দেশে সামরিক আইন জারি নিয়ে মুখ খুললেন দক্ষিণ কোরিয়ার নোবেলজয়ী হান কাং

দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক আইন জারি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কথা বলছেন এ বছর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারজয়ী হান কাং। স্টকহোম, সুইডেন, ৬ ডিসেম্বরছবি: রয়টার্স

সাহিত্যে গত অক্টোবরে এ বছরের নোবেলজয়ীর নাম ঘোষণার পর থেকে কোনো সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়া থেকে বিরত ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার লেখক হান কাং। অনেক অনুরোধ সত্ত্বেও তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হননি। এমন কি তাঁর সম্মতি নিয়ে আয়োজিত একটি অনুষ্ঠানও শেষ মুহূর্তে বাতিল করে দিতে হয়েছিল আয়োজক কর্তৃপক্ষকে। নোবেল পুরস্কার গ্রহণের জন্য হান কাং এখন আছেন সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে। ১০ ডিসেম্বর নোবেল কমিটি আয়োজিত স্মারক অনুষ্ঠানে তিনি পুরস্কার গ্রহণ করবেন এবং স্মারক বক্তৃতা দেবেন। এখন তারই প্রস্তুতি নিচ্ছেন হান কাং।

তবে হান কাং সুইডেনে থাকা অবস্থায় হঠাৎই তাঁর দেশে ঘটে যায় নাটকীয় কিছু ঘটনা। কোনোরকম পূর্বাভাস ছাড়াই দেশটির প্রেসিডেন্ট সামরিক শাসন জারির ঘোষণা দেন এবং প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সেনাসদস্যরা পথে নেমে এসে রাজধানী সিউলের পার্লামেন্ট ভবনের নিয়ন্ত্রণ নেন। সামরিক বাহিনী চেয়েছিল সংসদ সদস্যরা যেন পার্লামেন্টে সমবেত হয়ে সামরিক আইন জারির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাসের সুযোগ না পান। সংসদে বিরোধী পক্ষ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ায় সামরিক আইনের আওতায় ভিন্নমত দমনের জুতসই একটি উপায় হিসেবে এ পদক্ষেপ গ্রহণকে দেখেছিলেন প্রেসিডেন্ট।

তবে ভিন্নমত দমনে প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওলের সেই চাল শেষ পর্যন্ত তাঁর নিজের জন্যই হিতে বিপরীত হয়ে দাঁড়ায়। সামরিক আইন জারির পরই কয়েক লাখ মানুষ পার্লামেন্ট ভবন এলাকায় সমবেত হয়ে প্রেসিডেন্টের সামরিক আইন জারির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সমাবেশ করেন। সংসদ সদস্যরাও সামরিক বাহিনীর বাধা ডিঙিয়ে পার্লামেন্ট ভবনে প্রবেশ করে জরুরি অধিবেশনে মিলিত হয়ে প্রেসিডেন্টের সামরিক আইন জারির সিদ্ধান্তকে অবৈধ ঘোষণা করে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেন। ফলে চাপের মুখে মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সামরিক আইন প্রত্যাহারের ঘোষণা দিতে বাধ্য হন প্রেসিডেন্ট ইউন সুক-ইওল। সমবেত জনতা সেনাসদস্যদের তৈরি প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে এবং কখনো আবার সৈন্যদের সঙ্গে হাতাহাতিতে জড়িত হয়েও পার্লামেন্ট ভবনের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন।

দেশে সামরিক আইন জারির মাধ্যমে গত মঙ্গলবার রাতে দক্ষিণ কোরিয়ায় শুরু হওয়া রাজনৈতিক উত্তেজনা ও নাটকীয় ঘটনা সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী হান কাংকে আপ্লুত ও প্রভাবিত করেছে। আপ্লুত তিনি এ কারণে হয়েছেন যে জনতার শক্তির সামনে গণতান্ত্রিক নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েও পরবর্তী সময়ে ক্রমশ একনায়কসুলভ আচরণ দেখিয়ে যাওয়া একজন প্রেসিডেন্ট জনতার চাপের মুখে মাথা নত করতে কীভাবে বাধ্য হয়েছেন। পাশাপাশি সেই ঘটনা তাঁকে এতটাই প্রভাবিত করেছে যে তিনি নীরবতা ভঙ্গ করে দ্রুত আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার মতো সিদ্ধান্ত নেন।

গতকাল শুক্রবার স্টকহোমে আয়োজিত সেই সংবাদ সম্মেলনে হান কাং বলেছেন, অন্য অনেকের মতো ৩ ডিসেম্বর রাতে সিউলে ঘটে যাওয়া ঘটনায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছেন তিনি। এটা তাঁকে মনে করিয়ে দিয়েছিল ১৯৭৯ সালে দক্ষিণ কোরিয়ায় জরুরি সামরিক আইন জারির পর যে নিপীড়ন তাঁর দেশবাসীর ওপর চালানো হয়, সেই ঘটনা। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘“হিউম্যান অ্যাক্ট” উপন্যাস লেখার সময় ১৯৭৯ সালের জরুরি সামরিক আইন জারির প্রেক্ষাপট এবং পরবর্তী ঘটনাবলি নিয়ে গবেষণা করতে প্রচুর সময় আমি দিয়েছি। সে জাতীয় ঘটনা যে ২০২৪ সালে আমার নিজের চোখের সামনে উন্মোচিত হবে, তা প্রত্যক্ষ করা ছিল অনেকটা যেন বোমার আঘাত এসে পড়া।’ উল্লেখ্য, হান কাংয়ের ‘হিউম্যান অ্যাক্ট’ উপন্যাসের পটভূমিতে আছে ১৯৭৯ সালের সেই বেদনাদায়ক ঘটনা।

১৯৭৯ সালের সামরিক আইন জারির সঙ্গে এবারের বড় এক পার্থক্য হচ্ছে দেশে কী ঘটে চলেছে তা টিভিতে সরাসরি দেখার সুযোগ পেয়েছেন মানুষ। হান কাং নিজেও দেশ থেকে অনেক দূরে স্টকহোমে বসে টিভিতে এসব দেখেন। তিনি বলেন, ‘সব কিছু আমি দেখেছি—যাঁরা শুধু নিজেদের শরীর দিয়ে সামরিক বাহিনীর সাঁজোয়া যানের পথ রুদ্ধ করে দিয়েছেন, অন্যরা যাঁরা অস্ত্রধারী সৈন্যদের খালি হাতে মোকাবিলা করে নিজেদের অবস্থান ধরে রেখেছেন, তাঁদের সবাইকে আমি দেখেছি। আমি আরও দেখেছি, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ চিৎকার করে সৈন্যদের সরে যেতে বলছেন, অনেকটা যেন সে রকম, মায়েরা যখন আপন সন্তানকে উদ্দেশে কিছু বলে।’

হান কাং বলেন, সেই মুহূর্তকে তাঁর কাছে ‘হৃদয়স্পর্শী আন্তরিকতা ও সাহসের প্রতিফলন’ হিসেবে মনে হয়েছে। দেশ যেন আবার অতীতে ফিরে না যায়, সেই আন্তরিক আশা প্রকাশ করেন হান কাং। একই সঙ্গে তিনি ঘটনাস্থলে মোতায়েন তরুণ পুলিশ কর্মকর্তা ও সেনাসদস্যদের মধ্যে দেখা দেওয়াও বিভ্রান্তির উল্লেখও করেছেন। হান কাংয়ের কাছে মনে হয়েছে, তাঁরা যেন দ্বিধায় ভুগছে, যেন নিজের বিবেকের সঙ্গে তাঁদের যুদ্ধ করতে হচ্ছে। সর্বজনীন মূল্যবোধের অবস্থান থেকে তাঁদের সেই দ্বিধা যেন ছিল চিন্তা ও বিচার করে দেখা এবং সমাধান খুঁজে পাওয়ার লক্ষ্যে চালানো সক্রিয় এক প্রচেষ্টা।

রাষ্ট্রের চালানো হিংস্রতার মুখে মানুষের জীবনে নেমে আসা দুর্যোগ হান কাংয়ের উপন্যাসে কাব্যিক প্রতিফলনের মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে। ‘হিউম্যান অ্যাক্ট’ উপন্যাসের পেছনে যেমন রয়েছে ১৯৮০ সালের গোয়াংজুর গণতান্ত্রিক আন্দোলন দমনে সরকারের নিষ্ঠুরতা, একইভাবে পরবর্তী সময়ে লেখা আরও একটি উপন্যাস ‘উই ডু নট পার্ট’–এর কাহিনি আবর্তিত হয়েছে ১৯৪৮ সালের এপ্রিলে জেজু গণ–অভ্যুত্থানের সময় সরকারি বাহিনীর হাতে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের প্রাণ হারানোর মর্মান্তিকতা।