সাত দশক ধরে সামরিক শাসনের আবর্তে মিয়ানমার
স্বাধীনতা পাওয়ার পর থেকে বেশির ভাগ সময় মিয়ানমার শাসন করেছে সামরিক বাহিনী। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় নানা আদর্শ ও গোষ্ঠীতে বিভক্ত এই দেশকে পতনের হাত থেকে বাঁচাতে একমাত্র রক্ষাকর্তা হিসেবে বরাবরই নিজেদের তুলে ধরেছেন সামরিক শাসকেরা। সবশেষ এক যুগ আগে গণতন্ত্রের পথে আবার মিয়ানমার যাত্রা শুরু করলেও তা বেশি সময় স্থায়ী হয়নি।
পাঁচ বছর ধরে সামরিক জান্তার শাসনের মুখে মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। এরই মধ্যে ২৮ ডিসেম্বর থেকে দেশটিতে জাতীয় নির্বাচনের আয়োজন করেছে সরকার। এই নির্বাচন কতটা স্বচ্ছ হবে বা তাতে জনগণের মতের কতটা প্রতিফলন হবে, তা নিয়ে দেশ ও দেশের বাইরে বহু বিতর্ক রয়েছে। অনেকেই একে দেখছেন জান্তার ক্ষমতা পোক্ত করার একটি হাতিয়ার হিসেবে।
মিয়ানমারে সামরিক শাসন সম্পর্কে শুরু থেকে জানতে হলে ফিরতে হবে বেশ খানিকটা পেছনে। মিয়ানমার তখন পরিচিত বার্মা নামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে স্বাধীনতা পায় মিয়ানমার। মিয়ানমারের এই স্বাধীনতাসংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন অং সান। তিনি দেশটির কারাবন্দী নেত্রী নোবেলজয়ী অং সান সু চির বাবা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের উৎখাত করতে জাপানের সঙ্গে হাত মিলিয়েছিলেন অং সান। তবে যুদ্ধের মোড় ঘুরে মিত্রপক্ষের দিকে গেলে তিনি আবার দল বদলান। স্বাধীনতার জন্য লন্ডনের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। স্বাধীনতার পর মিয়ানমারে বেশ সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। তবে অভ্যন্তরীণ বিভক্তি এবং বিদ্রোহীদের সঙ্গে লড়াইয়ের মুখে পড়ে বেসামরিক সরকার।
এমন পরিস্থিতিতে ১৯৫৮ সালে সামরিক বাহিনীকে দুই বছরের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এরপর নির্বাচন হয়েছিল। তবে ১৯৬২ সালে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করে নেয় সামরিক বাহিনী। অং সানের একসময়ের সহযোদ্ধা নে উইন দেশ রক্ষার কথা বলে এই পদক্ষেপ নেন। অং সান হত্যার পর এক রহস্যময় পরিস্থিতিতে তিনি সশস্ত্র বাহিনীর নেতৃত্ব নিয়েছিলেন।
নে উইন বলেছিলেন, সময়মতো তিনি মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন; তবে কথা রাখেননি। ২৬ বছর মিয়ানমার শাসন করেন তিনি। কায়েম করেন নামমাত্র সমাজতান্ত্রিক একদলীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা। এতে বিশ্বে মিয়ানমার একঘরে হয়ে পড়ে। এর ফলে যা হওয়ার তা-ই হয়েছিল। অর্থনীতি ধসে পড়ে। ক্ষমতা ধরে রাখতে ভিন্নমত দমনের পথে হাঁটে জান্তা।
এর পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রদের নেতৃত্বে গণতন্ত্রপন্থী আন্দোলনের মুখে ১৯৮৮ সালে পদত্যাগ করেন নে উইন। তখন সামরিক বাহিনীর নতুন নেতৃত্ব আবার অভ্যুত্থান করে। আন্দোলনকারীদের কঠোর হাতে দমন করা হয়। হত্যার শিকার হন ৩ হাজারের বেশি মানুষ। কারাগারে স্থান হয় অনেকের। এরপর ১৯৯২ সালে সামরিক সরকারের দায়িত্ব নেন জেনারেল থান শোয়ে।
২০১১ সালে থান শোয়ে অবসর নেন। ক্ষমতা তুলে দেন বেসামরিক সরকারের হাতে। মিয়ানমারের নতুন নেতা হন প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন। তিনি সু চিকে কারাগার থেকে মুক্তি দেন। ২০১৫ সালে নির্বাচনে বিশাল জয় পায় সু চির দল। ২০২০ সালেও জয় পান তিনি। তবে এই নির্বাচনে জালিয়াতি হয়েছে—এমন অভিযোগ এনে ২০২১ সালে ক্ষমতা দখল করে সামরিক বাহিনী।
জান্তা সরকারের প্রধান হন জেনারেল মিন অং হ্লাইং। আবার কারাবন্দী করা হয় সু চিকে। বিভক্ত হয়ে পড়ে দেশ। শুরু হয় জান্তাবিরোধী সশস্ত্র বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহীরা চান না ২৮ ডিসেম্বরের নির্বাচন হোক। কারণ, এর মাধ্যমে সামরিক শাসন আরও পোক্ত হওয়া ছাড়া অন্য কিছু দেখছেন না তাঁরা। এমনই পরিস্থিতিতে শুরু হতে যাচ্ছে ভোট গ্রহণ। তা শেষ হলে ২০২৬ সালের শেষ নাগাদ হতে পারে ফল প্রকাশ।