকর্ষণীয় স্থান হয়ে আছে এই দেশ। নেপালে ভ্রমণেচ্ছুক এমন পর্যটকেরা সেখানকার ১০টি দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে জেনে নিতে পারেন। ভ্রমণবিষয়ক সাময়িকী ট্রাভেল অ্যান্ড লেজার এশিয়া এবং নেপালের টুরিজম বোর্ডের ওয়েবসাইট থেকে তথ্যগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে।
সাগরমাথা ন্যাশনাল পার্ক হলো নেপালে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে উঠা সবচেয়ে দর্শনীয় স্থানগুলোর একটি। এটি জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পাওয়া একটি পর্যটন এলাকা। এখানে মাউন্ট এভারেস্ট এবং অপর দুই পর্বতশৃঙ্গ লোৎসে ও চো ওয়ুর অবস্থান। উদ্যানটি ১ হাজার ১৪৮ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে বিস্তৃত। এখানে ঘন বন থেকে শুরু করে বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদের সমাহার রয়েছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে পবিত্র গোকিও হ্রদের অবস্থানও সেখানে। তাদের বিশ্বাসমতে, এ হ্রদটি ‘নাগ দেবতা’র বাসস্থান। আর এ কারণে সেখানে তীর্থযাত্রীরা ভিড় করেন। এ পর্যটন এলাকাটি ভ্রমণের জন্য মার্চ থেকে মে এবং অক্টোবর-নভেম্বরকে সবচেয়ে উপযোগী সময় বলে বিবেচনা করা হয়।
চিতওয়ান ন্যাশনাল পার্কের অবস্থান নেপালের দক্ষিণে তেরাই অঞ্চলে। বন্য প্রাণীপ্রেমীদের কাছে এটি একটি আকর্ষণীয় স্থান। এটিও ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় স্থান পাওয়া পর্যটন এলাকা। বেঙ্গল টাইগার, গন্ডারসহ বিভিন্ন প্রাণীর বসবাস এখানে। বলা চলে, এটি জীববৈচিত্র্যের এক স্বর্গরাজ্য। এখানে গেলে রোমাঞ্চকর জঙ্গল সাফারিতে অংশ নেওয়া, হাতির পিঠে চড়া এবং রাপতি নদীতে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা নিতে পারেন পর্যটকেরা। এ উদ্যানটিতে ৫ শতাধিক প্রজাতির পাখির বসবাস। এ স্থানটি ভ্রমণের সবচেয়ে উপযোগী সময় জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস।
নেপালের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর পোখারার অবস্থান হিমালয়ের প্রবেশদ্বারে। পোখারা এলাকাটি নেপালের রত্ন হিসেবে পরিচিত। এখানকার ফেওয়া হ্রদে তুষারাবৃত অন্নপূর্ণা পর্বত শৃঙ্গের প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। রোমাঞ্চপ্রেমীরা ভোরের দিকে সারাংকোট থেকে হিমালয় অঞ্চলের সূর্যোদয় উপভোগ করতে পারেন। আছে প্যারাগ্লাইডিং-এর ব্যবস্থাও।
কাঠমান্ডুর চেয়ে এ শহরের বাতাস বেশি পরিষ্কার। এখানকার জলবায়ু বেশ স্বস্তিদায়ক। একই সঙ্গে মনোরম পরিবেশ ও দুঃসাহসিক অভিযানের স্বাদ নিতে চাইলে নেপালের পোখারা অবশ্যই দর্শনীয় একটি স্থান।
এভারেস্ট বেজক্যাম্পের অবস্থান কুম্ভ অঞ্চলে। বছরে ৩০ হাজারের বেশি পর্বতারোহী এভারেস্ট বেজক্যাম্পে যান। ৫ হাজার ৩৬৪ মিটার উঁচুতে এ বেজ ক্যাম্পের অবস্থান। এখান থেকে এভারেস্ট এবং আশপাশের চূড়াগুলো দেখা যায়। লুকলা থেকে যাত্রা শুরু করে এ বেজ ক্যাম্পে যেতে ৭ থেকে ৯ দিনের মতো সময় লাগে। কালাপাথর ভিউ পয়েন্ট পর্যন্ত যেতে কিছু কঠিন পথ পাড়ি দিতে হয়। তবে পর্বতারোহণের কষ্ট সয়ে যেতে না চাইলে হেলিকপ্টারেও পর্যটকেরা এভারেস্ট বেজ ক্যাম্পে যেতে পারেন।
পায়ে হেঁটে কিংবা হেলিকপ্টারে—যা–ই হোক না কেন এভারেস্ট বেজক্যাম্পে ভ্রমণের মধ্য দিয়ে পর্যটকেরা আল্পাইন এলাকা ও সাগরমাথা উদ্যানের মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন।
নেপালের বিখ্যাত পর্যটন এলাকা মুস্তাং ‘নিষিদ্ধ রাজ্য’ হিসেবে পরিচিত। এই প্রত্যন্ত অঞ্চল চোসের গুহা এবং ঘর গোম্পার মতো প্রাচীন মঠের অবস্থান। গুহাগুলোর খোদাই করা কারুকাজ এবং মধ্যযুগীয় স্থাপত্য যেন সেখানকার ইতিহাসের বর্ণনা দিচ্ছে। মুস্তাং এলাকার পাথরের রাস্তাগুলো দিয়ে হাঁটার সময় সেখানকার গল্পগুলো যেন প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। এ স্থানটি ভ্রমণের সবচেয়ে উপযোগী সময় হলো জুন থেকে সেপ্টেম্বর।
নেপালের এ স্থানটি একটি পবিত্র ভূমি। এটি গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান। মায়া দেবী মন্দির ও অশোক স্তম্ভ বুদ্ধের জন্মস্থানকে চিহ্নিত করে রেখেছে।
নেপালের ট্যুরিজম বোর্ডের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য অনুসারে, লুম্বিনী হলো দেশটির তৃতীয় বৃহত্তম প্রদেশ। রূপানদেহি অঞ্চলের পবিত্র তীর্থস্থান লুম্বিনীর নামানুসারে এই প্রদেশের নামকরণ করা হয়েছে। ২২ হাজার ২৮৮ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ প্রদেশটি দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১৫ দশমিক ১ শতাংশজুড়ে বিস্তৃত।
ইউনেসকো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যের এ এলাকাটি একটি শান্ত তীর্থস্থান। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ভরপুর এবং তেরাই সমভূমির এই আধ্যাত্মিক স্থানটিকে পর্যটকেরা তাদের ভ্রমণের তালিকায় রেখে থাকেন। বুদ্ধজয়ন্তীতে এপ্রিল থেকে মে মাস পর্যন্ত স্থানটি ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময়।
মানাং ও মুস্তাং সীমান্তের কাছে তিলিচো হ্রদটি বিশ্বের সবচেয়ে উঁচুতে অবস্থিত হ্রদ। পর্বতারোহণ করে তিলিচো হ্রদে পৌঁছাতে হয়। এটি ৪ হাজার ৯১৯ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। আর এ পথ দিয়ে যাত্রার সময় পর্যটকেরা অন্নপূর্ণা রেঞ্জ এবং তুষার আবৃত অন্য হিমালয় শৃঙ্গগুলোর মনোরম দৃশ্য উপভোগ করতে পারেন। তিলিচো হ্রদের স্বচ্ছ পানিতে পার্শ্ববর্তী মুক্তিনাথ চূড়া, নীলগিরি খানসারের মতো হিমবাহগুলো প্রতিফলিত হয়ে এক মনোমুগ্ধকর দৃশ্য তৈরি হয়।
অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প বা মুক্তিনাথ যাওয়ার পথে প্রায়ই বিস্ময়কর স্থানটি চোখে পড়ে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ স্থানটি ভ্রমণের অভিজ্ঞতা অবিস্মরণীয় হতে পারে।
নেপালের প্রাচীন শহর ভক্তপুরের অবস্থান কাঠমান্ডু উপত্যকায়। এটি ভক্ত বা উপাসকদের শহর হিসেবে পরিচিত। এখানকার দরবার স্কয়ার ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্থান হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত। ভক্তপুর এলাকাটি সৌন্দর্যের পাশাপাশি ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিকভাবেও সমৃদ্ধ। এখানকার ঐতিহ্যবাহী কারুশিল্প, সরু গলি ও স্থানীয়দের হাসিখুশি মুখ পর্যটকদের মুগ্ধ করে।
কাঠমান্ডুর কাছে অবস্থিত এ স্থানটিতে বছরের যেকোনো সময়ে গেলেই সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়।
নেপালের বৌদ্ধনাথ স্তূপ মন্দিরটি ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পাওয়া একটি স্থান। কাঠমান্ডুর কাছে অবস্থিত এ স্থানটি যেমন সৌন্দর্যপূর্ণ, তেমনি এর আধ্যাত্মিক গুরুত্বও আছে। এর বাইরের অংশটিতে আছে একটি সোনালি চূড়াবিশিষ্ট সাদা গম্বুজ। এর ভেতরের অংশটি থাংকা চিত্রকর্ম এবং বুদ্ধের সোনালি মূর্তি দিয়ে সাজানো।
সূর্যোদয়ের সময় স্তূপটি যেন প্রশান্তি ছড়ায়। আশপাশের মঠ, ক্যাফে এবং দোকানগুলো যেন ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এক প্রাণবন্ত মিশেল। ষষ্ঠ শতাব্দীর এই প্রাচীন স্থানটি ঐক্য এবং স্থিতিস্থাপকতার প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।
তিব্বতীয়দের নববর্ষ উদ্যাপনকালে ফেব্রুয়ারি মাসে এ স্থানটি ভ্রমণের শ্রেষ্ঠ সময় বলে বিবেচনা করা হয়।
নেপালের লাংতাং অঞ্চলে লাংতাং ন্যাশনাল পার্কের অবস্থান। সবুজ বন থেকে শুরু করে আলপাইন তৃণভূমি এবং তুষারাবৃত চূড়া পর্যন্ত অনেক কিছুই দেখার আছে সেখানে। লাংতাং ন্যাশনাল পার্কে গেলে পান্ডা ও হিমালয় অঞ্চলের কালো ভালুকের দেখা পাওয়া যায়।
অন্যান্য পর্যটন এলাকার তুলনায় কম উন্নত হলেও এই অঞ্চলটিতে গেলে প্রশান্তির ছোঁয়া পাওয়া যায়। স্থানটিতে কাঠমান্ডু থেকে সহজেই যাতায়াত করা যায়।
লাংতাং ন্যাশনাল পার্কের উত্তর দিকে গোসাইকুন্ড হ্রদের অবস্থান। অত্যন্ত উঁচুতে অবস্থিত এ হ্রদটি আধ্যাত্মিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ। রনোড্রেনড্রনের বন ও মনোমুগ্ধকর গ্রামে ঘেরা এ স্থানটি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয়।
লাংতাং ন্যাশনাল পার্ক ও গোসাইকুণ্ড হ্রদে ঘুরতে যাওয়ার সেরা সময় সেপ্টেম্বর থেকে অক্টোবর।