স্মরণীয় ১০ মানবাধিকারকর্মী, যাঁরা দেখিয়েছেন প্রতিবাদের নতুন ভাষা
বিশ্বে প্রতিটি প্রজন্মেই এমন কিছু মানুষ জন্মান, যাঁরা শুধু স্বপ্ন দেখেন না, স্বপ্ন দেখান ও তা বাস্তবায়নে নেতৃত্ব দেন। তাঁরা প্রতিবাদ করেন, বিদ্রোহ করেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে অটল থাকেন। বিংশ শতাব্দীতে সংবাদমাধ্যমের বিকাশ, গণজাগরণ ও নাগরিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হয়েছেন একধরনের নতুন মানুষ, যাঁরা ‘অ্যাকটিভিস্ট’ বা অধিকারকর্মী হিসেবে পরিচিত।
মোহনদাস গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র, নেলসন ম্যান্ডেলা, হেলেন কেলার ও এমেলিন প্যাংখার্স্টের মতো ব্যক্তিদের শুধু মানবাধিকারকর্মী বলা কতটা যুক্তিযুক্ত, তা নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। তবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাঁরা যে যুগান্তকারী ভূমিকা রেখেছিলেন, তা নিয়ে কারও কোনো দ্বিধা নেই।
আজ আমরা পাঠকদের কাছে পরিচয় করাব এমন ১০ জন গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকারকর্মীকে, যাঁরা অন্যায় দেখে চুপ থাকেননি; বরং সাহস নিয়ে প্রতিবাদ করেছেন ও সমাজবদলে সংগ্রাম করেছেন।
মহাত্মা গান্ধী
মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী বা মহাত্মা গান্ধী ছিলেন অহিংস প্রতিবাদের একজন জনক। ১৮৬৯ সালের ২ অক্টোবর ভারতের গুজরাটে জন্ম নেওয়া গান্ধী ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ‘সত্যাগ্রহ’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম থেকে শুরু করে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে অসহযোগ, বয়কট ও লবণ আইন ভাঙা আন্দোলনের (লবণ সত্যাগ্রহ) মধ্য দিয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন তিনি।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনের পথে গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের বড় ভূমিকা রয়েছে। আজীবন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করা এই ব্যক্তি ভারতের স্বাধীনতার পরের বছর ১৯৪৮ সালে নয়াদিল্লিতে এক হিন্দু উগ্রবাদীর হাতে নিহত হন। তাঁর নীতি ও আদর্শ বিশ্বজুড়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অনুপ্রেরণা হয়ে আছে।
নেলসন ম্যান্ডেলা
দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবৈষম্যবিরোধী সংগ্রামের অন্যতম নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা ১৯১৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে দীর্ঘ ২৭ বছর জেল খেটে ১৯৯০ সালে মুক্তি পান তিনি। পরে ১৯৯৩ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান ও ১৯৯৪ সালে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হন।
ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটে ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে ওঠে। ক্ষমা ও সহনশীলতার প্রতীক হিসেবে তাঁর অবদান আজও বিশ্বজুড়ে সমাদৃত। ২০১৩ সালে মারা গেলেও তাঁর আদর্শ মানবাধিকার আন্দোলনের জন্য অমর হয়ে আছে।
মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র
মার্টিন লুথার কিং ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবৈষম্যের বিরুদ্ধে ও নাগরিক অধিকারের পক্ষের একজন প্রতীক। ১৯৫৫ সালের যাত্রীবাহী বাস বয়কট আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে তিনি গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের পথ অনুসরণ করেন। ১৯৬৩ সালে ‘আই হ্যাভ আ ড্রিম’ ভাষণে লুথার কিং মার্কিন জাতির বিবেক কাঁপিয়ে দেন।
লুথার কিং জুনিয়রের নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রে সিভিল রাইটস অ্যাক্ট পাস হয়, যা বর্ণবৈষম্য বন্ধ করে। ১৯৬৮ সালে তিনি এক শ্বেতাঙ্গ বন্দুকধারীর গুলিতে নিহত হন। তাঁর পথ অনুসরণ করে আজও যুক্তরাষ্ট্রে সমতা ও ন্যায়ের পক্ষে লড়াই করে চলেছে একদল মানুষ।
শিরিন এবাদি
ইরানের মানবাধিকার আইনজীবী শিরিন এবাদি ইরানের প্রথম নারী বিচারক ছিলেন। দেশটিতে ইসলামি বিপ্লবের পর নারীদের বিচারক হওয়ার সুযোগ বন্ধ হওয়ায় তিনি নারী ও শিশু অধিকার নিয়ে কাজ শুরু করেন। ২০০৩ সালে তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন। মুসলিম নারী হিসেবে তিনিই প্রথম নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।
শিরিন ২০০৯ সাল থেকে লন্ডনে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। ইরানে নারীদের ‘বৈষম্য ও অবিচারের’ বিরুদ্ধে তাঁর সাহসী প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘ইরানি মানবাধিকার কেন্দ্র’ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত।
গ্লোরিয়া স্টাইনেম
মার্কিন নারীবাদী ও সাংবাদিক গ্লোরিয়া স্টাইনেম ১৯৩৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালে আরও কয়েকজনের সঙ্গে মিলে নারীবাদী সাময়িকী ‘মিস ম্যাগাজিন’বের করেন। যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য, প্রজনন অধিকার ও সমমজুরি নিয়ে তিনি কাজ করেছেন।
স্টাইনেম যুক্তরাষ্ট্রের নারীবাদী আন্দোলনের প্রধান মুখ হিসেবে পরিচিত। ৯১ বছর বয়সেও তিনি নারী ক্ষমতায়নের পক্ষে শক্তিশালী বক্তব্য দেন ও নতুন প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেন।
এমেলিন প্যাংখার্স্ট
যুক্তরাজ্যে নারীর ভোটাধিকার আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ নেতা এমেলিন প্যাংখার্স্ট। ‘ডিডস নট ওয়ার্ডস’ স্লোগানকে সামনে রেখে তিনি ১৯১০-এর দশকে ‘সাফ্রাগেট’ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন। তিনি সহিংস প্রতিবাদ, অনশন ও বন্দিত্ব সত্ত্বেও লড়াই চালিয়ে নারীদের ভোটাধিকারের পথ সহজ করেন।
এমেলিনের ধারাবাহিক আন্দোলনের ফলে ১৯১৮ সালে ৩০ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সী নারীরা প্রথম ভোটাধিকার পান এবং ১৯২৮ সালে নারী-পুরুষ সমান ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়। নারীর ক্ষমতায়নের ইতিহাসে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হয়ে আছেন তিনি।
হেলেন কেলার
দৃষ্টি ও শ্রবণশক্তি হারিয়েও বিশ্বের দরবারে নিজের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছেন হেলেন কেলার। ১৮৮০ সালের ২৭ জুন যুক্তরাষ্ট্রের আলাবামা অঙ্গরাজ্যে জন্ম নেওয়া হেলেন মাত্র এক বছর বয়সে এক রোগে শ্রবণ ও দৃষ্টিশক্তি হারান। তবে শিক্ষক অ্যান সুলিভানের সংস্পর্শে আসার পর শব্দের অর্থ না বুঝেই বেড়ে ওঠা হেলেনের জীবন এক জাদুকরি বাঁক নেয়।
পড়াশোনা ও লেখালেখি শিখে প্রতিবন্ধী অধিকার ও নারীবাদের পক্ষে আজীবন কাজ করেছেন হেলেন কেলার। তাঁর আত্মজীবনী ‘দ্য স্টোরি অব মাই লাইফ’ বিশ্বের সবচেয়ে বেশি বিক্রীত বইগুলোর অন্যতম। তিনি একাধারে নারীবাদী, সমাজসেবী ও প্রতিবন্ধী অধিকারকর্মী ছিলেন। ১৯৬৮ সালে ৮৭ বছর বয়সে মারা যান তিনি।
দালাই লামা
তিব্বতের আধ্যাত্মিক নেতা ১৪তম দালাই লামা ১৯৩৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি তিব্বতের স্বাধীনতার জন্য অহিংস লড়াই করে ১৯৮৯ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান। সহিংসতার বিপরীতে করুণা, সংযম ও সংলাপের পক্ষে দৃঢ় ছিলেন তিনি। পরিবেশ, শান্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রচারে তাঁর অবদান বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত। পেয়েছেন বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা।
১৯৫৯ সালে চীনের বিরুদ্ধে তিব্বতে বিক্ষোভ ও বিদ্রোহের পর দালাই লামা ভারতে আশ্রয় নেন। তখন থেকে তিনি ভারতের ধর্মশালা শহরে থাকেন এবং সেখানে তিব্বতের নির্বাসিত সরকার পরিচালনা করেন।
অং সান সু চি
মিয়ানমারের গণতন্ত্রের প্রতীক অং সান সু চি ১৯৪৫ সালে জন্মগ্রহণ করেন। সেনাশাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের কারণে টানা ১৫ বছর গৃহবন্দী ছিলেন তিনি। ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।
গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের এক প্রতীকে পরিণত হয়ে আছেন সু চি, যদিও পরবর্তীকালে রোহিঙ্গা সংকটের কারণে সমালোচিত হন। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিম জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দেশটির সেনাবাহিনী ও উগ্রপন্থী বৌদ্ধরা নিষ্ঠুর নির্যাতন-নিপীড়ন, জ্বালাও-পোড়াও শুরু করলেও তিনি ছিলেন নীরব। রোহিঙ্গা নিপীড়নে তাঁর এমন ভূমিকা সে সময় বিশ্বকে হতবাক করে দিয়েছিল।
ডেসমন্ড টুটু
দক্ষিণ আফ্রিকার বিশপ ও মানবাধিকারকর্মী ডেসমন্ড টুটু ১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন। বর্ণবাদের বিরুদ্ধে অহিংস প্রতিবাদের নেতা ছিলেন তিনি। ১৯৮৪ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।
বর্ণবৈষম্য বিলোপের পর ডেসমন্ড ‘সত্য ও পুনর্মিলন কমিশনের’ চেয়ারম্যান হিসেবে শান্তি ও ক্ষমার পথ দেখান। মানবিকতা ও ন্যায়ের পক্ষে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে গেছেন তিনি। মানবাধিকার নিয়ে সোচ্চার কণ্ঠস্বর ডেসমন্ড ২০২১ সালে মারা যান।