কেন সরে গেলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী
কেন পদত্যাগ করলেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা? কেনইবা দলীয় সভাপতির পদে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে নিজেকে দূরে রাখছেন তিনি? ফুমিও কিশিদা পদত্যাগ করার পর গতকাল বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে অবশ্য এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা কিশিদার ওই উত্তরে সন্তুষ্ট হতে পারেননি।
কিশিদা গতকালের সংবাদ সম্মেলনে জানিয়ে দেন, তিনি আগামী মাসের শেষ দিকে ক্ষমতাসীন লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সভাপতি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন না। কারণ হিসেবে বলেছেন, ক্ষমতাসীন দলে যে সত্যিকার অর্থে পরিবর্তন সূচিত হয়েছে জাপানের জনগণকে, তা দেখিয়ে দিতে দায়িত্ব থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন তিনি।
তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা অবশ্য কিশিদার এই সাফাই মেনে নিতে নারাজ। তাঁরা বলছেন, বিগত দিনগুলোর বেশ কিছু আর্থিক কেলেঙ্কারি সামাল দেওয়ায় ব্যর্থতাই এই সিদ্ধান্তের পেছনে মূল কারণ। দলের ভেতরে ঘটে যাওয়া তহবিল কেলেঙ্কারি সামাল দিতে কিশিদা বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও জাপানের জনগণ তাঁর সেই পদক্ষেপে খুব বেশি আস্থা রাখতে পারেননি। ফলে তাঁর প্রতি জনসমর্থন ধস নামা অব্যাহত ছিল। এ ছাড়া ক্ষমতাসীন দলের ভেতরে উপদলীয় কোন্দলের সমাপ্তি টানার উদ্দেশে উপদল বিলুপ্তির যে আহ্বান কিশিদা জানিয়েছিলেন, দলের ভেতরের প্রভাবশালী নেতাদের অনেকেই সেই ডাকে সাড়া দেননি। এর বাইরে জাপানের অর্থনীতিতে দেখা দেওয়া জটিলতার কারণে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার চাপও জনগণ অনুভব করতে পারছিলেন। ফলে দায়িত্ব থেকে সম্মানের সঙ্গে সরে যাওয়ার এটাই উপযুক্ত সময় বলে ধরে নিয়েছেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী ও এলডিপির প্রধান হওয়ার দৌড়ে আছেন দলের মহাসচিব মোতেগি তোশিমিৎসু, মন্ত্রী কোনোও তারো, তাকাইচি সানায়ে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী কোইজুমি জুনইচিরোর ছেলে কোইজুমি শিনজিরো এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইশিবা শিগেরু।
জাপানের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে এলডিপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় থাকায় কিশিদার সরে যাওয়া থেকে দলের সামনে তাৎক্ষণিক কোনো সংকট নিয়ে আসবে না। দলীয় সভাপতির নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী নিশ্চিতভাবেই নতুন প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ লাভ করবেন। তবে নতুন নেতার দায়িত্ব পালনের সময়সীমা খুব বেশি দীর্ঘ না-ও হতে পারে। কারণ, ২০২৫ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে এলডিপি ভালো ফলাফল দেখাতে ব্যর্থ হলে সেই দায়িত্ব অবশ্যই নতুন নেতার ওপর এসে পড়বে। ফলে তাঁকে দায়িত্ব ছেড়ে দিতেও হতে পারে।
তবে কিছুটা অনিশ্চিত ভবিষ্যতের ওপর খুব বেশি গুরুত্বারোপ না করে এলডিপির বেশ কয়েকজন নেতৃস্থানীয় সদস্য ইতিমধ্যে দলের নতুন সভাপতি নির্বাচনে নিজেদের প্রার্থী হওয়ার ইচ্ছা তুলে ধরেছেন। তাঁদের মধ্যে কাকে দলের সংসদ সদস্য ও সাধারণ সদস্যরা নিজেদের পছন্দের প্রার্থী হিসাবে বেছে নেবেন, তা অবশ্য এ মুহূর্তে বলা কঠিন।
বেশ কিছু আর্থিক কেলেঙ্কারি সামাল দেওয়ায় ব্যর্থতাই কিশিদার এই সিদ্ধান্তের মূল কারণ। দলের ভেতরে ঘটে যাওয়া তহবিল কেলেঙ্কারি সামাল দিতে তিনি বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও জাপানের জনগণ তাঁর সেই পদক্ষেপে খুব বেশি আস্থা রাখতে পারেননি।
এলডিপির সভাপতি নির্বাচনে দলের সংসদ সদস্যরা ছাড়াও নিয়মিত চাঁদা পরিশোধ করা দলের প্রায় ১১ লাখ সাধারণ সদস্য ভোটার হিসেবে বিবেচিত। তবে উভয় বিভাগের জন্য ৫০ শতাংশ ভোট নির্ধারিত থাকায় সংসদ সদস্যরা অনেক বেশি গুরুত্ব পেয়ে থাকেন। সাধারণ সদস্যদের ভোটের প্রক্রিয়ায় উপদলীয় বিভাজন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বলে যে উপদলে সংসদ সদস্যদের উপস্থিতি বেশি, বাড়তি কিছু সুবিধা সেই উপদল পেয়ে থাকে।
কয়েক বছর আগে পর্যন্ত প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবের নেতৃত্বাধীন উপদল ছিল সার্বিক অর্থে সবচেয়ে প্রভাবশালী। সেই সুবিধা নিয়ে তিনি সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে প্রধানমন্ত্রীর পদ ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর সেই উপদল এখন অনেকটাই দুর্বল হয়ে পড়েছে, সেই সুযোগ গ্রহণ করে অন্যরা উঠে আসছে। ইদানীং সবচেয়ে প্রভাবশালী উপদল হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী আসো তারোর নেতৃত্বাধীন উপদলকে। ফলে দলীয় নেতৃত্বের নির্বাচনে প্রার্থী হতে আগ্রহী সংসদ সদস্যদের অনেকেই ইতিমধ্যে আসোর দুয়ারে ধরনা দিতে শুরু করেছেন।
এগিয়ে কারা
সংসদে এলডিপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় থাকায় দলের নতুন নেতা পরবর্তী প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হবেন বলে প্রার্থীদের সংসদ সদস্য হওয়া বাধ্যতামূলক। তবে প্রার্থী হওয়ার ন্যূনতম শর্ত হচ্ছে প্রার্থিতার জন্য অন্তত ২০ জন সংসদ সদস্যদের অনুমোদন লাভ করা। সম্ভাব্য প্রার্থীদের প্রায় সবার সে ধরনের সমর্থন থেকে যাওয়ায় উপদলীয় কোন্দল কাজে লাগিয়ে কোনো প্রার্থী সবচেয়ে বেশি সমর্থন আদায় করে নিতে পারবেন, তার ওপর সাফল্য অনেকটা নির্ভর করবে।
মুষ্টিমেয় যে কয়েকজনকে সামনের দিকের প্রার্থী হিসেবে দেখা হচ্ছে, সেই দলে আছেন এলডিপির মহাসচিব মোতেগি তোশিমিৎসু, ডিজিটাল প্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রী কোনোও তারো, কিশিদার মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী সদস্য এবং আবের একসময়ের আস্থাভাজন তাকাইচি সানায়ে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী কোইজুমি জুনইচিরোর ছেলে ও উত্তরসূরি কোইজুমি শিনজিরো এবং সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইশিবা শিগেরু।
দলীয় সভাপতির নির্বাচনে বিজয়ী প্রার্থী নিশ্চিতভাবেই নতুন প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ লাভ করবেন। তবে নতুন নেতার দায়িত্ব পালনের সময়সীমা খুব বেশি দীর্ঘ না-ও হতে পারে। কারণ, ২০২৫ সালের অক্টোবরে নির্বাচনে ব্যর্থ হলে তাঁকে দায়িত্ব ছেড়ে দিতেও হতে পারে।
তাঁদের মধ্যে মোতেগি আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত থাকলেও অন্য চারজনের বিরুদ্ধে এ ধরনের অভিযোগ নেই। ফলে প্রতিযোগিতায় শেষ পর্যন্ত কে এগিয়ে থাকবেন, তা ঠিক এ মুহূর্তে বলা কঠিন। নিজের অবস্থান পোক্ত করে তুলতে মোতেগি ইতিমধ্যে আসোর দরবারে ধরনা দিতে শুরু করেছেন। তবে কোনোও তারো নিজে সেই উপদলের সদস্য হওয়ায় কিছুটা অসুবিধায় মোতেগিকে অবশ্যই পড়তে হচ্ছে।
অন্যদিকে কোনোও তারোর দৃশ্যত স্বাধীন আচরণ আসোর পছন্দসই এ কারণে নয় যে তিনি হয়তো মনে করে থাকবেন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব কোনোও পেলে তাঁকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারা আসোর জন্য কঠিন হয়ে উঠতে পারে। ফলে কোনো প্রার্থীকে নিজে তিনি সমর্থন করবেন, তা তিনি এখনো পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেননি। অন্যদিকে তাকাইচি সানায়ে সে সুযোগ কাজে লাগাতে এগিয়ে আসতে পারেন। ফলে এই তিন প্রার্থী হচ্ছেন এগিয়ে থাকা পাঁচ প্রার্থীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সম্ভাবনাময়।
জাপানের জনগণের বড় অংশ অবশ্য ইশিদা শিগেরুকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাইলেও এলডিপির সংসদ সদস্যদের মধ্যে তাঁর জনপ্রিয়তায় যথেষ্ট ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়। অন্যদিকে কোইজুমি শিনজিরো সম্প্রতি মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত না হওয়ায় তিনিও বলা যায় অনেকটা পিছিয়ে গেছেন। দলের ভেতরে বাবা কোইজুমির আগের সেই প্রভাব বজায় না থাকাও ছেলের জন্য অনেক অর্থেই নেতিবাচক হয়ে দেখা দিচ্ছে।
নেতৃস্থানীয় এই পাঁচ প্রার্থীর বাইরে এলডিপির অন্য কোনো নেতা শেষ মুহূর্তে এগিয়ে আসেন কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী কিশিদা নিজের পছন্দের প্রার্থী সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত কিছু না বলায় শেষ মুহূর্তে কি ঘটে, সেই পূর্বাভাস দেওয়া কঠিন হয়ে উঠছে। আবে দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার পর দলীয় নেতৃত্বের নির্বাচনে শেষ সময়ে এগিয়ে আসা সুগা ইয়োশিহিদের বেলায় ঠিক এমনটাই ঘটেছিল। তবে সুগার বেলায় ইতিবাচক ভূমিকা পালন করেছিল তাঁর প্রতি আবের জোরালো সমর্থন।
কিশিদার নিজের অবশ্য তুলনামূলক সে রকম অবস্থান নেই। তবে তারপরও বলতে হয়, দলের প্রভাবশালী উপনেতারা নিজেদের আজ্ঞাবহ রাখতে পারবেন বলে মনে হওয়া কোনো প্রার্থীর সন্ধান পেলে অজানা সেই প্রার্থীও হয়তো চমক দিয়ে সামনে এগিয়ে আসতে পারেন। ঘটনা শেষ পর্যন্ত ঠিক কোন দিক বরাবর অগ্রসর হয়, আগামী কয়েক সপ্তাহে তার পরিষ্কার কিছু আভাস হয়তো পাওয়া যাবে।