রাশিয়ার পর আর কোন কোন দেশ তালেবানকে স্বীকৃতি দিতে পারে

আফগানিস্তানে এক বৈঠকে রুশ রাষ্ট্রদূত দিমিত্রি ঝিরনভ (বাঁয়ে) ও আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি (ডানে)ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

তালেবান ২০২১ সালে আবার আফগানিস্তানের ক্ষমতা নেওয়ার পর এই প্রথম দেশ হিসেবে রাশিয়া তাদের সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। এর মধ্য দিয়ে রাশিয়া বহু বছরের নীরব যোগাযোগকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছে। পাশাপাশি তালেবানের প্রথম শাসনামলের তিক্ত সম্পর্ক নাটকীয় মোড় নিয়েছে।

চার বছর আগে ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলের পর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আশরাফ গনির সরকারকে সরিয়ে ক্ষমতা দখল করে তালেবান। এর পর থেকে ঐতিহাসিকভাবে তালেবানকে শত্রু হিসেবে বিবেচনা করা বেশ কিছু দেশ তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। তবে রাশিয়া ছাড়া গত বৃহস্পতিবার পর্যন্ত অন্য কোনো দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাশিয়ার পদক্ষেপ অনুসরণ করে অন্যান্য দেশও তালেবানের সঙ্গে পূর্ণাঙ্গ কূটনৈতিক সম্পর্ক শুরু করার পথ প্রশস্ত করতে পারে।

রাশিয়া যা বলছে

রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তালেবান সরকারকে মস্কোর আনুষ্ঠানিক এ স্বীকৃতি আফগানিস্তানের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সহযোগিতার নতুন পথ প্রশস্ত করবে।

বিবৃতিতে আরও বলা হয়, ‘আমরা বিশ্বাস করি, ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তানের সরকারকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির কারণে আমাদের বিভিন্ন খাতে গঠনমূলক সহযোগিতা আরও গভীর হবে।’ রাশিয়া জ্বালানি, পরিবহন, কৃষি ও অবকাঠামো খাতে তালেবানের সঙ্গে কাজ করতে চায় বলেও ওই বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

তালেবানের প্রতিক্রিয়া

আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত বৃহস্পতিবার এক্স-এ দেওয়া এক পোস্টে জানিয়েছে, কাবুলে নিযুক্ত রুশ রাষ্ট্রদূত দিমিত্রি ঝিরনভ আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকির সঙ্গে দেখা করে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দিতে ক্রেমলিনের এ সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন।

আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি এক্সে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘রাশিয়ার এ সাহসী পদক্ষেপকে আমরা সম্মান জানাই। এটি অন্যদের জন্যও অনুকরণীয় উদাহরণ হবে।’

রাশিয়া ও আফগানিস্তান সম্পর্কের ইতিহাস

সোভিয়েত ইউনিয়নের সেনারা একটি কমিউনিস্ট সরকার প্রতিষ্ঠা করতে ১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে হামলা চালিয়েছিল। এ কারণে আমেরিকার সহায়তায় আফগান মুজাহিদিনরা সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। শুরু হয় ১০ বছরের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ। এ যুদ্ধে প্রায় ১৫ হাজার সোভিয়েত সেনা নিহত হন।

১৯৯২ সালে রকেট হামলায় রুশ দূতাবাস ক্ষতিগ্রস্ত হলে মস্কো কাবুলে তাদের দূতাবাস বন্ধ করে দেয়। সাবেক সোভিয়েত-সমর্থিত প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ নাজিবুল্লাহ তখন থেকেই কাবুলে জাতিসংঘের একটি কম্পাউন্ডে আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে ১৯৯৬ সালে তালেবানের হাতে তিনি নিহত হন। ওই বছরই তালেবান প্রথম ক্ষমতায় আসে।

১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে রাশিয়া আফগানিস্তানে তালেবানবিরোধী শক্তি, বিশেষ করে আহমাদ শাহ মাসউদের নেতৃত্বাধীন নর্দার্ন অ্যালায়েন্সকে সমর্থন করেছিল। ২০০১ সালে নাইন ইলেভেনের পর রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে সহায়তা করে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন আফগানিস্তানে হামলার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে সহায়তা করেছিলেন।

২০০৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন জোট কর্তৃক তালেবানকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর রাশিয়া এ গোষ্ঠীকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে ঘোষণা করে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে রাশিয়া আইএসআইএস/আইএসআইএল সশস্ত্র গোষ্ঠীর একটি আঞ্চলিক শাখা আইএসআইএস-খোরাসানের (আইএস-কে) উত্থান নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। এ কারণে তালেবানের প্রতি রাশিয়ার আগ্রহ বেড়ে যায়। তালেবান আইএস-কে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী ও শত্রু হিসেবে দেখে।

এ বৈঠকেই রুশ রাষ্ট্রদূত রাশিয়ান ফেডারেশন কর্তৃক আফগানিস্তানের ইসলামিক আমিরাতকে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে রাশিয়া সরকারের সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে জানান
ছবি: এক্স থেকে নেওয়া

২০২১ সালে তালেবান আবার ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে গনি সরকারকে সমর্থনকারী মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে এ গোষ্ঠীর সঙ্গে রাশিয়ার সম্পর্ক আরও উন্মুক্ত হয়ে ওঠে। ২০২২ ও ২০২৪ সালে সেন্ট পিটার্সবার্গে রাশিয়ার প্রধান অর্থনৈতিক ফোরামে তালেবানের একটি প্রতিনিধিদল যোগ দিয়েছিল।

আইএসের হুমকি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে (এই গোষ্ঠী ২০২৪ সালের মার্চে মস্কোর একটি কনসার্ট হলে হামলার দাবি করেছিল। যেখানে বন্দুকধারীরা ১৪৯ জনকে হত্যা করেছিল), রাশিয়া তালেবানের আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে। চলতি বছরের এপ্রিলে রাশিয়া তালেবানের ওপর থেকে ‘সন্ত্রাসী’ তকমা তুলে নেয়।

বিশ্ব যেভাবে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো তালেবানকে স্বীকৃতি দেয়নি। তবে জাতিসংঘ তালেবানকে ‘ডি ফ্যাক্টো কর্তৃপক্ষ’ বলে উল্লেখ করে। তবে বেশ কয়েকটি দেশ নানা উপায়ে তালেবানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে। তালেবানকে আফগানিস্তানের সরকার হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি না দিলেও বেশ কয়েকটি দেশ সম্প্রতি এই গোষ্ঠীর সঙ্গে কূটনৈতিকভাবে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছে। এসব দেশের মধ্যে আছে—

চীন

যুক্তরাষ্ট্র আফগানিস্তান থেকে সরে আসার আগেই চীন তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলেছিল। ২০১৯ সালেই তালেবান নেতাদের নিয়ে শান্তি আলোচনা করেছে বেইজিং।

তালেবান ক্ষমতায় ফিরে আসার পর থেকে চীনের এ সম্পর্ক আরও জোরদার হয়েছে। ২০২৩ সালে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত তেল কোম্পানির একটি শাখা আমু দরিয়া নদীর তেল উত্তোলনে ২৫ বছরের চুক্তি করে, যা তালেবান আমলে প্রথম বড় বিদেশি কোনো বিনিয়োগ। ২০২৪ সালে তালেবানের সাবেক মুখপাত্র বিলাল করিমকে চীন আনুষ্ঠানিক দূত হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও সরকারকে স্বীকৃতি দেয়নি।

এ ছাড়া চলতি বছরের মে মাসে পাকিস্তান ও তালেবানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের নিয়ে একটি ত্রিপক্ষীয় সম্মেলনের আয়োজন করেছিল চীন।

পাকিস্তান

একসময় তালেবানের প্রধান আন্তর্জাতিক সমর্থক ছিল পাকিস্তান। তবে ২০২১ সালের পর থেকে তাদের এ সম্পর্ক তিক্ততার পর্যায়ে পৌঁছায়। পাকিস্তানের অভিযোগ, তালেবান সরকার পাকিস্তানবিরোধী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী, বিশেষ করে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানকে (টিটিপি) আশ্রয় দিচ্ছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান আফগানিস্তানে বিমান হামলা চালায় এবং আফগান শরণার্থীদের ফেরত পাঠাতে শুরু করে।

আফগানিস্তানের তালেবান সরকার পাকিস্তানের অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে, বিমান হামলায় আফগানিস্তানের ৪৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছেন।

চলতি বছর পাকিস্তান আফগান শরণার্থীদের বহিষ্কারের সংখ্যা বাড়িয়েছে, যা দুই দেশের সম্পর্কের মধ্যে আরও চাপ তৈরি করেছে। চলতি বছরের শুরুতে পাকিস্তান বলেছে, তারা ৩০ লাখ আফগানকে দেশ থেকে বের করে দিতে চায়। আফগানিস্তান থেকে আসা সশস্ত্র যোদ্ধাদের নিয়ে পাকিস্তানে উত্তেজনা অব্যাহত আছে।
গতকাল শুক্রবার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তারা আফগানিস্তান থেকে সীমান্ত অতিক্রমের চেষ্টা করার সময় ৩০ যোদ্ধাকে হত্যা করেছে। নিহত সবাই টিটিপি বা এর সহযোগী সংগঠনের সদস্য।

এরপরও পাকিস্তান আফগানিস্তানের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক নমনীয় করার চেষ্টা করেছে। গত এপ্রিলে পাকিস্তানের উপপ্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার কাবুলে আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকিসহ অন্যান্য আফগান কর্মকর্তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন। মে মাসে ইসহাক দার ও মুত্তাকি আবারও কথা বলেছেন।

ভারত

তালেবানের প্রথম শাসনামলে ১৯৯৬ সালে কাবুল দূতাবাস বন্ধ করে দেয় ভারত। ভারত তালেবানকে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়। কারণ, তারা পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধি হিসেবে এ গোষ্ঠীকে দেখত।

পরে ২০০১ সালে তালেবান ক্ষমতা থেকে উৎখাত হওয়ার পর নয়াদিল্লি কাবুলে তাদের দূতাবাস আবার চালু করে। তবে তালেবান ও হাক্কানি গোষ্ঠীর হামলায় ভারতের কূটনৈতিক মিশন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি বদলেছে। তারা দূতাবাস আবারও চালু করে ২০২১ সালে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দেয় এবং তালেবান কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য কূটনীতিকদের পাঠায়।

চলতি বছর ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি দুবাইয়ে মুত্তাকির সঙ্গে সাক্ষাৎও করেন। এরপর গত মে মাসে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর মুত্তাকির সঙ্গে ফোনে কথা বলেন। এটাই ছিল তাঁদের প্রথম প্রকাশ্যে স্বীকৃত কথোপকথন।

ইরান

রাশিয়া ও ভারতের মতো ইরানও ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিকে তালেবানকে বিদ্বেষের দৃষ্টিতে দেখত। ১৯৯৮ সালে মাজার-ই-শরিফে তালেবানের হাতে ইরানি কূটনীতিকেরা নিহত হলে সম্পর্ক একেবারে খারাপ হয়ে যায়। তবে আইএসআইএস-কে–এর উত্থান ইরানকেও তালেবানের দিকে ঝুঁকতে বাধ্য করেছে।

চলতি বছরের ১৭ মে মুত্তাকি ইরানে এক সম্মেলনে যোগ দেন। এ সময় তিনি ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

রাশিয়ার পর আর যারা স্বীকৃতি দিতে পারে

যদিও প্রতিটি দেশ আনুষ্ঠানিকভাবে তালেবান সরকারকে স্বীকৃতি দেবে কি না, আলাদাভাবে সে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে অনেক দেশ ইতিমধ্যে এই গোষ্ঠীর সঙ্গে এমনভাবে কাজ করছে, যা প্রায় স্বীকৃতির সমান।

নয়াদিল্লিভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান অবজারভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের উপপরিচালক কবির তানেজা বলেন, আফগানিস্তানের প্রতিবেশী দেশগুলোর তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা ছাড়া উপায় নেই। এটা তাদের কৌশলগত ও নিরাপত্তাজনিত বাস্তবতা।

তালেবানকে রাশিয়ার স্বীকৃতি মূলত একটি ভূরাজনৈতিক খেলা। রাশিয়ার স্বীকৃতি কেবল কাবুলে মস্কোর অবস্থানকে দৃঢ় করল না; বরং তালেবানের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির প্রচেষ্টাকেও জোরালো করল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তালেবান আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা করছে। রাশিয়ার এ স্বীকৃতি তাদের জন্য এক বড় কূটনৈতিক বিজয়। পর্যবেক্ষকদের মতে, মধ্য এশিয়ার কয়েকটি দেশ ও চীন হয়তো পরবর্তী স্বীকৃতিদাতাদের মধ্যে থাকতে পারে।

আরও পড়ুন