সুখের খোঁজে বাংলাদেশ ছেড়ে তাঁদের ‘দাসের জীবন’
বাংলাদেশে ব্যবসা করতেন মুস্তাফিজুর শাহীন। ভালো চাকরির খোঁজে পাড়ি জমান বিদেশে। তবে দেশ ছাড়ার সময় তিনি হয়তো কল্পনাও করতে পারেননি, প্রশান্ত মহাসাগরের এক দ্বীপরাষ্ট্রে গিয়ে ‘ক্রীতদাসের’ জীবন হবে তাঁর। জোরপূর্বক কাজ করিয়ে নেওয়া হবে। খাবার ও পারিশ্রমিক পাবেন না। শিকার হবেন শারীরিক নির্যাতনের।
অথচ আজীবন সুখে থাকতে পারবেন, এই আশায় বিদেশে পাড়ি জমান ৫০ বছরের শাহীন। তাঁকে বলা হয়েছিল, একজন কোটিপতি উদ্যোক্তার সঙ্গে কাজ করতে হবে। সেই উদ্যোক্তার রয়েছে পোশাকের ব্যবসা। জায়গায় জায়গায় আছে দোকান। কিন্তু এসবের কিছুই পাননি শাহীন। উল্টো আধুনিক ‘দাসত্বের’ শিকার হতে হয়েছে।
শাহীন বললেন, একটা সময় তাঁর মনে হতো, তিনি কোনোমতে বেঁচে আছেন, কিন্তু দেহে প্রাণ নেই। বাংলাদেশ ছেড়ে প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র ভানুয়াতু যাওয়ার পরে তাঁর সঙ্গে ঘটা অমানবিক সব ঘটনার বর্ণনা এভাবেই করলেন তিনি। বললেন, অনাহারে–অর্ধাহারে দিন কাটাতে হয়েছে। সব সময় আতঙ্কে থাকতে হয়েছে।
এর মধ্যেও সাহস হারাননি শাহীন। কোনোমতে ওই বন্দিদশা থেকে পালাতে সক্ষম হন। এরপরে তাঁর ওপর কেমন অমানবিক নির্যাতন চালানো হয়েছে, পুলিশকে তার সব জানান। শাহীন বলেন, ‘আমার কথা বলার মতো শক্তি ছিল না। মন ভেঙে খান খান হয়ে গেছে। আমার সব স্বপ্ন–আশা ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে।’
তবে শাহীন ভানুয়াতু গিয়ে এ ধরনের অকথ্য নির্যাতনের শিকার একমাত্র বাংলাদেশি নন। ২০১৭–১৮ সালের মধ্যে তাঁর মতো আরও শতাধিক বাংলাদেশি দেশটিতে এ ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যে মানব পাচার চক্র তাঁদের সঙ্গে এ প্রতারণা করেছে, তার মূল হোতা শেকদাহ সুমন নামের এক বাংলাদেশি। তিনি নিজেকে আন্তর্জাতিক একটি পোশাক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার হিসেবে পরিচয় দিতেন।
এভাবে ১০৭ বাংলাদেশি নাগরিক ভানুয়াতু গিয়ে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। প্রশান্ত মহাসাগরের এই দ্বীপরাষ্ট্রে মানব পাচার এবং সেখানে গিয়ে আধুনিক দাসত্বের শিকারের এর চেয়ে বড় কোনো ঘটনার কথা আগে কখনো জানা যায়নি।
পাঁচ বছর আগে শাহীন ও তাঁর সঙ্গে থাকা অন্য বাংলাদেশিদের সঙ্গে প্রতারণা ও অকথ্য নির্যাতনের এ ঘটনা জানাজানি হয়। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, এখনো অনেকেই ‘উন্নত জীবনের’ আশায় ভানুয়াতুর মতো দেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। সেখানে গিয়ে অবৈধ অভিবাসী আর দাসত্বের জীবনই যাপন করতে হচ্ছে তাঁদের।
যেভাবে প্রতারিত শাহীন
শাহীনের জীবনে এই দুর্ভোগের শুরু ২০১৮ সালের জুনের এক দুপুরে। এদিন তিনি টাঙ্গাইলের এক বাসস্টপেজে বাংলাদেশি ব্যবসায়ী শেকদাহ সুমনের সহযোগীদের সঙ্গে প্রথম দেখা করেন। শাহীনকে সেদিন বলা হয়, শেকদাহ সুমন হলেন একজন কোটিপতি ব্যবসায়ী। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পোশাক বিক্রির ব্যবসা রয়েছে সুমনের।
তবে সুমনের সহযোগীদের কাছ থেকে শোনা কথা বিশ্বাস করলেও নিশ্চিত হতে চাচ্ছিলেন শাহীন। তাঁকে বলা হয়েছিল, সুমন দক্ষিণ আফ্রিকার জনপ্রিয় ফ্যাশন ব্র্যান্ড মিস্টার প্রাইসে কাজ করেন। অনলাইনে এটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটিও করেন সুমন।
ভানুয়াতুর একটি স্থানীয় সংবাদপত্রের অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পান শাহীন। ওই প্রতিবেদন থেকে জানতে পারেন, ভানুয়াতুতে ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছে মিস্টার প্রাইস। ওই প্রতিবেদনে সুমন ও ভানুয়াতুর কয়েকজন মন্ত্রীকেও উদ্ধৃত করা হয়। ভানুয়াতুতে মিস্টার প্রাইসের ব্যবসা শুরুর বিষয়ে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেন তাঁরা। এসব দেখেই বিষয়টি বিশ্বাস করে নেন শাহীন।
সব দেখে ভানুয়াতু যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন পোশাক বিক্রেতা শাহীন। তাঁর ব্যবসাও ভালোই চলছিল। সেই ব্যবসা দেখিয়ে ঋণ নেন। চাকরি নিয়ে ভানুয়াতু যাওয়ার জন্য সহযোগীদের মাধ্যমে সুমনকে কয়েক হাজার মার্কিন ডলার দেন। ব্যাগ গুছিয়ে স্ত্রী–সন্তান আর পরিবারের সদস্যদের বিদায় জানিয়ে ফ্লাইটে উঠে পড়েন।
শাহীনের ভানুয়াতু যাওয়ার এ ঘটনা পাঁচ বছর আগের। এখনো তাঁর দেশে ফেরা হয়নি। ভানুয়াতুর রাজধানী পোর্ট ভিলার বিমানবন্দরে অবতরণ করার পরই সুমনের লোকজন তাঁর পাসপোর্ট কেড়ে নেন। তাঁকে নিয়ে রাখা হয়ে সমুদ্রপারের পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে। সেখান থেকে শাহীনকে কোথাও যেতে দেওয়া হতো না।
শাহীন ভানুয়াতুতে পৌঁছানোর দিন কয়েকজন বাংলাদেশি তাঁকে ঘুষি মারতে মারতে নিয়ে যান। সুমনের হয়ে কাজ করা এসব বাংলাদেশি তাঁকে নির্যাতন করেন। এখানে শেষ নয়, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তাঁর কাছ থেকে নেয় আরও ১৪ হাজার ডলার।
শাহীনের মতো ‘দুর্ভাগারা’
কয়েক মাসের মধ্যে শাহীনের মতো করে আরও কয়েক ডজন বাংলাদেশিকে ভানুয়াতু নিয়ে যান সুমন। তাঁদের অনেককে অস্ট্রেলিয়া, কিউবা, ফ্রান্সের নিউ ক্যালেডোনিয়ায় সুমনের মিস্টার প্রাইসে কাজ দেওয়ার কথা বলে নিয়ে যাওয়া হয়।
ব্যবসাসংক্রান্ত ভুয়া নথি ও লাইসেন্সের সঙ্গে ঘুষ দেওয়ার মাধ্যমে পাচারকারীরা এসব বাংলাদেশিকে ভানুয়াতু নিয়ে যান। সুমনের প্রতারণার শিকার হয়ে ভানুয়াতু যাওয়া এসব মানুষ হয়ে যান তাঁর ‘দাস’। সেখানে নেওয়ার পর তাঁদের দিয়ে জোরপূর্বক কাজ করাতে শুরু করেন। এসব ব্যক্তিকে দিয়ে কাঠের আসবাব বানিয়ে নেন। এরপর তাঁদের দিয়েই সেগুলো বিক্রি করেন। তাঁরা কাজ করতে না চাইলে করা হয় মারধর। পারিশ্রমিক পেতেন না, জুটত না দুবেলা খাবারও।
রাগ, ক্ষোভ ও হতাশার মধ্যেই এক সকালে বড় এক সুযোগ আসে শাহীন এবং তাঁর সঙ্গে থাকা আরও তিন বাংলাদেশির। কাজের ফাঁকে তাঁদের একটু জিরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এ সময় ঘুমিয়ে পড়েন তাঁদের দেখভালের দায়িত্বে থাকা সুমনের লোকজন। এই সুযোগে তাঁরা পালিয়ে যান। সরাসরি চলে যান এক থানায়।
এরপর ভানুয়াতুর সরকারি কর্তৃপক্ষ সুমনের প্রতারণার বিষয়টি জানতে পারে। সুমন, তাঁর স্ত্রী ও দুই সহযোগীর খোঁজ পাওয়া যায়। এরপর একদিন গ্রেপ্তার করা হয় সুমনকে। সুমন দাবি করেন, ‘বাংলাদেশি নন, তিনি জিম্বাবুয়ের নাগরিক। পরে তদন্তে জানা যায়, নিজের নামে জিম্বাবুয়ের ভুয়া এই পাসপোর্ট বানিয়েছেন সুমন।
কয়েক বছর ধরে বিচার চলার পর গত বছরের জুনে মানব পাচার, মানুষকে দাসের মতো ব্যবহার, অর্থ পাচার, নির্যাতন, হত্যার হুমকি, অবৈধভাবে প্রবেশ করার অভিযোগ সুমন (৩৮), তাঁর স্ত্রী নাবিলাহ বিবি (২৮) ও দুই সহযোগীর কারাদণ্ড হয়।
রায় ঘোষণা করে ভানুয়াতুর প্রধান বিচারপতি ভিনসেন্ট লুনাবেক লিখেছিলেন, ‘শেকদাহ সুমন প্রতিনিয়ত এসব ব্যক্তিকে হুমকির মধ্যে রাখতেন। তাঁদের হত্যাসহ নানাভাবে হুমকি দিতেন। বলতেন, তিনি চাইলে তাঁদের ওপর গাড়ি চালিয়ে হত্যা, কেটে গাছে ঝুলিয়ে রাখা, ভয়ার্ত জঙ্গলে ফেলে আসা বা রেফ্রিজারেটরের ভেতর ঢুকিয়ে রাখতে পারেন। মাঝেমধ্যে এ হুমকিও দেওয়া হতো, তাঁদের হত্যার পর মরদেহের ছবি তুলে পরিবারের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হবে।’
বড় ঝুঁকিতে বাংলাদেশ
অভিবাসী পাঠানোর ক্ষেত্রে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। বাংলাদেশ থেকে যাঁরা বিদেশে যান, তাঁদের সিংহভাগকে দালালদের মাধ্যমে প্রচুর টাকা খরচ করতে হয়। এ কারণে প্রতিবছর হাজার হাজার বাংলাদেশি মানব পাচারকারীদের খপ্পরে পড়েন। ভালো চাকরি ও কাজের কথা বলে তাঁরা এসব মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেন।
মানব পাচারের বৈশ্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গত বছর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে দেখা যায়, প্রতিবছর বিশ্বজুড়ে অসংখ্য মানব পাচারের ঘটনা ঘটে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে প্রতারণার শিকার এসব মানুষের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হলো বাংলাদেশি।
আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) বাংলাদেশ মিশনের প্রধান আবদুস সাত্তার ইজোয়েভ বলেন, মানব পাচারের শিকার মানুষের সিংহভাগকে বড় ধোঁকা দেওয়া হয়। বলা হয়, তিনি বিদেশে গেলেই তাঁর পরিবার ও সন্তানের উন্নত জীবন নিশ্চিত।
আবদুস সাত্তার বলেন, ‘বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন পূরণে অনেক ব্যক্তি তাঁর সহায়–সম্পত্তি ও আজীবনের সঞ্চয় বিনিয়োগ করেন। বিশেষ করে উন্নত দেশে যাওয়ার ক্ষেত্রে এটা বেশি। কিন্তু শেষে গিয়ে দেখা যায়, তারা মানব পাচারের শিকার। এতে ঋণগ্রস্ত, জোরপূর্বক শ্রম, নির্যাতন এবং যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হয় তাঁদের।’
ভাষান্তর (সংক্ষেপিত): আল–আমিন সজীব