ছয় শিশুসহ ৬৮ জনের মরদেহ উদ্ধার

ইয়েতি এয়ারলাইনসের বিধ্বস্ত উড়োজাহাজটিতে চলছে উদ্ধারকাজ। ১৫ জানুয়ারি, নেপালের পোখারায়
ছবি: এএফপি

নেপালে গত মে মাসে তারা এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে এটির ২২ আরোহীর সবাই নিহত হন। বছর (১২ মাস) না পেরোতেই আবার ভয়াবহ বিমান দুর্ঘটনা। এবারও দুর্ঘটনার কবলে দেশটির আরেকটি অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট। এ দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন অন্তত ৬৮ জন। তাদের মধ্যে নবজাতক ও শিশু ছয়জন। খবর এএফপি ও রয়টার্সের।

আরোহীদের মধ্যে ১৫ জন বিদেশি নাগরিক ছিলেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ। অন্য আরোহীদের সবাই নেপালি। বিদেশিদের মধ্যে পাঁচজন ভারতীয়, চারজন রুশ, দুজন কোরীয় এবং আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনার একজন করে নাগরিক রয়েছেন।

বিশ্বে পর্যটনের জন্য আকর্ষণীয় গন্তব্যস্থলগুলোর অন্যতম নেপালে সাম্প্রতিকতম এ দুর্ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে ভারত, রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশের নাগরিক রয়েছেন।

রোববার নেপালের পোখারা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৭২ জন আরোহী নিয়ে ইয়েতি এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়। এ দুর্ঘটনায় অন্তত ৬৮ জন নিহত হওয়ার কথা নিশ্চিত করেছে দেশটির পুলিশ। প্রাণহানি বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

দুর্ঘটনার পরপরই নেপালের প্রধানমন্ত্রী পুষ্প কমল দহল মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক ডাকেন। রাষ্ট্রীয় সংস্থাগুলোকে উদ্ধারকাজে সহায়তা করার আহ্বান জানান তিনি। গত তিন দশকের মধ্যে দেশটির বিমান পরিবহন খাতে সংঘটিত সবচেয়ে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা এটি।

নেপালের সিভিল এভিয়েশন কর্তৃপক্ষের বরাতে খবরে বলা হয়, স্থানীয় সময় রোববার সকাল ১০টা ৩৩ মিনিটে কাঠমান্ডু থেকে পোখারার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় ইয়েতি এয়ারলাইনসের ‘৯ এন-এএনসি এটিআর ৭২’ মডেলের উড়োজাহাজটি। বেলা ১১টার কিছু আগে পোখারার স্থানীয় ও নতুন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের মাঝামাঝি এটি বিধ্বস্ত হয়ে টুকরা টুকরা হয়। আরোহীদের মধ্যে ৬৮ জন যাত্রী ও ৪ জন ক্রু ছিলেন।

উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ৪৫ দিনের মধ্যে কমিটি প্রতিবেদন দিতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিষ্ণু প্যাডেল, নেপালের অর্থমন্ত্রী

উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ার কিছুক্ষণ পর পুলিশ কর্মকর্তা এ কে ছেত্রী এএফপিকে বলেন, ‘৩১ জনের লাশ হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। ৬০০ ফুট গভীর খাতে বিধ্বস্ত হওয়া উড়োজাহাজটির পোড়া ধ্বংসাবশেষের নিচে আরও ৩৬ জনের লাশ চাপা পড়ে আছে।’ সেনাবাহিনীও এ তথ্য আংশিক নিশ্চিত করে। পরে মৃতের সংখ্যা ৬৮ নিশ্চিত করা হয়।

সেনাবাহিনীর মুখপাত্র কৃষ্ণ প্রসাদ ভান্ডারি বলেন, গভীর খাতে উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ায় হতাহত ব্যক্তিদের উদ্ধার অভিযানে বিঘ্ন ঘটছে। তবে অভিযান অব্যাহত আছে। এ পর্যন্ত কাউকে জীবিত উদ্ধার করা যায়নি।

অবশ্য স্থানীয় একজন কর্মকর্তা বলেন, কয়েকজনকে জীবিত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। তাঁর এ তথ্য ইয়েতি এয়ারলাইনস বা অন্য কোনো পক্ষ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

আরোহীদের মধ্যে ১৫ জন বিদেশি নাগরিক ছিলেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ। অন্যরা সবাই নেপালি। বিদেশিদের মধ্যে পাঁচজন ভারতীয়, চারজন রুশ, দুজন কোরীয় এবং আয়ারল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ফ্রান্স ও আর্জেন্টিনার একজন করে নাগরিক রয়েছেন।

এ দুর্ঘটনার কিছু ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার হয়। তাতে দেখা যায়, উড়োজাহাজটির ধ্বংসস্তূপ থেকে অগ্নিশিখা ও কালো ধোঁয়া বের হচ্ছে। ছবিগুলোর সত্যতা তাৎক্ষণিকভাবে যাচাই করা যায়নি। যাচাই করা যায়নি এমন একটি ভিডিও ক্লিপে দেখা যায়, একটি উড়োজাহাজ এক আবাসিক এলাকার ওপর অনেকটা নিচু দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সেটি বাঁয়ে মোড় নেয়। পরপরই প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দ হয়।ইয়েতি এয়ারলাইনসের ওয়েবসাইটে বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার শিকার উড়োজাহাজটি নেপালের অভ্যন্তরীণ রুটে চলত। এই প্রতিষ্ঠানটির আওতায় নেপালের আকাশসেবা সংস্থা তারা এয়ার রয়েছে। ইয়েতি ও তারা মিলে দেশটির সবচেয়ে বিস্তৃত এয়ার নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে প্রতিষ্ঠানটি।

আরও পড়ুন

খারাপ রেকর্ড

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নেপালের বিমান পরিবহন খাতে তেজিভাব লক্ষ করা যাচ্ছে। অনেক দুর্গম এলাকায়ও আকাশপথে পরিবহন করা হচ্ছে যাত্রী ও পণ্যসামগ্রী। তবে প্রশিক্ষণ ও যথাযথ ব্যবস্থাপনার ঘাটতিতে এ খাতে নিরাপত্তাব্যবস্থা দুর্বল হয়ে আছে। নিরাপত্তার উদ্বেগের কারণে দেশটির সব উড়োজাহাজের জন্য নিজের আকাশপথ ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

বিশ্বে দুর্গম এলাকায় অবস্থিত ও ঝুঁকিপূর্ণ যেসব রানওয়ে রয়েছে, সেসবের কয়েকটি নেপালে। এই রানওয়েগুলোতে দক্ষ বিমানচালকদেরও উড়োজাহাজ অবতরণ করানো চ্যালেঞ্জের বিষয়। তা ছাড়া ফ্লাইট পরিচালনায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা বলছেন, আবহাওয়ার নির্ভুল পূর্বাভাস দেওয়ার মতো প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও সরঞ্জামের ঘাটতি রয়েছে নেপালে। বিশেষত দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলের আবহাওয়ার সঠিক পূর্বাভাস দেওয়াটা কঠিন। অতীতে বড় বড় দুর্ঘটনার কয়েকটি ঘটেছে এসব এলাকায়।

তদন্ত কমিটি

সর্বশেষ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে একটি তদন্ত প্যানেল গঠন করেছে নেপাল সরকার। অর্থমন্ত্রী বিষ্ণু প্যাডেল সাংবাদিকদের বলেন, তদন্ত কমিটি ৪৫ দিনের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন দিতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।

আরও পড়ুন

আগের যত দুর্ঘটনা

নেপালে উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা ও এসবের জেরে হতাহতের ঘটনা প্রায়ই দেখা যায়। ২০১০ সালের পর থেকে গত এক যুগে নেপালে যেসব উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা ঘটেছে—

২০১০ সালের ২৪ আগস্ট প্রতিকূল আবহাওয়ায় রাজধানী কাঠমান্ডুর পাশে অগ্নি এয়ারের একটি ছোট উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়। এতে চারজন মার্কিন, একজন জাপানি, একজন ব্রিটিশ নাগরিকসহ ১৪ জন নিহত হন। ২০১০ সালের ১৫ ডিসেম্বর নেপালের পূর্বাঞ্চলে ২২ জন আরোহী নিয়ে একটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়। আরোহীদের বেশির ভাগ নিহত হন। তাঁদের অনেকেই তীর্থ সেরে ভুটান থেকে ফিরছিলেন। নিহতদের তালিকায় একজন মার্কিন নাগরিকও ছিলেন।

আরও পড়ুন

এরপর ২০১১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর কাঠমান্ডুর পাশেই একটি পাহাড়ে বিধ্বস্ত হয় ছোট একটি পর্যটকবাহী উড়োজাহাজ। নিহত হন ১৯ আরোহীর সবাই। উড়োজাহাজটিতে চড়ে বিশ্বের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট দেখতে গিয়েছিলেন দর্শনার্থীরা।

২০১২ সালের ১৪ মে উত্তরাঞ্চলের জমসন বিমানবন্দরে অগ্নি এয়ারের একটি উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে ১৫ আরোহী নিহত হন। উড়োজাহাজটি ভারতীয় তীর্থযাত্রীদের বহন করছিল। একই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর মাউন্ট এভারেস্ট দেখে ফেরার পথে কাঠমান্ডুর পাশে বিধ্বস্ত হয় ছোট একটি উড়োজাহাজ। নিহত হন ১৯ আরোহীর সবাই। তাঁদের মধ্যে সাতজন মার্কিন ও পাঁচজন ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন।

আরও পড়ুন

২০১৮ সালের ১২ মার্চ ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ছেড়ে যাওয়া ইউএস–বাংলা এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ কাঠমান্ডুর ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে থেকে ছিটকে পড়ে পাশের একটি ফুটবল মাঠে বিধ্বস্ত হয়। এ দুর্ঘটনায় নিহত হন ৫১ জন। আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয় ২০ জনকে। কয়েক দশকের মধ্যে নেপালে এটা ছিল অন্যতম বড় উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা।

২০১৯ সালের ১৪ এপ্রিল মাউন্ট এভারেস্টের পাশে পর্যটকবাহী একটি ছোট উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে তিনজন নিহত হন। আহত হন আরও তিনজন। গত বছরের ২৯ মে পোখারা থেকে উড্ডয়নের পরপরই তারা এয়ারের একটি ছোট উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়। এতে প্রাণ যায় ২২ জনের।

আরও পড়ুন