চীন-জাপানের কূটনীতির কেন্দ্রে কেন পান্ডা

উয়েনো চিড়িয়াখানায় চার বছর বয়সী পান্ডা শাও শাও বাঁশ খাচ্ছে। ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, টোকিওছবি: রয়টার্স

পান্ডা হচ্ছে অদ্ভুত এক নিরীহ জন্তু। বিশাল দেহ সত্ত্বেও মানুষ কিংবা অন্য প্রাণীর ওপর অযথা এরা চড়াও হয় না। বাঁশ–বনে এদের ছেড়ে দিলে বাঁশের নরম চারা আর অন্যান্য অংশ খেয়ে সময় কাটিয়ে দেয়। এদের কালো রঙের পোঁচটানা বড় চোখের আকর্ষণীয় চেহারা, নাদুসনুদুস দেহ এবং অঙ্গভঙ্গির কারণে মানুষের কাছে, বিশেষ করে শিশুদের কাছে এদের আবেদন তুলনাহীন।

জাপানে সাম্প্রতিক সময়ে পান্ডার এই আবেদন আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কারণ, প্রায় একই রকম দেহাবয়বের প্রাণী ভালুক নিয়ে হাঁসফাঁস খাওয়ার এই সময়ে পান্ডা মানুষের মনে সাহস জোগাচ্ছে। পাশাপাশি আশ্বাস দিচ্ছে, বিশাল দেহের প্রাণী হলেই সবাইকে ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।

সম্ভবত এ কারণেই টোকিওর উয়েনো চিড়িয়াখানায় এখন দেখা যায় মানুষের ভিড়। আর কিছুদিন পর স্কুলের শিক্ষাবর্ষ শেষ আর নববর্ষের ছুটি শুরু হলে আরও বেশি ভিড় জমাবে অল্প বয়সী ছেলেমেয়েরা।

চিড়িয়াখানায় অন্য আরেকটি কারণে সম্ভবত ভিড় হবে। তা হলো, টোকিওর এই চিড়িয়াখানায় এখন মাত্র যে দুটি অল্প বয়সী পান্ডা আছে, আগামী মাসের শেষ দিকে চীনের কাছে এদের ফিরিয়ে দিতে হলে ১৯৭২ সালের পর প্রথমবারের মতো জাপানের সব কটি চিড়িয়াখানা পান্ডাশূন্য হয়ে যাবে। জাপানে আবার কখন পান্ডা দেখা যাবে, তা পরিষ্কার নয়।

চীন অবশ্য পান্ডা পাঠিয়েছিল স্থায়ী উপহার হিসেবে নয়, বরং এমন শর্তে যে নির্ধারিত সময়ের পর এদের যেন চীনে ফেরত পাঠানো হয়।

১৯৭২ সালে চীনের সঙ্গে জাপান স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার পর বেইজিংয়ের কাছ থেকে প্রথম দেশটিতে পান্ডার আগমন শুরু হয়েছিল। এর পর থেকে ৩০টির বেশি পান্ডা চীন থেকে আনা হয়েছে কিংবা জাপানের চিড়িয়াখানায় এদের জন্ম হয়েছে।

চীন অবশ্য পান্ডা পাঠিয়েছিল স্থায়ী উপহার হিসেবে নয়, বরং এমন শর্তে যে নির্ধারিত সময়ের পর এদের যেন চীনে ফেরত পাঠানো হয়। একই সঙ্গে এ রকম আরেকটি শর্ত চীন জুড়ে দিয়েছিল, তাদের কাছ থেকে পাওয়া যুগল পান্ডা শাবক প্রসব করলে সেগুলোর মালিকানাও থাকবে চীনের কাছে। অর্থাৎ চীন চাইলে এদেরও দেশে ফেরত নিয়ে যেতে পারবে।

উয়েনো চিড়িয়াখানায় চার বছর বয়সী লেই লেইয়ের ছবি তুলছেন দর্শনার্থীরা। ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, টোকিও
ছবি: রয়টার্স

সম্পর্কের উত্থান-পতন সত্ত্বেও জাপানের বেশ কয়েকটি চিড়িয়াখানায় পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে পান্ডা ছিল। চীন থেকে আসা পান্ডার বাইরে কয়েকটি পান্ডার জন্ম জাপানেই হয়েছিল। এই দলে বর্তমানে উয়েনো চিড়িয়াখানায় থাকা দুটি কম বয়সী পান্ডাও রয়েছে। শাও শাও এবং লেই লেই নামের সেই দুই পান্ডার জন্ম হয় ২০২১ সালে।

গত নভেম্বরে প্রথম নারী হিসেবে সানায়ে তাকাইচি জাপানের প্রধানমন্ত্রী হন। এর পর থেকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক হঠাৎই হোঁচট খায়। যার জের এখনো চলছে। সেই সূত্রে কূটনৈতিক মঞ্চে পান্ডার আগমন।

মানুষের বেলায় জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব লাভ বিশ্বের অনেক দেশে প্রচলিত থাকলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে জীবজন্তুর বেলায় তা কার্যকর নয়। ফলে জাপানি নাগরিক হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত দুই পান্ডাশাবক। অবশ্য জন্মসূত্রে নাগরিক হওয়ার অধিকার জাপান কিন্তু মানুষের বেলায়ও স্বীকার করে না। যাই হোক, অপ্রাসঙ্গিক হলেও সেই আলোচনা এখানে এ কারণে আসছে, মানুষের কূটনীতির খেলায় এখন পান্ডাকেও টেনে আনা হয়েছে।

গত নভেম্বরে প্রথম নারী হিসেবে সানায়ে তাকাইচি জাপানের প্রধানমন্ত্রী হন। এর পর থেকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক হঠাৎ করেই হোঁচট খায়। যার জের এখনো চলছে। সেই সূত্রে কূটনৈতিক মঞ্চে পান্ডার আগমন। হঠাৎ সম্পর্কের এমন অবনতির পেছনে আছে নভেম্বরের শুরুতে জাপানের সংসদের নিম্নকক্ষের একটি কমিটির সভায় প্রশ্নোত্তর পর্বে তাকাইচির করা একটি মন্তব্য। তিনি বলেছিলেন, তাইওয়ানে জরুরি অবস্থা দেখা দিলে জাপানকে যুদ্ধের জন্য তৈরি থাকতে হবে।

চীন পান্ডা ফেরত চেয়েছে বলে খবর প্রকাশের পর উয়েনো চিড়িয়াখানায় বড় পান্ডা দেখার জন্য দর্শনার্থীদের ভিড়। ১৬ ডিসেম্বর ২০২৫, টোকিও
ছবি: রয়টার্স

প্রধানমন্ত্রী তাকাইচির এই মন্তব্যকে চীন তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জাপানের অকারণ হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখছে। জবাবে জাপানের সঙ্গে সম্পর্কের কিছু কিছু ক্ষেত্রে কঠিন অবস্থান চীন নিতে শুরু করেছে।

শুরুতেই চীন তাদের নাগরিকদের জাপান সফর করা থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানায়। চীন সরকারের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়, জাপানের সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের আলোচনা থেকে দেশের নেতারা বিরত থাকবেন। সেই অনুযায়ী দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত জি২০ শীর্ষ সম্মেলনে চীনের প্রধানমন্ত্রী লি কিয়াং জাপানের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে শীর্ষ সম্মেলনের বাইরে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় অংশ নেননি।

পান্ডা জাপানে এতটা পছন্দের যে এই দেশের চিড়িয়াখানাগুলোতে পান্ডার বসবাসের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে কিছুটা সময় হলেও জাপানের কয়েকটি চিড়িয়াখানা পান্ডাশূন্য থাকবে। এতে সবচেয়ে বেশি আশাহত হবে শিশুরা।

তাইওয়ানকে চীন নিজেদের ভূখণ্ড বলে মনে করে এবং চীনের সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার সময় পশ্চিমের দেশগুলোর পাশাপাশি জাপানও চীনের সেই অবস্থান মেনে নিয়ে তাইওয়ানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্কের সমাপ্তি টেনেছিল। ফলে তাইওয়ানে জাপান ও পশ্চিমের কোনো দেশের দূতাবাস কিংবা রাষ্ট্রদূত নেই।

পরে অবশ্য চীনের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্কের টানাপোড়েন শুরু হলে পশ্চিমের বিভিন্ন দেশ আগের সেই অবস্থান থেকে সরে আসতে শুরু করে। তবে জাপান এখনো তাইওয়ানের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেনি। এ কারণেই চীন তাকাইচির মন্তব্যকে চীনের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ হিসেবে উল্লেখ করে অভিযোগ করেছে, জাপানের প্রধানমন্ত্রী নিষিদ্ধ সীমারেখা অতিক্রম করেছেন।

সম্পর্কের ধারাবাহিক অবনতির কারণে চীন এখন পান্ডাকে কূটনীতির মঞ্চে নিয়ে এসেছে। তারা জাপানে থাকা সব কটি পান্ডা দেশে ফিরিয়ে নিতে চাইছে। জাপানের বিভিন্ন চিড়িয়াখানায় দেশের বাইরে থেকে আসা প্রাণীর বিষয় নিয়ে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে আলোচনায় কেন্দ্রীয় সরকার নয়, থাকে স্থানীয় সরকার। উয়েনো চিড়িয়াখানার পান্ডা নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে চলা আলোচনায় জাপানের পক্ষ থেকে অংশ নিয়েছিল টোকিও মেট্রোপলিটন সরকার।

জাপানে জন্ম নেওয়া দুই পান্ডা শাও শাও এবং লেই লেইয়ের টোকিও চিড়িয়াখানায় অবস্থানের অনুমতি ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাকলেও চীন এখন জানুয়ারিতেই এদের ফেরত পাঠাতে বলছে। পান্ডা ফেরত পাঠানোর বিষয়ে জাপান এখনো কোনো সিদ্ধান্ত জানায়নি। শাও শাও এবং লেই লেইয়ের চীন থেকে আসা বাবা–মা রি রি এবং শিন শিনকে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে চীনে ফেরত পাঠানো হয়। জাপানে জন্ম নেওয়া এদের বড় বোন শান শান ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে দেশে ফিরে গেছে।

এর বাইরে ওয়াকাইয়ামার শিরাহামা অ্যাডভেঞ্চার ওয়ার্ল্ডে বড় হয়ে ওঠা চারটি পান্ডাকে এ বছরের জুনে চীনে ফেরত পাঠানো হয়েছে। ফলে টোকিও চিড়িয়াখানার শেষ দুই পান্ডাকে জানুয়ারিতে চীনে ফেরত পাঠানো হলে জাপান পান্ডাশূন্য হয়ে যাবে। এতে শিশুদের পাশাপাশি বয়স্ক অনেক নারী-পুরুষও পান্ডা দেখার আনন্দানুভূতি থেকে বঞ্চিত হবেন।

উয়েনো চিড়িয়াখানায় শিন শিনের পাশে হাঁটছে পান্ডাশাবক শিয়াং শিয়াং। ১৯ ডিসেম্বর ২০১৭, টোকিও
ছবি: রয়টার্স

জাপান সরকার বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। তবে পান্ডার ফিরে আসা নিয়ে চীনের কাছ থেকে এখনো ইতিবাচক কোনো ইঙ্গিত তারা পায়নি। জাপানের মন্ত্রিসভার প্রধান সচিব মিনোরু কিহারা আশা প্রকাশ করেছেন, পান্ডা পাঠানোর পরও দুই পক্ষের মধ্যে আদান-প্রদান ভবিষ্যতেও অব্যাহত থাকবে।

চীন জাপানের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রত্যাহার করে নেওয়ার আহ্বান জানালেও টোকিওর পক্ষ থেকে সেই অনুরোধ মেনে নেওয়া হয়নি। কারণ, দেশের ভেতরে জাতীয়তাবাদী ধারায় অনুপ্রাণিত বিভিন্ন গোষ্ঠী এতে ক্ষুব্ধ হতে পারে। পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী তাকাইচি নিজেও অনেকটা সে রকম ভাবধারায় প্রভাবিত হওয়ায় চীনের আহ্বান এড়িয়ে গিয়ে ভিন্ন পথে সমস্যার সমাধান খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছেন।

অন্যদিকে চীন কত দিন কঠোর অবস্থান ধরে রাখবে, তা এখনো পরিষ্কার নয়। পান্ডা জাপানে এতটা পছন্দের যে এই দেশের চিড়িয়াখানাগুলোতে পান্ডার বসবাসের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে কিছুটা সময় হলেও জাপানের কয়েকটি চিড়িয়াখানা পান্ডাশূন্য থাকবে। এতে সবচেয়ে বেশি আশাহত হবে শিশুরা।