মিয়ানমারে ‘প্রহসনের’ ভোটে নেই আমেজ, আছে আতঙ্ক
মিয়ানমারে আজ রোববার শুরু হতে যাওয়া সাধারণ নির্বাচন ঘিরে আগে থেকে কোনো প্রচার-প্রচারণা বা আমেজ দেখা যায়নি। দেশটির সাধারণ মানুষের মতে, বিগত নির্বাচনগুলোর তুলনায় এবারের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ, নজিরবিহীন মানবিক–সংকট এবং সামরিক জান্তার ক্ষমতা দীর্ঘায়িত করার এই চেষ্টাকে ‘প্রহসন’ হিসেবে অভিহিত করে চারদিকে সমালোচনা হচ্ছে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আগের নির্বাচনগুলোতে যে ধরনের উৎসবমুখর পরিবেশ ও উদ্দীপনা দেখা যেত, এবার তার ছিটেফোঁটাও নেই। বিশ্লেষক ও অধিকারকর্মীদের মতে, মূলত জান্তা সরকারের ক্ষমতাকে বৈধতা দিতেই এই ভোটের আয়োজন করা হয়েছে।
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর এটিই প্রথম কোনো নির্বাচন হতে যাচ্ছে। তবে প্রধান বিরোধী দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসিসহ (এনএলডি) অধিকাংশ শক্তিশালী দলকে নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো এই নির্বাচনকে একটি ‘সাজানো নাটক’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে।
একদিকে সংঘাতকবলিত এলাকাগুলোতে খাদ্য ও ত্রাণের তীব্র সংকট, অন্যদিকে ধরপাকড় ও দমন-পীড়নের ভয়ে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে বিরাজ করছে চরম আতঙ্ক। অনেক নাগরিকই মনে করছেন, এই নির্বাচন কেবল জান্তাপ্রধান মিন অং হ্লাইংয়ের ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার একটি মাধ্যম ছাড়া আর কিছুই নয়।
হতাশ নাগরিকেরা
২০২১ সালের সামরিক অভ্যুত্থানের পর থেকেই দেশজুড়ে চরম বিশৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে মিয়ানমার। ওই সময় নোবেলজয়ী অং সান সু চির নেতৃত্বাধীন নির্বাচিত সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাবাহিনী। ২০২০ সালের সাধারণ নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ তুলে ক্ষমতা দখল করলেও দেশটিকে এক ভয়াবহ গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয় জান্তা সরকার।
নির্বাচনটির প্রতি জনসমর্থন রয়েছে বলে জান্তা সরকার দাবি করলেও জাতিসংঘ, পশ্চিমা দেশগুলো এবং বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন একে কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। মিয়ানমারের বাণিজ্যিক রাজধানী ইয়াঙ্গুনের বাসিন্দারা এই ভোটের আমেজ নিয়ে হতাশ। আজ শহরটির বেশ কিছু অংশে ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। ইয়াঙ্গুনের তিনজন বাসিন্দা সংবাদমাধ্যমকে জানান, আগের নির্বাচনগুলোর সময় শহরটি প্রচারে মুখর থাকত। তখন মিছিল, বর্ণাঢ্য রোড শো এবং বিশাল জনসমাবেশে একধরনের উৎসবমুখর পরিবেশ বিরাজ করত। কিন্তু এবারের চিত্র একেবারেই ম্লান।
নিরাপত্তার আশঙ্কায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইয়াঙ্গুনের ৩১ বছর বয়সী এক যুবক বলেন, ‘এবার প্রার্থীদের রাস্তায় সেভাবে নামতেই দেখা যায়নি। রাস্তার পাশে শুধু তাঁদের কিছু সাইনবোর্ড বা পোস্টার ঝুলে থাকতে দেখেছি।’
এক দশক আগের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। ২০১১ সালে টানা পাঁচ দশকের সামরিক শাসনের অবসানের পর যখন দ্বিতীয়বারের মতো সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল, তখন রাজপথ ছিল সু চির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসির (এনএলডি) লাল পতাকায় মোড়া। সে সময়কার নির্বাচনী পরিবেশ ছিল উৎসবমুখর। এমনকি ২০২০ সালের নির্বাচনেও করোনার বিধিনিষেধের কারণে প্রচার সীমিত থাকলেও মানুষের সক্রিয়তা ছিল চোখে পড়ার মতো।
ইয়াঙ্গুন থেকে প্রায় ৬০০ কিলোমিটার উত্তরে মান্দালয় শহরের চিত্রও একই। ভোটের আগে সেখানে প্রচারণার কোনো চিহ্ন দেখা যায়নি। সেখানকার বাসিন্দা ৩৬ বছর বয়সী নুয়ে বলেন, প্রচারের নাম দিয়ে কেবল কয়েকটি বিলবোর্ড বসানো ছাড়া আর কোনো তৎপরতা নেই। যেসব ছোটখাটো জনসভা হচ্ছে, সেগুলোও হচ্ছে কড়া পাহারায়। তবে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী–সমর্থিত ইউনিয়ন সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টির (ইউএসডিপি) প্রচার কিছুটা দৃশ্যমান।
ভয়ের আবহে নির্বাচন
মিয়ানমারের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে গত মঙ্গলবার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি জানিয়েছে, জান্তা সরকার এবং তাদের বিরোধিতাকারী সশস্ত্র গোষ্ঠী—উভয়পক্ষ থেকেই সাধারণ মানুষকে ভোট দেওয়া বা না দেওয়ার বিষয়ে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক প্রধান ফলকার টুর্ক বলেন, ‘সহিংসতা এবং চরম দমন-পীড়নের মধ্যেই এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।’
মিয়ানমারের এনএলডি সদস্য ও জান্তাবিরোধী জোট নিয়ে গঠিত ছায়া সরকার ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্ট (এনইউজি) জানিয়েছে, তারা ভোট বর্জনের জন্য সাধারণ মানুষের ওপর কোনো চাপ তৈরি করছে না।
জান্তা সরকারের দাবি, কোনো ধরনের বলপ্রয়োগ বা দমন-পীড়নের মাধ্যমে এই নির্বাচন করা হচ্ছে না। গত বৃহস্পতিবার দেশটির রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যম গ্লোবাল নিউ লাইট অব মিয়ানমার-এর এক নিবন্ধে বলা হয়, পশ্চিমা মানদণ্ড দিয়ে এই নির্বাচনকে বিচার করা ভুল হবে।