বাংলাদেশ ও বিশ্বজুড়ে বাঙালিরা যখন নতুন বাংলা সনের আবহে স্নাত হচ্ছেন, বাঙালি খাবার, পোশাক কিংবা গান-কবিতায় নিজের বাঙালিত্ব প্রকাশ করছেন, তখন একেবারে ভিন্ন এক স্থান ও আবহে জাপানের ওসাকা নগরীতেও গতকাল ১৪ এপ্রিল উদ্যাপিত হলো পয়লা বৈশাখ।
না, এটি সচরাচর প্রবাসী বাঙালিদের আয়োজনে কোনো মিলনায়তন বা উদ্যানে আয়োজিত কোনো অনুষ্ঠান নয়, বরং ওসাকা এক্সপো ২০২৫ বা বিশ্ব প্রদর্শনীর অনন্য সমাবেশে এই উদ্যাপনের গুরুত্ব ব্যাপক।
এর মধ্য দিয়ে মূলত নিজের সাংস্কৃতিক পরিচয় তুলে ধরার সুযোগ পেল বাংলাদেশের মানুষ বিশ্ববাসীর কাছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন জাপানে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ দাউদ আলীসহ দূতাবাসের অন্যান্য কর্মকর্তা এবং স্থানীয় অনেক বাংলাদেশি। খোলা মঞ্চে সাংস্কৃতিক সংগঠন মাদল ‘ধনধান্য পুষ্পভরা’সহ নানা বাংলা গান পরিবেশন করে।
এর আগে ১৩ এপ্রিল রোববার সকালে ওসাকায় কৃত্রিমভাবে নির্মিত দ্বীপ ইউমেশিমায় বেশ জাঁকজমকপূর্ণভাবেই উদ্বোধন হয়ে গেল ওসাকা এক্সপো ২০২৫। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সম্রাট নারুহিতো ও সম্রাজ্ঞী মাসাকো, যুবরাজ আকিশিনো, রাজকুমারী কিকো, প্রধানমন্ত্রী ইশিবা শিগেরু এবং ওসাকার গভর্নর ইয়োশিমুরা হিরোফুমিসহ আমন্ত্রিত ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। সম্রাটের বক্তব্যের পর ওসাকা এক্সপোর সম্মানিত সভাপতি যুবরাজ আকিশিনো একটি স্বচ্ছ প্লেটের ওপর তাঁর হাতের ছাপ রেখে প্রদর্শনীর উদ্বোধনী ঘোষণা করেন।
একটি ফিতা কাটার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে জনগণের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে দ্বার খুলে দেওয়া হয় প্রদর্শনীস্থলের। এক্সপোর দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী ইতো ইয়োশিতাকা, এক্সপো তত্ত্বাবধানকারী সমিতির প্রধান তোকুরা মাসাকাযুসহ অন্য কর্মকর্তারা এতে উপস্থিত ছিলেন। আরও উপস্থিত ছিল প্রদর্শনীর মাস্কট হিসেবে ভূমিকা রাখা কোষ এবং পানির সংমিশ্রণে জন্মানো এক রহস্যময় প্রাণী মিয়াকু মিয়াকু। এ সময় এক্সপোর প্রতীক হিসেবে বিবেচিত ‘গ্র্যান্ড রিং’ বা বিশালাকারের কাঠের বেষ্টনীর ওপর উপস্থিত হাজার দশেক মানুষের কণ্ঠে ধ্বনিত হয় বিথোভেনের ৯ নম্বর সিম্ফনি। প্রদর্শনীতে থাকা প্যাভিলিয়নগুলোর চারপাশ ঘিরে এই বেষ্টনী স্থাপিত হয়েছে। প্রায় ২ কিলোমিটার পরিধির এই স্থাপনা গত মাসে বিশ্বের বৃহত্তম কাঠের নির্মিত কাঠামো হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের স্বীকৃতি পেয়েছে। এর মাধ্যমে মূলত একই চক্রের ভেতর বিশ্বের সব জাতির মধ্যকার ঐক্য এবং আন্তসহযোগিতার বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে।
‘আমাদের জীবনের জন্য ভবিষ্যৎ সমাজ গঠন’ প্রতিপাদ্যের ওপর ভিত্তি করে আগামী ১৩ অক্টোবর পর্যন্ত ছয় মাস ধরে এই প্রদর্শনী চলার কথা রয়েছে। বিশ্বের মোট ১৫৮টি দেশ ও ভূখণ্ড এতে অংশ নিচ্ছে। এর পাশাপাশি জাতিসংঘ এবং রেডক্রসের মতো সাতটি আন্তর্জাতিক সংগঠনের অংশগ্রহণও এতে রয়েছে।
ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে দেখা যাবে, নানান জাতি ও সংস্থার অংশগ্রহণে বৈশ্বিক এই বিশাল আয়োজনের শুরু ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। ১৮৫১ সালে লন্ডনে প্রথম ওয়ার্ল্ড এক্সপো বা গ্রেট এক্সিবিশন অনুষ্ঠিত হয়। পরে এটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেলে বিশ্বজুড়ে এর আয়োজন অব্যাহত থাকে। ১৯২৮ সালে এই মেগা-ইভেন্টগুলোকে নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের জন্য গঠিত হয় ব্যুরো ইন্টারন্যাশনাল দিজেক্সপজিশন বা বিআইই নামে একটি সংস্থা। এর পর থেকে সমকালীন চ্যালেঞ্জগুলোর সমাধান খুঁজে বের করার লক্ষ্যে মানবজাতির জ্ঞান উন্নতকরণ প্রচেষ্টা, মানবিক ও সামাজিক আকাঙ্ক্ষা ধারণ এবং বৈজ্ঞানিক, প্রযুক্তিগত, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অগ্রগতি তুলে ধরাই এই আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্যে পরিণত হয়। এতে শুধু লাখ লাখ দর্শনার্থীর সমাগমই ঘটে না, এর মাধ্যমে আয়োজক শহরটিরও হয় আমূল পরিবর্তন।
জাপান শুরু থেকেই বিআইইর সদস্য এবং এ পর্যন্ত মোট পাঁচটি এক্সপোর সফল আয়োজক। এর মধ্যে ১৯৭০ সালে এই ওসাকাতেই আয়োজন করা হয়ে এশিয়ার প্রথম ওয়ার্ল্ড এক্সপোর। এর মোট দর্শনার্থীর সংখ্যা ছিল ৬ কোটি ৪০ লাখের বেশি। এটিকে ধরা হয় ২০ শতকের সবচেয়ে বেশি পরিদর্শন করা এক্সপো হিসেবে। তারপর থেকে ২০০৫ সালে আইচিতে আয়োজিত এক্সপোর পাশাপাশি ১৯৭৫ সালে ওকিনাওয়ায় এবং ১৯৮৫ সালে সুকুবায় দুটি বিশেষায়িত এক্সপোসহ ১৯৯০ সালে ওসাকাতেই একটি হর্টিকালচারাল এক্সপোর আয়োজন করে জাপান। তবে নতুন বাস্তবতায় এবারের আয়োজনের বাজেট নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। প্রাথমিকভাবে নির্মাণ ব্যয় প্রায় ৮৭ কোটি ডলার ধরা হলেও ব্যয়ের পরিমাণ শেষ পর্যন্ত ১৬৪ কোটি ডলারে গিয়ে ঠেকেছে। নির্মাণসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধি এবং অনুষ্ঠানের অন্যতম মূল আকর্ষণ গ্র্যান্ড রিং বা বিশালাকারের কাঠের কাঠামোর নকশা পরিবর্তন এতে ভূমিকা রেখেছে। গ্র্যান্ড রিংয়ের নির্মাণকাজ শুরু হয়েছিল ২০২৩ সালের জুন মাসে এবং চলতি বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি এটি শেষ হয়। প্রকল্পটি নির্মাণ সংস্থা ওবাইয়াশি করপোরেশন, শিমিযু করপোরেশন এবং তাকেনাকা করপোরেশন সম্মিলিতভাবে বাস্তবায়ন করে। এক্সপোর আইকনিক স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য হিসেবে নকশা করা গ্র্যান্ড রিংয়ের কাঠের স্থাপনাটি প্রায় ৬১ হাজার বর্গমিটার এলাকাজুড়ে বিস্তৃত। এটি ১২ থেকে ২০ মিটার লম্বা, এর প্রস্থ ৩০ মিটার এবং বাইরের ব্যাস প্রায় ৬৭৫ মিটার। এর পেছনে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২৩ কোটি ডলার, যা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনাও কম নয়। বিশেষ করে করোনাভাইরাসের আবহে অনুষ্ঠিত ‘টোকিও অলিম্পিক ও প্যারালিম্পিক ২০২০’ আর্থিকভাবে খুব একটা লাভবান না হওয়ায় এবারের এক্সপোতে এত বিশাল ব্যয় নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকেই। এর পাশাপাশি এক্সপো শেষ হয়ে যাওয়ার পর এই বিশাল কাঠামো সংরক্ষণ নাকি পুনর্ব্যবহার করা উচিত, তা নিয়েও এখন জোর আলোচনা চলছে। শুরুতে এটি ভেঙে এর উপকরণগুলো পুনর্ব্যবহারের পরিকল্পনা থাকলেও নতুন পরিকল্পনায় কাঠামোর কিছু অংশের সংরক্ষণও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, বিষয়টি যদিও এখনো চূড়ান্ত নয়।
যাই হোক, এবারের এক্সপোতে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর নির্মিত ৪২টি প্যাভিলিয়ন রয়েছে, যার মধ্যে বাংলাদেশেরও রয়েছে একটি সুনির্দিষ্ট স্থান। বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ফিতা কেটে দর্শকদের জন্য এর দুয়ার উন্মোচন করেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোহাম্মদ আবদুর রহিম খান এবং জাপানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ দাউদ আলী। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ছাড়াও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর কয়েকজন কর্মকর্তা এক্সপোর উদ্বোধন উপলক্ষে জাপান সফরে এসেছেন। প্যাভিলিয়নে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের পাশাপাশি দেশের শিল্প, সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বিভিন্ন দিকের পরিচিতি তুলে ধরা হয়েছে। এর বাইরে চীন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালিসহ বেশ কয়েকটি দেশের প্যাভিলিয়ন ইতিমধ্যে খুলে দেওয়া হলেও কিছু কিছু এখনো নির্মাণাধীন অবস্থায় রয়েছে, যা এক্সপো চলাকালীন একে একে উন্মুক্ত করা হবে।
এবারের এক্সপোর একটি বিশেষ দিকই হচ্ছে পরিবেশ উপযোগী প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের প্রদর্শনী। এর একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে জাপানের নিজস্ব উদ্ভাবন, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে উড়ন্ত গাড়ি, আইপিএস সেল দিয়ে তৈরি কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড কিংবা বায়ো-ইলুমিনেশনকে কাজে লাগানো বৃক্ষ বিচ্ছুরিত আলো, যা কিনা ভবিষ্যতে বৈদ্যুতিক সড়ক বাতির বিকল্প হয়ে উঠতে পারে। প্রদর্শনীতে এমন উদ্ভাবনও রয়েছে, যা অতীত এবং বর্তমানের মধ্যে সংযোগ সেতু হিসেবে কাজ করছে। যেমন ১৯৭০ সালের ওসাকা এক্সপোতে গোসলের জন্য একটি স্বয়ংক্রিয় বিশেষ যন্ত্র প্রদর্শন করা হয়েছিল। এটি পরবর্তী সময়ে বাজারে বাণিজ্যিকভাবে না এলেও এ বছর তারই অত্যাধুনিক সংস্করণ উপস্থাপিত হচ্ছে। জাপানের বয়োবৃদ্ধ সমাজকে মাথায় রেখে উদ্ভাবিত এই গোসলের যন্ত্রে মানুষের দৈহিক পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত করে মাইক্রো বাবল বা বুদ্বুদ। ভবিষ্যৎ সমাজের এ রকম নানামুখী অত্যাধুনিক উদ্ভাবন দিয়ে সজ্জিত এবারের এক্সপো। প্রতিদিন লাইন ধরে দর্শনার্থীরা সরাসরি যার সংস্পর্শে আসার সুযোগ পাচ্ছেন। এ ছাড়া যেকোনো লেনদেন হচ্ছে সম্পূর্ণ নগদবিহীন পদ্ধতিতে।
পরিশেষে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজনের কথা না বললেই নয়, প্রদর্শনীতে জাতিসংঘেরও একটি প্যাভিলিয়ন রয়েছে, যেখানে গাজা এবং ইউক্রেন যুদ্ধের আবহ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বস্তুগত এবং শব্দগত অনুষঙ্গের মধ্য দিয়ে, যা মানুষকে সংঘাতের মারাত্মক দিকের কথা স্মরণ করিয়ে দেবে। মোটের ওপর সংঘাতপূর্ণ চলমান বিশ্বে জাতিতে জাতিতে ঐক্য এবং সৌহার্দ্য গড়ে তোলার এক অনন্য সুযোগ এনে দিয়েছে ২০২৫ সালের ওসাকা কানসাই এক্সপো।
পয়লা বৈশাখের মতো সর্বজনীন উৎসব পালনের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশের উপস্থিতিও সেখানে একই বার্তাই তুলে ধরেছে বলে ধরে নেওয়া যায়।