তালেবানের বন্দিশালায়

দুঃস্বপ্নের শুরু

লোগার প্রদেশ, আফগানিস্তান

সকাল থেকে কেন যেন মনে হচ্ছে, আজ একটা কিছু হতে যাচ্ছে।

একে তো পরিস্থিতি বেশ থমথমে। তার ওপর গতকালই রানী ফোনে ভীষণ কান্নাকাটি করেছে। আমাদের সহকর্মী আলীমকে যে তালেবান মেরে ফেলেছে, পত্রিকা পড়ে এই খবর সে পেয়েছে। বারবারই বলছিল, ‘তুমি বাড়িত্তে বেরোয়ো না। প্লিজ!’

রানী জানে না, ও যতটা ভাবছে, অবস্থা তার চেয়েও খারাপ।

কদিন আগেও ঘুম ভেঙেছে প্রচণ্ড গোলাগুলির শব্দে। আমি আর আমাদের অ্যাকাউন্ট্যান্ট সুজিত একই ঘরে ঘুমাই। পাশাপাশি খাটে। রাত তখন দুইটা। সুজিত ধড়মড় করে উঠে বসে বলছিল, ‘ভাই! এত রাতে জেনারেটর চালায় কে!’

বেচারা বুঝতে পারেনি, বিরতিহীন গুলির শব্দই শোনাচ্ছিল জেনারেটরের গর্জনের মতো। চোখ খুলেই দেখি গুলি আর আগুনের আলোয় ভরে গেছে আমাদের ঘর। তালেবান আর মার্কিন সেনাদের মুখোমুখি যুদ্ধ বেধেছে। আমাদের বাড়ির খুব কাছেই।

কথা না বাড়িয়ে সুজিতকে একটানে মেঝেতে ফেলে দিয়েছিলাম। নিজেও প্রায় মাটির সঙ্গে মিশে যাচ্ছিলাম। দোয়া–দরুদ পড়তে পড়তে কোনোমতে রাতটা কেটেছে।

এত সব কথা রানীকে বলতে চাই না। কিন্তু ও বোধ হয় টের পায় ঠিকই। গতকাল ফোনের ওপাশে তার সে কী কান্না! এ দেশে আছি দেড় বছরের বেশি হয়েছে। রানী কখনো আমার সঙ্গে এভাবে কথা বলেনি। একপর্যায়ে তো বলেই ফেলল, ‘চাকরি করা লাগবে না। তুমি ফিরা আসো।’

বললাম, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি বাড়ি থেকে বের হব না, যাও। তুমি কান্না থামাও তো!’ রানী আমার কথা বিশ্বাস করল না একবিন্দু। সে জানে, ঘরে বসে থাকার লোক আমি না। কাঁদতে কাঁদতে বলছিল, ‘তুমি বেশি বেশি করে দোয়া ইউনুস পড়বা। আমার ম্যালা ভয় করতিছে। মনে হচ্ছে তুমার বড় কোনো বিপদ হতি পারে।’

আমিও যে বিপদের গন্ধ পাচ্ছি, সে কথা ওকে কী করে বলি?

সব ছেড়েছুড়ে দেশে চলে যাব, সে উপায় নেই। আফগানিস্তানের লোগার প্রদেশে আমাদের, মানে ব্র্যাকের কাজ চলছে বেশ জোরেশোরে। আমার আগে এই প্রদেশে যাঁরা কাজ করে গেছেন, কেউই খুব বেশি দিন টিকতে পারেননি। অনেক বাধাবিপত্তির মধ্যে তা–ও পাঁচটা অফিস দাঁড় করানো গেছে। আরেকটার কাজ চলছে। এরই মধ্যে ব্র্যাকের ক্ষুদ্রঋণ প্রকল্পের আওতায় এখানকার দরিদ্র নারীদের মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ টাকার ঋণ দেওয়া হয়ে গেছে। অনেক কাজ। ঘরে বসে থাকলে এত সব সামাল দেবে কে?

‘গুরু, আজকে বের না হলে হয় না? আপনি না বলেন, ভাবির কথা না শুনলে আপনার বিপদ হয়?’ বলল সদরউদ্দীন। আমার দেশি সহকর্মী। এই দূরদেশে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধুও বলা যায়। কত গল্প করি আমরা। এ কথা সত্যি যে রানীর কথা আমলে না নিয়ে আগেও আমি দু–একবার বিপদে পড়েছি। সদরউদ্দীনকে হয়তো কখনো এ কথা বলেছিলাম। সে ঠিকই মনে রেখেছে।

কোটটা গায়ে চাপিয়ে বললাম, ‘ভয় পাইলে এই দেশে কাজ করতে পারব মিয়া?’

সদরউদ্দীন আর আমি—দুজন একসঙ্গেই বের হলাম। পুল–ই–আলম ২ অফিসের সামনে যখন নামলাম, তখন ঘড়িতে বাজে সকাল সাড়ে আটটা। সদরউদ্দীনের কাজ ছিল আরেক অফিসে। সে চলে যাওয়ার পর আমি কিছু কাজ সেরে নিলাম। তারপর একটা গাড়ি নিয়ে রওনা হলাম পুল–ই–আলম ১ এর উদ্দেশে।

পুল–ই–আলম ১ অফিসটা একটু দূরে। কাবুল থেকে খোস্তের দিকে যে হাইওয়েটা চলে গেছে, সেটা ধরে এগোতে হয়। জায়গাটার নাম কালাই আলী খান। চলার পথে দেখলাম, রাস্তাঘাট সুনসান। আর দশ দিনের মতোই। ঠিক দশটা থেকে সাড়ে দশটার মাঝামাঝি সময়ে অফিসের গেটে নামলাম। গেট দিয়ে ঢোকার সময় চোখে পড়ল, ম্যানেজার, অ্যাকাউন্ট্যান্ট আর গার্ড নিজেদের মধ্যে কী যেন আলাপ করছে। আমাকে দেখেই চুপ মেরে গেল। আফগানিস্তানের রীতি অনুযায়ী আমি কুশল বিনিময় করলাম। খেয়াল করছিলাম, ম্যানেজারের চোখ দুটো লাল হয়ে আছে।

‘কী হয়েছে চোখে? রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়েছে তো?’ জানতে চাইলাম। আমি একটু–আধটু পশতু ভাষা শিখে নিয়েছি। তবে অফিসের লোকজনের সঙ্গে বেশির ভাগ কথা ইংরেজিতেই হয়।

ম্যানেজার বলল, ‘তেমন কিছু না। কয়েক দিন ধরে চোখে কী যেন হয়েছে।’ মনে হলো সে কিছু লুকাতে চাইছে।

কিছুক্ষণ পর ম্যানেজার আর অ্যাকাউন্ট্যান্ট বেরিয়ে গেল কী যেন একটা কাজে। অফিসে আমি একা। কেমন যেন ভয় ভয় করতে লাগল। আফগানিস্তানের বেশির ভাগ ঘরবাড়ির মতো আমাদের অফিসটাও উঁচু প্রাচীরে ঘেরা। দরজায় গার্ড দাঁড়ানো আছে। তবু কেন যেন অস্বস্তি হতে লাগল। সেই একই শিরশিরে অনুভূতি, একই শঙ্কা—একটা কিছু কি হতে যাচ্ছে?

গার্ডকে বললাম দরজা বন্ধ রাখতে।

অফিসে বসে কিছু কাগজপত্র দেখছিলাম। এমন সময় মনে হলো, গেটের কাছ থেকে চড়–থাপ্পড়ের আওয়াজ আসছে। সন্তর্পণে উঁকি দিলাম বাইরে।

সংখ্যায় ওরা পাঁচ–ছয়জন। কয়েকজনের পরনে পুলিশের পোশাক। কাঁধে একে–৪৭ রাইফেল। দেখলাম গার্ড দুই হাত তুলে আত্মসমর্পণের ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। আর ওরা সমানে কিল–ঘুষি মেরেই যাচ্ছে।

দুজন গটগট করে আমার ঘরের দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। হাঁটার গতি দেখেই মনে হলো, আমাকে মেরে ফেলতে এদের হাত কাঁপবে না একটুও। এই প্রবল বিপদেও কেন যেন স্ত্রী, সন্তান, মায়ের মুখটা মনে পড়ল। আর কিছুক্ষণের মধ্যেই কি সব শেষ হয়ে যাবে?

সহকর্মীদের সঙ্গে নূর ইসলাম, মাঝখানে, লাল শার্ট পরা

হাত থেকে মোবাইলটা ফেলে দিলাম দূরে। মোবাইলে অনেক জরুরি নম্বর আছে। চাই না এসব ওদের হাতে পড়ুক। দুই হাত ওপরে তুলে আমি ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে গেলাম। আর জোরে জোরে কালেমা পড়তে শুরু করলাম। ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ!’

আমার মাথায় তখন একটা কথাই ঘুরছে। মৃত্যুর সময় মুখে যেন কালেমাটা থাকে।

ওরা সোজা আমার ঘরে এসে ঢুকল। ‘কাফেরের বাচ্চা!’ বলেই একজন ঘুষি মারল মুখে। মনে হলো মাথাটা ১৮০ ডিগ্রি পেছনে ঘুরে গেছে।

‘বুশের বাচ্চা!’ বলে ঘুষি মারল আরেকজন। এবার আমার ঠোঁট ফেটে গেল। টের পেলাম, শার্ট ভিজে গেছে তাজা রক্তে। দুজন একে–৪৭ দিয়ে মারল উরুতে। পড়ে গেলাম। জোরে জোরে কালেমা পড়া তখনো বন্ধ করিনি।

টানতে টানতে ওরা আমাকে নিয়ে গেল গেটের বাইরে। দেখলাম পশ্চিমের খোলা জায়গাটাতে পুলিশের পিকআপ দাঁড় করানো। একটা গাছের আড়ালে। হঠাৎই নিশ্চিত হয়ে গেলাম, পরনে পুলিশের পোশাক থাকলেও এরা পুলিশের লোক নয়। টেনেহিঁচড়ে আমাকে গাড়িতে তোলা হলো।

তখনো জানতাম না, কী ভয়াবহ অভিজ্ঞতা অপেক্ষা করছে আমার জন্য।

এমনই কোনো এক গুহায় বন্দী ছিলেন নূর ইসলাম

নিখোঁজ সংবাদ

ফরিদপুর, বাংলাদেশ

‘বাজার খুঁজে পাইসেন? দেখেন পাশ দিয়ে একটা গলি গেছে। একশ গজমতো গেলি ডান দিকে রাস্তা। কাউরে জিজ্ঞেস করলি দেখায় দেবে নূর ইসলামের বাড়ি কোনদিকে।’ একনাগাড়ে এটুকু কথা বলেই রানীর বড় ক্লান্ত লাগে।

রাতে ঘুম হয়নি। তার ওপর আজ রমজানের প্রথম দিন। ঘরে অনেক কাজ। কিন্তু মন বসছে না কিছুতেই।

‘ভাই, কী দরকার, কিছু তো খুলে বলছেন না।’

‘ভাবি, একটু ওয়েট করেন। পৌঁছায়েই আপনারে ফোন দিচ্ছি।’

ওপাশের কথা শুনে রানী ঠিক ভরসা পায় না। নূর ইসলামের কিছু হলো না তো? ভাবতেই বুকটা ধক করে ওঠে।

রানী ফোন করে তার জাকে। ‘সুমী, ওনারা কাছাকাছি চলে আসছে।’

‘ইফতার করে যাবে?’

‘তা তো জানিনে।’

‘আপনি টেনশন কইরেন না ভাবি। আমরা তো আছিই।’

নূর ইসলাম আফগানিস্তান যাওয়ার পর রানী এখন পর্যন্ত দুবার গেছে ব্র্যাকের অফিসে। আঞ্চলিক অফিসে সই করে এলে বেতনের একটা অংশ ব্যাংকে পৌঁছে যায়। সকালে যখন ব্র্যাকের অফিস থেকে ফোন এল, রানী ভেবেছিল হয়তো টাকা তোলার জন্যই।

‘আর তো মাত্র কয়টা দিন ভাই। সে চলে আসলি একবারে সই করে দিবানি? তখন পুরো টাকাডা পাঠায় দিয়েন।’ বলছিল সে।

‘না না ভাবি, টাকার জন্য না।’

‘তালি?’

‘ইয়ে…আচ্ছা, ভাবি, আপনি এখন কোথায়?’

‘আমি তো বুনের বাড়ি। ফরিদপুরে।’

‘ও। যশোরে, মানে আপনার শ্বশুরবাড়িতে কেউ নেই?’

‘আছে। আমার শাশুড়ি, দেবর…। ক্যান বলেন তো?’

‘এক মিনিট ধরেন।’

ওপাশে তাঁরা নিজেদের মধ্যে কী যেন আলাপ করে নেয়। একটু পর বলে, ‘ভাবি, আপনার শ্বশুরবাড়ির ঠিকানাটা বুঝায় বলেন তো। আমরা একটু যাব।’

‘ক্যান ভাই? কোনো সমস্যা?’

‘আমরা গিয়ে আপনাকে ফোন দিচ্ছি।’

সকাল গড়িয়ে প্রায় দুপুর। অফিসের লোকজন হঠাৎ কেন বাড়ি যেতে চাচ্ছে, রানী বুঝতে পারে না। টেনশনে তার গলা শুকিয়ে আসে। কেমন যেন দুর্বল লাগে।

হঠাৎ হঠাৎ ভীষণ রাগ হয় লোকটার ওপর। কেন যে আফগানিস্তান যেতে রাজি হলো! যাওয়ার ব্যাপারে যখন কথাবার্তা চলছে, নূর ইসলাম একবারের জন্যও রানীকে জানায়নি। হুট করে একদিন বলে, ‘বুঝলে, অফিস আমার কাজে খুব খুশি। আমারে দুই বছরের জন্য আফগানিস্তান পাঠাচ্ছে।’

ভালো কাজের এ কেমন পুরস্কার! এই যুদ্ধবিগ্রহের দেশে কেউ যায়? খেপে গিয়েছিল রানী। ‘পাঠাতে চাইল আর তুমি রাজি হয়ে গেলে? আমার কথা, ছেলেডার কথা একবার ভাবলে না? অনুমতি না–ই নিলে। পরামর্শ করতে পাইরতে।’

‘আহা, বলার সুযোগ পাইলাম কই? হুট করে সব ঠিক হয়ে গেল…’

রানী কিছুতেই মানতে চায়নি। ছেলেটা অটিজমে আক্রান্ত। বয়স তখন মাত্র এক কি দেড়। সব সময় দেখেশুনে রাখতে হয়। এর মধ্যে নূর ইসলাম তাকে একা ফেলে চলে যাবে, রানীর বিশ্বাস হচ্ছিল না।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত নূর ইসলামকে আটকানো গেল না। ২০০৫ সালের ৫ ডিসেম্বর, নূর ইসলাম চলে যায় আফগানিস্তানে।

এরই মধ্যে দেখতে দেখতে অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। দুবার দেশে ঘুরে গেছে নূর ইসলাম।

রানী ক্যালেন্ডারে একেকটা দিন দাগ কেটে রাখে। দুলাভাই মজা করে বলে, ‘ক্যালেন্ডারে দিন কাটলি কি আর দিন তাড়াতাড়ি যাবে?’ তবু। সকালে ঘুম থেকে উঠে আরও একটা দিনের ঘরে কাটাচিহ্ন দেওয়া যাবে, এইটুকু স্বস্তি বুকে নিয়েই রানী প্রতি রাতে ঘুমাতে যায়।

২০০৭ সালের দিনপঞ্জিতে ১৫ সেপ্টেম্বরের ঘরে আজ সকালেই কাটাচিহ্ন দেওয়া হয়েছে। ৫ ডিসেম্বর আসতে আর কত দেরি? হাজারতম বারের মতো মনে মনে হিসাব করে রানী।

বিয়ের সময়ের কথা তার প্রায়ই মনে পড়ে। আড়াল থেকে প্রথমবার লোকটাকে দেখে কী যে মন খারাপ হয়েছিল। সবাই বলাবলি করছিল, ‘জামাইয়ের মাথায় চুল কম। আর আমাগের পরীর মতো মেয়ে। এই ছেলের সাথে কি মানাবে?’

অথচ বিয়ের কদিন পর এই কেশবিরল মস্তক লোকটার জন্যই মনটা কেমন কেমন করতে শুরু করল। রাতের বেলা মফস্‌সলের ফাঁকা রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নূর ইসলাম যখন খোলা গলায় গাইত, ‘আগে যদি জানতাম,/ তবে মন ফিরে চাইতাম;/ এই জ্বালা আর প্রাণে সহে না…;’ রানীর মনে হতো এ রকম একটা মানুষই তো চেয়েছিলাম।

কিন্তু এখন সত্যিই এই জ্বালা আর প্রাণে সইছে না।

ছেলেটাকে খাওয়ানোর জন্য খিচুড়ি গরম করে এনে মাত্রই বসেছে রানী। এমন সময় ফোন বাজল আবার। ফোন ধরে অজান্তেই শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে যায় সে।

‘হ্যালো।’

‘জি, ভাবি? আমরা পৌঁছাইসি। আপনার শাশুড়ি, দেবর সামনেই আছে।’

‘ভাই, সত্যি কইরে বলেন তো কী হইসে?’ রানীর গলা কাঁপে।

‘মানে ভাবি…আসলে একটা সমস্যা হয়ে গেছে। নূর ইসলাম ভাইরে তো সকাল থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।’

‘পাওয়া যাচ্ছে না মানে?’

‘মানে সকালে সে বাড়ি থেকে বেরোয়ে আমাদেরই একটা অফিসে গিয়েছিল। এরপর থেকে ভাইয়ের কোনো খোঁজ নেই …’

পরের কথাগুলো রানী আর শুনতে পায় না। আচমকা তার মনে হয়, একটা গভীর কুয়ার ভেতর সে পড়ে যাচ্ছে। হারিয়ে যাচ্ছে। কুয়ার মুখের আলোর গোলকটা ছোট হতে হতে একসময় যেন বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যায়।

দাঁড়ানো অবস্থা থেকেই ধড়মড় করে পড়ে যায় রানী।

অনন্ত যাত্রা

স্থান: অজানা, আফগানিস্তান

‘তোমরা আমাকে মেরে ফেলো। আর হাঁটতে পারব না।’ বলতে বলতে পাহাড়ের ঢালে আমি একরকম শুয়ে পড়লাম। ওরা শুনল না। টান মেরে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিল। ধমক দিয়ে বলল, ‘হাঁট! আরেকটু। আমরা প্রায় পৌঁছে গেছি।’

কোথায় যাচ্ছি, জানি না। কোথায় আছি, তা-ও না। কাবুলের রাস্তায় যেতে যেতে একসময় মেইন রোড থেকে গাড়ি ঢুকে পড়েছিল পাহাড়ের মাঝখানে, কাঁচা রাস্তা ধরে। সে-ই আমার শেষ আলো দেখা। এরপর সব অন্ধকার। চোখে কালো কাপড় বেঁধে দিয়েছিল ওরা।

আমার পরনে শার্ট, ওয়েস্টকোট, জিনসের প্যান্ট, আর মোজা। অফিস থেকে টেনেহিঁচড়ে বের করে আনার সময় জুতা পরার সুযোগটাও দেয়নি। এদিকে গাড়ি থেকে নামার পর পাহাড়ি পথ ধরে হাঁটছি ঘণ্টাখানেক হলো। এখানকার পাহাড়ে বুনো ঘাসের মধ্যে একধরনের কাঁটা থাকে। কাঁটা ঢুকে আমার দুই পায়ের পাতা ভেসে যাচ্ছে রক্তে। দুয়েকবার দাঁড় করিয়ে ওরা আমার পা থেকে কাঁটা তুলে দিয়েছে। কিন্তু থামতে দিচ্ছে না কিছুতেই। দুপাশ থেকে দুজন দুই বাহু ধরে রেখেছে। যখন একটু ওপরের দিকে টান দিচ্ছে, বুঝতে পারছি, সামনে উঁচু কিছু আছে। সাবধানে পা ফেলার চেষ্টা করছি।

মনে হলো একটা পাহাড়ের অনেক ওপরে, গুহার ভেতরে এসে আমরা থামলাম। আমি বললাম, ‘ভাই, আমি রোজা রেখেছি। ইফতারের সময় হলে আমাকে একটু পানি দিয়ো।’

ওরা কিছু বলল না।

ততক্ষণ পর্যন্ত বাঁচিয়ে রাখবে কি না, কে জানে!

গুহার মধ্যে বসে হাজারো চিন্তা আমার মাথায় ঘুরপাক খেতে লাগল। কেন যে এই দেশে এসেছিলাম! এখানে যদি মরে যাই, মা-ভাই-স্ত্রী-সন্তান কি আমার লাশটা পাবে? কখনো হয়তো আমার কবর জিয়ারতের সুযোগও পাবে না। একে তো শরীর ভীষণ ক্লান্ত। তার ওপর ঠোঁটে-পায়ে যখম। শক্তি সঞ্চয় করার জন্য আমি মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে থাকলাম।

একটা সময় ওরা আবার আমাকে পাহাড় থেকে নিচের দিকে নামিয়ে আনল। কাঁটাভর্তি পা নিয়ে নামতে কী যে কষ্ট হলো! শুনতে পেলাম, নিচু গলায় ওরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। ভাষাটা পশতু, কিন্তু দুয়েকটা শব্দ ছাড়া কিছুই বুঝলাম না।

একজন আমার হাতে এক গ্লাসে পানি তুলে দিল। বলল, ‘রোজা খালাস,’ অর্থাৎ রোজা শেষ, ইফতার করো। এক গ্লাস পানি খেয়েও মনে হলো পিপাসা মেটেনি একটুও। ভয়ে ভয়ে বললাম, ‘আমি আরেকটু পানি খাব।’

ওরা বলল, ‘পানি খালাস।’ অর্থাৎ পানি শেষ। কেউ একজন আমার হাতে একটা ঠান্ডা কোমল পানীয়র ক্যান ধরিয়ে দিল। খালি পেটে ওসব খেতে ইচ্ছে হলো না। আমি ফিরিয়ে দিলাম।

আমার বাহু ধরে চরকার মতো কয়েক পাক ঘোরাল। তারপর একদিকে নিয়ে যেতে শুরু করল। বুঝলাম, কোনদিকে যাচ্ছে সেটা আমাকে বুঝতে দিতে চায় না।

টের পেলাম, চোখ বাঁধা থাকলে মানুষের অন্য ইন্দ্রিয়গুলো প্রবলভাবে কাজ করে। বাতাস, ঘ্রাণ, শব্দ, স্পর্শ—এসবই আমাকে বলে দিচ্ছিল, আশপাশে কজন মানুষ, জায়গাটা কেমন।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর আমরা থামলাম। শব্দ শুনে বুঝলাম, কাছাকাছি একটা গাড়ি আছে। কয়েকজন আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিল।

কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঠেলেঠুলে আমাকে গাড়ির পেছনে তোলা হলো। কিন্তু জায়গার তুলনায় আমার শরীরটা বড়। ওরা দু-তিনজন মিলে এমনভাবে চাপাচাপি করতে শুরু করল, যেন মানুষ নয়, একটা বস্তা ঢোকাচ্ছে। কয়েকজন পা দিয়ে চেপে চেপে আমাকে আরও ভেতরে ঢোকানোর চেষ্টা করতে লাগল।

ব্যথায় আমি কুঁকড়ে উঠলাম। সঙ্গে সঙ্গে থুতনিতে ঘুষি মারল কেউ একজন। বুকে-পেটে পড়ল আরও কয়েক ঘা। এরপর আমি আর টুঁ–শব্দ করলাম না। বুঝলাম, শব্দ করলেই মার খেতে হবে।

দরাম করে মুখের ওপর বনেটটা বন্ধ হয়ে গেল।

গাড়ি চলা শুরু করতেই বুঝতে পারলাম, রাস্তাটা এবড়োখেবড়ো। একেকটা ঝাঁকির সঙ্গে শরীরের নানা জায়গায় আঘাত লাগতে থাকল। কোথাও কেটে যাচ্ছে, কোথাও ছড়ে যাচ্ছে। আমার মনে হলো এসবের কিছুতেই কিছু যায়–আসে না। মৃত্যুভয়ের কাছে শরীরের ব্যথা-বেদনা তুচ্ছ।

কিন্তু একটু পর গাড়ির নিচ থেকে একরাশ ধুলা এসে নাকে–মুখে ঢুকতে শুরু করল। ঠিকমতো শ্বাসই নেওয়া যাচ্ছে না। এবার আমি যতটা সম্ভব চিৎকার করে ওদের ডাকতে চেষ্টা করলাম, ‘ব্রাদার! ব্রাদার!’

বেশ কিছুক্ষণ ডাকাডাকির পর গাড়িটা থামল। টের পেলাম ওরা দরজা খুলে নেমে আসছে। আবারও সজোরে ঘুষি বা লাথি খাওয়ার জন্য মনে মনে প্রস্তুত হয়ে গেলাম আমি। তেমন কিছু অবশ্য হলো না। ডালা খোলার পর কিছুক্ষণ নিস্তব্ধতা। হঠাৎই আমার মুখে পানি ছিটাতে শুরু করল কেউ। মুখ যে ধুলায় ভরে গেছে, সেটা সম্ভবত ওরা দেখতে পেয়েছে।

কেউ একজন আমাকে পানি খাইয়ে দিল। প্রচণ্ড পিপাসায় মনে হচ্ছিল সারা দুনিয়ার পানি এক চুমুকে খেয়ে ফেলতে পারব। এরপর আবার ধড়াস করে ‍মুখের ওপর বন্ধ হয়ে গেল বনেট।

গাড়ি চলতে শুরু করল। আবার সেই ঝাঁকি। শরীরের কোথাও ব্যথা, কোথাও তীব্র জ্বলুনি। তার ওপর নাকে–মুখে ঢুকে পড়া একরাশ ধুলা।

কিছুক্ষণ পরপর আমি চিৎকার করতে থাকলাম। ওরা গাড়ি থামিয়ে আমাকে ধমক দেয়। বলে, ‘এই তো চলে এসেছি। আর অল্প একটু।’

এভাবে কতক্ষণ গাড়ি চলল জানি না। আমি শুধু অপেক্ষা করতে থাকলাম। মৃত্যু আর কত দূরে?

পালানোর পালা

অজানা গুহা, আফগানিস্তান

দুদিন পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে ওরা চোখের বাঁধন খুলে দেয়নি একটি বারের জন্য। বাইরে আলো না আঁধার, সকাল না দুপুর—বোঝার উপায় নেই।

নামাজের সময় হলে ওরা হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেয়। কিবলার দিকে মুখ করে দাঁড় করিয়ে দেয়। তবু চোখের বাঁধন খোলে না। সাহ্‌রি আর ইফতারে খেতে দেয় দুধ শুকনো রুটি। কখনো শুধু চা।

পাহাড়ি পথ বেয়ে, কখনো হাঁটুসমান নদী পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শেষ পর্যন্ত আমাকে আনা হয়েছে একটা গুহামতো জায়গায়। সারা দিন কুণ্ডলী পাকিয়ে পড়ে থাকি। ঘুম হয় না একমুহূর্তের জন্য। মনে মনে শুধু দোয়া পড়ি। আল্লাহকে ডাকা ছাড়া আমার আর কী করার আছে?

দিনের বেশির ভাগ সময় ওরা রেডিওতে খবর শোনে। আর মোবাইলে কথা বলে। কী বলে, বুঝি না একবিন্দু।

হঠাৎই টের পেলাম, গুহার ভেতর নতুন কয়েকজন লোক এসেছে। হাঁটা, চলা, কথার শব্দে অনুমান করলাম, সংখ্যায় দু-তিনজন হবে। দুজন আমাকে টান মেরে বসিয়ে দিল।

বাকিরা কি এদের অপেক্ষাতেই ছিল? এখনই কি সব শেষ?

আমি জোরে জোরে কালেমা পড়তে শুরু করলাম, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ।’

একজন প্রশ্ন করল, ‘তুই মুসলমান?’

বললাম, ‘হ্যাঁ।’

‘তাহলে হামিদ কারজাই কী?’

আমি একটু ভড়কে গেলাম। এই প্রশ্নের উত্তর কী হওয়া উচিত?

ওরাই উত্তর দিল, ‘কারজাই-ও মুসলমান। কিন্তু কাজ করে আমেরিকার সরকারের সঙ্গে। যারা শিরক করে, কুফরি করে, তাদের শাস্তি একটাই। মৃত্যুদণ্ড। তুই আমেরিকার হয়ে কাজ করিস। কারজাই সরকারের হয়ে কাজ করিস। তোকে আমরা হালাল (জবাই) করব।’

আমি বোঝানোর চেষ্টা করলাম, ‘ভাই, তোমরা ভুল করছ। আমি আমেরিকার লোকও না, কারজাইর লোকও না। আমি বাংলাদেশি। আমার দেশের ৯৫ শতাংশ মানুষ মুসলমান। আমাদের দেশে মসজিদে মসজিদে সারা বিশ্বের মুসলিমদের জন্য দোয়া হয়। বিশ্বাস না হলে খোঁজ নিয়ে দেখো…’

আমার কোনো কথা ওরা মানল না। শেষ কথা একটাই, ‘তোকে হালাল করা হবে।’

এ যাত্রায় ওরা চলে গেল। মনে মনে ভাবলাম, এবারও কি বেঁচে গেলাম? ওরা তাহলে কিসের জন্য অপেক্ষা করছে? কিংবা কার জন্য অপেক্ষা করছে?

ঠিক করলাম, এখান থেকে পালাতে হবে। যে করে হোক।

গত দুদিনে আমার মনে হয়েছে, ইফতারের পর একটা দীর্ঘ সময় আশপাশে কেউ থাকে না। পালানোর জন্য ওটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। ওঁত পেতে থাকলাম। মড়ার মতো পড়ে রইলেও কান থাকল সজাগ। কয়েকবার হেলিকপ্টারের শব্দ শুনতে পেলাম। সম্ভবত মার্কিনিদের। হেলিকপ্টারের শব্দ কানে এলেই ওরা সজাগ হয়ে যায়। আর এদিকে আমার বুক ধুকধুক করে। একটা বোমা ছুড়লেই তো সব শেষ। নাহ্‌, আর দেরি করা যাবে না।

পরদিন সকাল থেকে কাজে লেগে পড়লাম। পিছমোড়া করে বাঁধা হাত দুটো ততক্ষণে অনেক কষ্টে সামনে এনেছি। চোখের বাঁধনটাও একটু ঢিলা হয়ে এসেছে। কিছুক্ষণ চেষ্টার পর আশপাশটা ঝাপসাভাবে দেখতে পেলাম। মনে হলো গুহার মুখটা বেশ বড়। এক কোনায় একটা বদনা। আরেক পাশে একটা কোদাল রাখা। গুহার আশপাশেই ওরা আছে।

কোদাল কেন? আমাকে মারার পর মাটি খুঁড়ে চাপা দেওয়ার জন্য? বিষয়টা কিছুতেই মাথা থেকে দূর করতে পারলাম না। পালানোর চিন্তাটা মাথায় আরও জেঁকে বসল।

দুপুরের দিকে মনে হলো, আশপাশে কেউ নেই। আমি এবার হাতের বাঁধন খোলার চেষ্টা শুরু করলাম। দীর্ঘক্ষণ খাটাখাটনি করতে করতে যখন সফল হলাম, তখন প্রায় বিকেল। চোখ থেকে কাপড়টা সরাতেই বিকেলের হালকা আলোও যেন তির হয়ে বিঁধল। দেখলাম, গুহায় আমি একা। কেউ নেই।

অদূরে আছে নিশ্চয়ই।

ভাবলাম, রাতে পালালেও আপাতত জায়গাটা দেখে রাখি। তাহলে পরে সুবিধা হবে। পায়ের শিকল কীভাবে খুলব, সেটা একটা মুশকিল। বাঁধনটা ভালো করে লক্ষ করলাম। বাঁ পায়ে একটা আংটা লাগানো, তার সঙ্গে লম্বা শিকল। সেই শিকলই দুই পায়ে জড়িয়ে বাঁধা।

একটু চেষ্টা করতেই বাঁধন খুলতে সময় লাগল না। কিন্তু আংটা খুলে কী করি? অগত্যা এক পায়ের সঙ্গে আংটায় বাঁধা শিকলটা হাতে নিয়েই আমি সন্তর্পণে গিয়ে দাঁড়ালাম গুহার মুখে। চারদিকে উঁচু উঁচু পাহাড়। এত ওপর থেকে এমন অদ্ভুত দৃশ্য আমি কখনো দেখিনি। নিচে তাকিয়ে মাথাটা ঘুরে উঠল। সমতল থেকে জায়গাটা প্রায় দুই–আড়াই হাজার ফুট উঁচু হবে। এত ওপরে আমি এলাম কী করে, কে জানে!

দেখলাম গুহার পাশ দিয়েই ওপর থেকে নিচের দিকে একটা পথ চলে গেছে। সেখানে কিছু ছাগলের বিষ্ঠা চোখে পড়ল। তার মানে আশপাশে বাড়িঘর আছে।

পায়ে হাঁটা পথটা দিয়ে অল্প একটু উঠলাম। আশপাশে কেউ নেই। এবার আর পালানোর লোভ সংবরণ করতে পারলাম না। ছুটতে শুরু করলাম।

শরীরে প্রচণ্ড ক্লান্তি। সারা শরীরে ক্ষত। তার ওপর হাতে ধরা ভারী শিকল। শিকলের অপর প্রান্ত বাঁ পায়ে বাঁধা। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও আমি ছুটলাম প্রাণপণ। আধ কিলোমিটারের মতো যেতে না যেতেই মনে হলো, বিরাট ভুল করে ফেলেছি। যে জায়গায় ওরা আমাকে রেখেছে, সেখান থেকে সুস্থ অবস্থায় ছেড়ে দিলেও একা একা নিচে নামা আমার পক্ষে সম্ভব না। অন্তত জীবিত অবস্থায় তো না-ই। পাহাড়টা রীতিমতো খাড়া। ছোট–বড় পাথরের ছড়াছড়ি। পা হড়কে যেতে পারে যেকোনো সময়।

এগোব, না ফিরে যাব? গায়ে বল পাচ্ছি না একদমই। মনে হচ্ছে সামনে-পেছনে কোনো দিকে না গিয়ে এখানেই বসে পড়ি।

আমি যখন শরীরের সমস্ত শক্তি এককাট্টা করার চেষ্টা করছি, ঠিক তখনই পাহাড়ের ওপর থেকে একজন আমাকে দেখে ফেলল। কাঁধের একে-৪৭ মুহূর্তে চলে এল তার হাতে। আমার দিকে তাক করে বলল, ‘দাঁড়াও!’ লোকটা একটু একটু করে এগোতে থাকল, আর আমি পেছাতে থাকলাম। খেয়াল করলাম, সে একটা নিরাপদ দূরত্ব রাখার চেষ্টা করছে। একটা সময় সে আমার দিকে পাথর ছুড়তে শুরু করল। এমনভাবে পাথর মারছে যে গুহার দিকে যাওয়া ছাড়া আমার কোনো উপায় নেই।

ততক্ষণে হাল ছেড়ে দিয়েছি। পায়ে পায়ে গুহার দিকেই ফিরে গেলাম। লোকটা এবার খুব কাছ থেকে বড় বড় পাথর ছুড়তে লাগল। দুইটা পাথর মাথায় লাগতেই আমি জ্ঞান হারালাম।

যখন জ্ঞান ফিরল, টের পেলাম হাত-পা শক্ত করে বাঁধা। সারা গায়ে আঘাতের তীব্র যন্ত্রণা, সঙ্গে জ্বর জ্বর ভাব। বুঝলাম জ্ঞান না থাকা অবস্থাতেই ওরা আমাকে ভীষণ মার মেরেছে।

কেন যে এই বোকামি করতে গেলাম। নিজের ওপর ভীষণ রাগ হলো আমার। একে তো পালানোর চেষ্টা করেছি, তার ওপর ওদের আস্তানাটাও দেখে ফেলেছি। এবার আমার বাঁচার আর কোনো পথ নেই।

আফগানিস্তানের তোলো টিভিতে প্রচারি ত ভিডি ও থেকে পাওয়া এই ছবিটিই জানান দিয়েছিল, নূর ইসলাম বেঁচে আছেন

খবর

ফরিদপুর, বাংলাদেশ

ঘরভর্তি মানুষ। আত্মীয়স্বজন আসছে। সাংবাদিকেরা আসছে। নানা প্রশ্ন করছে সবাই। রানীর কারও সঙ্গেই কথা বলতে ইচ্ছা করছে না। তিন–চার দিন তো পেরিয়ে গেল। কই, কেউ তো বলতে পারছে না, নূর ইসলাম বেঁচে আছে না মারা গেছে।

এদিকে ঘরে এত মানুষের যাওয়া–আসা দেখে ছেলেটা ঘাবড়ে গেছে। একটু পরপর কাঁদছে চিৎকার করে। ছেলেকে কোলে নেওয়ার শক্তিটাও যেন রানীর নেই। বিছানা থেকে উঠলেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠছে। দুই ব্যাগ স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্বলতা কাটছে না কিছুতেই।

ফোনের ভাইব্রেশনের শব্দ পেয়ে রানীর বুকটা ধক করে ওঠে। কোনো সংবাদ কি এল? কিংবা দুঃসংবাদ?

‘হ্যালো।’

‘ভাবি, আমি আকবর। সাংবাদিক। যশোরে বাড়ি। চিনিসেন?’

রানী ঠিক চিনতে পারে না। কিন্তু কথা বাড়াতে ইচ্ছে হয় না। ‘জি ভাই, বলেন…’

‘খবর আছে ভাবি। ভাই বেঁচে আছে!’

‘কী বলছেন! সত্যি? আপনি কীভাবে খবর পাইলেন? পাওয়া গেছে তারে? আপনি তারে দেখিসেন?’ রানীর চিৎকার শুনে পাশের ঘর থেকে বড় বোন ছুটে আসে।

‘আফগানিস্তানের একটা চ্যানেল, তোলো টিভিতে ভাইরে দেখা গেছে। তালেবান তারে মারধর করতিছে। কিন্তু বাঁইচে আছে।’

রানী হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে। কার কাছে যাব, কী করব, ভেবে তার অসহায় লাগে।

পরদিন দেশের প্রায় সব পত্রিকার প্রথম পাতায় ছাপা হয় একটা সাদাকালো ছবি। পরনে শার্ট, জিনসের প্যান্ট; চোখে কাপড় বাঁধা, এক তরুণ কাত হয়ে পড়ে আছেন। ভিডিও থেকে নেওয়া ছবিটা ঠিক পরিষ্কার নয়। কিন্তু পরিচিতজনদের চিনতে অসুবিধা হয় না, মানুষটা নূর ইসলাম।

মৃত্যুর মুখ

স্থান: অজানা, আফগানিস্তান

কুকুরের ডাক যে এত ভয়ানক শোনাতে পারে, কখনো কল্পনাও করিনি।

এক জায়গায় ঠায় বসে আছি অনেকক্ষণ। দীর্ঘ পথ হাঁটিয়ে ওরা আমাকে এখানে এনেছে। আবারও সেই পাহাড়ি ঢাল বাওয়া পাথুরে রাস্তা, কাঁটাভর্তি ঘাস। মাঝে এক রাত কেটেছে কোনো এক গুহায়। সেখান থেকে আসার পথে গাড়ির হর্ন, তীব্র পানির স্রোতের শব্দও শুনেছি। হয়তো আশপাশেই লোকালয় ছিল।

পালানোর চেষ্টা করার পর থেকে আমার অবস্থার দুটো পরিবর্তন এসেছে। প্রথমত ওরা আমার সঙ্গে আর অত কথা বলতে আসছে না। আচরণেই বুঝতে পারছি, ভীষণ রেগে আছে। দ্বিতীয়ত, আমার দুই হাত দড়ির বদলে শিকল দিয়ে বাঁধা হয়েছে।

গরু জবাইয়ের মতো একটা তীব্র গোঙানির শব্দ কানে এল। আমার মতো আরও কাউকে কি এখানে ধরে এনেছে? তাকে কি মাত্রই জবাই করা হলো?

কুকুরগুলোর চিৎকারের মাত্রা যেন বেড়ে গেল কয়েক গুণ। ভয়ে আমার সারা শরীর হিম হয়ে এল। মাত্রই জবাই করা লোকটাকে কি কুকুরগুলো ছিঁড়ে খাচ্ছে? প্রথমবারের মতো চোখের ওপর ভীষণ শক্তভাবে এঁটে থাকা কালো কাপড়টাকে আশীর্বাদ বলে মনে হলো।

একবার ভাবলাম উঠে দৌড় দিই। আশপাশে কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকি। পেছন থেকে যদি গুলিও করে, তা–ও ভালো। নাহ্‌। চিন্তাটা মাথা থেকে দূরে সরানোর চেষ্টা করলাম। একবার পালাতে গিয়েই যথেষ্ট মার খেয়েছি। আর না।

হঠাৎই দুজন আমাকে দুদিক থেকে আঁকড়ে ধরল। টানতে টানতে নিয়ে গেল সামনের দিকে। টের পেলাম, কুকুরগুলোর চিৎকার এখন খুব কাছ থেকে শোনা যাচ্ছে। আশপাশে আরও অনেকেই আছে। ওদের আচরণ ঠিক স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। স্পষ্টই বুঝলাম, একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে।

দারি ভাষায় একজন কথা বলে উঠল, ‘কেউ যদি একটা শিরক করে, আমরা তাকে হালাল করি। তুই চারটা শিরক করেছিস। আমাদের কমান্ডারের নির্দেশ, আজকেই তোকে হালাল করা হবে। আজ তোর জীবনের শেষ দিন।’

এই কণ্ঠস্বরটা আগে কখনো শুনিনি। তবে তার কথা বুঝতে কোনো অসুবিধা হলো না। কারণ, দারি ভাষাটা আমি ভালোই জানি। বললাম, ‘কী শিরক করেছি?’

ভরাট কণ্ঠ আবার বলে উঠল, ‘এক. আমেরিকার পক্ষে কাজ করছিস। দুই. কারজাই সরকারকে সাহায্য করছিস। তিন. যেটার জন্য আমরা জিহাদ করছি, তুই সেটাই করেছিস। আমাদের মহিলাদের বাড়ির বাইরে এনে তাদের সঙ্গে কাজ করছিস। আর চার. এ দেশে তোরা সুদের কারবার করিস। সুদ হারাম। তাই কমান্ডারের নির্দেশ, তোকে হালাল করতে হবে। আজই।’

আমি ভাঙা ভাঙা দারি ভাষায় বললাম, ‘বিশ্বাস করো, আমি এক টাকা সুদও বহন করিনি। তোমরা লোগার প্রভিন্সে খোঁজ নিয়ে দেখো…’

এ কথা সত্যি। আফগানরা ঋণ পরিশোধ করার ব্যাপারে খুবই সচেতন। টাকা মেরে দেওয়ার লোক ওরা নয়। কিন্তু শুধু মূল টাকাটাই ওরা দেয়, সুদের টাকা দিতে চায় না। তাই আমরা অনেকবার বলা সত্ত্বেও সুদের টাকা ওরা কেউই দেয়নি।

আমি বোঝাতে চেষ্টা করলাম, ‘তোমাদের মহিলাদের সঙ্গেও আমাকে কোনো কাজ করতে হয় না। কারণ তারা ইংরেজি বোঝে না। কথাবার্তা যা বলার আমি ম্যানেজার ভাইদের সঙ্গেই বলি…আমি আমেরিকার লোক না, কারজইর লোকও না। আমরা এই দেশে এসেছি তোমাদেরকে কাজ শেখাতে। যেন তোমরা নিজেদের উন্নতি করতে পারো। তোমরা কাজটা শিখে ফেললেই আমি আমার দেশে চলে যাব…’

গড়গড় করে একগাদা কথা বলে বুঝলাম, কোনো লাভ নেই। ওরা আমার কথা মানবে না। আমি চুপ হয়ে গেলাম। কাঁদতে কাঁদতে আল্লাহকে ডাকতে লাগলাম। বললাম, ‘আল্লাহ! তুমি ছাড়া এই বিপদ থেকে আমাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না।’ মা, স্ত্রী, সন্তানের মুখটা মনে পড়তে লাগল বারবার।

ওদের মধ্য থেকে একজন বলল, ‘বাড়িতে কে কে আছে?’

‘আমার মা, স্ত্রী, এক ছেলে। ভাই–বোন…’

‘তুই বাংলাদেশে কোন নম্বরে কথা বলিস? নম্বর দে। ধরিয়ে দিচ্ছি। মৃত্যুর আগে তোর মা, স্ত্রী, পুত্রের সঙ্গে কথা বল। ওদের কাছ থেকে বিদায় নে।’

প্রিয়জনদের গলার স্বরটা একবার শোনার জন্য বুকটা হু হু করে উঠল। কিন্তু আমি দাঁতে দাঁত চেপে থাকলাম। আমি কোন পরিস্থিতিতে আছি, এই কথা ওদের কীভাবে বলি! মা এই কষ্ট কোনো দিন সহ্য করতে পারবে না। রানী তো পাগল হয়ে যাবে! এর চেয়ে নীরবে মরে যাওয়া ভালো।

আমি বললাম, ‘নম্বর আমার মনে নেই। ফোনে সেভ করা ছিল।’

ওরা ঠিকই বুঝল, আমি কথা বলতে চাচ্ছি না। একজন আমার খুব কাছে এসে ঝুঁকে দাঁড়াল। তার গায়ের উত্তাপ আমি টের পেলাম। বলল, ‘মোহাম্মদ নূর, ভুল কোরো না। এই সুযোগ আর আসবে না। অন্তত তোমার ছেলের সঙ্গে কথা বলো।’

আমি এবারও শক্ত হয়ে থাকলাম।

‘বললাম তো। নম্বর মনে নেই। আমাকে আর কষ্ট দিয়ো না। তোমাদের যা করার তাড়াতাড়ি করো।’ পরের কথাটা বলতে গিয়ে আমার গলা কেঁপে এল, ‘শুধু একটা অনুরোধ। আমাকে গুলি করে মারো। জবাই কোরো না।’

ওরা শুনল না। গুলি করার নিয়ম নেই। জবাই–ই করতে হবে।

আমার মাথার ওপর একটা কাপড় দিয়ে দেওয়া হলো। বুঝতে পারলাম, কাপড়ের আড়ালে আমার বুক পর্যন্ত ঢাকা পড়ে গেছে। এরপর দুজন মিলে চেপে ধরে আমাকে একটা গাধার ওপর বসিয়ে দিল। বলল গাধার কুঁজটা শক্ত করে ধরে রাখতে।

আগেই শুনেছিলাম, তালেবান কাউকে জবাই করার আগে গাধার পিঠে বসিয়ে দেয়। তারপর গাধাটাকে হাঁটাতে থাকে। হাঁটতে হাঁটতে গাধা যখন ভার সইতে না পেরে সামনের পা দুটো মুড়ে ফেলে, সওয়ারির মাথাটা নিচু হয়ে যায়, তখনই ওরা জবাই করে।

আমার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল অঝোরে। এই অন্ধকারের মধ্যেই আমার মরণ হবে? এই অপূর্ব সুন্দর পৃথিবীটা আর কোনোদিন দেখব না? আমি বললাম, ‘তোমরা আমাকে একটুখানি সময় দাও। আমি তো মুসলমান। আমি তওবা করব। তারপর যা করার কোরো।’ ওরা কথা রাখল। আমি তওবা করে বুকে ফুঁ দিলাম।

প্রচণ্ড পানি পিপাসা লাগতে শুরু করল। একবার মনে হলো একটু পর তো মরেই যাব, পিপাসা মিটিয়ে আর কী হবে। কিন্তু পিপাসা এমন এক জিনিস, যে একবার মাথায় ঢুকলে আর বের হতে চায় না। এই চরম বিপদের মুহূর্তেও বলে ফেললাম, ‘পানি খাব।’

এবারও ওরা কথা রাখল। এক ঘটি পানি আমার হাতে দিল। ঢকঢক করে পুরোটা পানি খেয়ে নিলাম। একে তো হাতে বল নেই, তার ওপর কাঁপছিল ভীষণ। অনেকটা পানিই জামায় পড়ে গেল।

ওরা গাধাটাকে হাঁটানো শুরু করল। বুঝতে পারলাম একই জায়গা ঘিরে গাধাটা ঘুরপাক খাচ্ছে। আর ওদের কয়েকজন আমার পাশে পাশে হাঁটছে।

রানীর কথা মনে পড়ল ভীষণ। রানী কি কোনোদিন আমাকে ক্ষমা করবে? ওর কথা না শুনেই তো আজ এই বিপদে পড়েছি। রানী বলেছিল বিপদে পড়লে যেন দোয়া ইউনুস পড়ি। আমি জোরে জোরে দোয়া ইউনুস পড়তে শুরু করলাম। রানী কোনোদিন জানবে না, মৃত্যুর আগমুহূর্তে অন্তত আমি ওর কথা শুনেছিলাম।

‘লা ইলাহা ইল্লা আনতা সোবহানাকা ইন্নি কুনতু মিনাজ জোয়ালিমিন!’

বারবার জোরে জোরে দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে একটা ভীষণ আশ্চর্য ব্যাপার ঘটল। মনে হলো আমার সারা শরীর দিয়ে উত্তাপ বের হচ্ছে। শরীরের প্রতিটি মাংসপেশি সজাগ হয়ে গেছে। গায়ের রোম দাঁড়িয়ে গেছে। আচমকা আমার মনে হতে লাগল, আমার কিছুই হবে না। ওরা আমাকে মারতে পারবে না!

এভাবে প্রায় আধঘণ্টা কেটে গেল। গাধা আর হাঁটু গেড়ে পড়ে যায় না, ওরাও হাঁটানো থামায় না। একপর্যায়ে ওদের একজন একে–৪৭ এর বাঁট দিয়ে আমার পিঠে মারতে লাগল। বলল, ‘দোয়া পড়া বন্ধ কর!’

বললাম, ‘না! তোমাদের যা ইচ্ছা করো। আমি দোয়া পড়া বন্ধ করব না।’

একসময় ওরা আমাকে গাধার পিঠ থেকে নামাল। নিজেরা পানি খেল। আমাকে খাওয়াল। তারপর আবার চড়াল গাধার পিঠে। আবার ঘুরপাক খেতে লাগল। কিন্তু যত যা–ই হোক, আমি চুপ করলাম না একবারের জন্যও। দোয়া পড়ে যেতে থাকলাম। দুয়েকবার গাধার কুঁজ থেকে হাত ফসকে গেল। আশপাশে একটা কিছু আঁকড়ে ধরে নিজেকে সামলাতে গিয়ে একবার মনে হলো ছুরির স্পর্শ টের পেলাম। তার মানে আমার ঠিক পাশেই একজন তৈরি আছে উন্মুক্ত ছুরি হাতে।

একটু বিরতি নিয়ে নিয়ে বারবার ওরা গাধাটাকে হাঁটাতে লাগল। বারবারই আমাকে দোয়া পড়া বন্ধ করতে বলল। একসময় বাধ্য হয়ে গাধাটাকে বালুর ওপর নিয়ে হাঁটাল, একে–৪৭ দিয়ে মারল। কিন্তু অবলা প্রাণীটা পড়ে গেল না কিছুতেই। ততক্ষণে কেন যেন আমার মন থেকে ভয়ডর চলে গেছে। মৃত্যুর জন্য তখন আমি প্রস্তুত।

কিছুক্ষণ পর একটা গাড়ি এসে থামল। শুনতে পেলাম ওরা বলাবলি করছে, ‘গাড়ি এসে গেছে। কাজ তো শেষ হলো না।’

আবার আমাকে গাধায় চাপানো হলো। আবার সেই একই চক্কর। মারধর, বকাঝকা। কিন্তু আমি বুঝতে পারলাম, অন্য রকম একটা কিছু ঘটছে। আমি সুরা পড়া থামালাম না একমুহূর্তের জন্য।

এভাবে প্রায় পাঁচ–ছয় ঘণ্টা কাটল। যখন আমার মনে হচ্ছিল আর পারছি না, এর চেয়ে বরং মেরেই ফেলুক, ঠিক তখন একটা ফোন বাজার শব্দ শুনতে পেলাম। উঁচু গলায় কী যেন কথা বলল ওরা। তারপরই ভোজবাজির মতো সব পাল্টে গেল। আমাকে গাধার পিঠ থেকে নামিয়ে মুখে–গালে সবাই মিলে চুমু খেতে লাগল। বলল, ‘মোহাম্মদ নূর, তুই খুব ভালো মানুষ। আমাদের কমান্ডারের নির্দেশ। তোকে আর মারা লাগবে না! তোর অফিসের কাছে আমরা পাঁচ লাখ ডলার চেয়েছি। টাকা পেলেই তোকে ছেড়ে দেব।’

একটু আগেই যারা আমাকে মারতে উদ্যত হয়েছিল, তারাই আমার সঙ্গে কোলাকুলি করতে লাগল। আমি কিছুই বুঝলাম না। শুধু বুঝলাম, আজকের দিনের জন্য বিপদ কেটে গেছে।

পাহাড়ি পথ বেয়ে , কখনো হাঁটুসমান নদী পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে শেষ পর্যন্ত নূর ইসলামকে গুহামতো যে জায়গায় আনা হয়েছিল

বেপরোয়া

ঢাকা, বাংলাদেশ

নূর ইসলাম বেঁচে আছে, জানার পর থেকেই রানীর মধ্যে কেমন যেন একটা অশরীরী শক্তি এসে ভর করেছে। দিনের পর দিন ঘুম নেই, খাওয়া নেই। হাঁটতে গেলেও ‍দুনিয়া দুলে ওঠে। এই শরীর নিয়ে রানী চলে এসেছে ঢাকায়। 

মনে জেদ চেপে গেছে। লোকটা যেহেতু এখনো বেঁচে আছে, জীবিত অবস্থায় আমি তাঁকে দেশে আনবই। যেভাবেই হোক।

এরই মধ্যে একদিন ব্র্যাক অফিসে গিয়ে তুলকালাম বাধিয়ে এসেছে রানী। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে স্যার ফজলে হাসান আবেদের সঙ্গেও দেখা করে কথা বলে এসেছে। খ্যাপাটে রানীকে সামাল দিতে কর্মকর্তারা নানা কথা বলেছেন।

‘চার সদস্যের একটা টিম আফগানিস্তান গেছে।’

‘যা যা করার, আমরা সব রকম চেষ্টা করছি।’

‘সরকার বিষয়টা খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখছে।’

কিন্তু রানীর এক কথা, ‘আপনারা আমারে লিখিত দেন, নূর ইসলামরে জীবিত ফিরায় আনবেন। দরকার হলি আমারে আফগানিস্তানে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। যা করার আমি করব।’

ফজলে হাসান আবেদও রানীর সঙ্গে কথা বলেছেন, আশ্বাস দিয়েছেন; কিন্তু খ্যাপাটে রানী শান্ত হয়নি কিছুতেই। 

অপহরণকারীরা মুক্তিপণ চেয়েছে, এ তথ্য সে সাংবাদিকদের কাছ থেকে পেয়েছে। কিন্তু কত টাকা, কবে দিতে হবে—এসব নিয়ে ব্র্যাক পরিষ্কার করে কিছুই বলছে না। হয়তো তারা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা রকম চাপ প্রয়োগ করে বিষয়টা মীমাংসা করার চেষ্টা করছে। কিন্তু রানীকে সেসব বোঝাবে কে!

রানী ঠিক করেছে সে সরকারের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত যাবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী তখন কোনো একটা রাষ্ট্রীয় সফরে ৮-১০ দিনের জন্য দেশের বাইরে গেছেন। রানী গোঁ ধরে বসল, ৮-১০ দিন সে ঢাকাতেই থাকবে। তবু পররাষ্ট্র উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা না করে সে যাবে না। এদিকে ঢাকায় থাকার মতো তেমন কোনো ব্যবস্থা নেই। নারায়ণগঞ্জে এক আত্মীয়ের বাসায় ঠাঁই হলো তার।

কদিন পর ঈদ। সারা দেশে কেমন উৎসবের আমেজ। বাসে বসে রানী শুনতে পায়, কোনো এক বিপণিবিতানে উঁচু ভলিউমে গান বাজছে, ‘আগে যদি জানতাম,/ তবে মন ফিরে চাইতাম,/ এই জ্বালা আর প্রাণে সহে না…’। রানীর ভেতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, ‘বন্ধ করো! এই গান বন্ধ করো!’

হইহট্টগোলের ঢাকায় এক একাকী নারীর কান্না কেউ ফিরেও দেখে না। 

দেয়ালঘড়ি

স্থান: অজানা, আফগানিস্তান

কত দিন পর ভোর দেখব! অধীর হয়ে অপেক্ষা করছি আমি।

না, মুক্তি এখনো মেলেনি। তবে বন্দী অবস্থায় অনেকগুলো দিন কেটে গেছে। কত দিন, সে হিসাব আমার কাছে নেই। হতে পারে দুই মাস কিংবা তারও কিছু বেশি। মুক্তিপণের জন্য ওরা দফায় দফায় আমার অফিসের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। দাবি—পাঁচ লাখ ডলারের। এত টাকা দিতে অফিস রাজি হচ্ছে না। কিংবা কে জানে, টাকা দিলেই যে আমাকে ছেড়ে দেবে, অফিস হয়তো সেটা বিশ্বাস করতে পারছে না।

তালেবান গুণেন দার (আফগানিস্তানে আমাদের কান্ট্রি হেড গুণেন্দু কুমার রায়) সঙ্গে একাধিকবার আমাকে ফোনে কথা বলিয়ে দিয়েছে। কিন্তু ওদের শেখানো বুলি ছাড়া খুব বেশি কিছু বলার সুযোগ হয়নি। প্রতিবারই আমার ডান কানে ফোন আর বাঁ কানের একটু ওপরে একে–৪৭ ধরা ছিল।

দীর্ঘদিন গুহায় গুহায় থাকার পর এই প্রথম আমার ঠিকানা হয়েছে একটা ঘরে। নানা হাত বদল হতে হতে এখানে এসে পৌঁছেছি। ওদের মধ্যে একজন যখন চোখের বাঁধন খুলে দিচ্ছিল, বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।

আশপাশে এখনো গাঢ় অন্ধকার। শত ব্যথা, বেদনা, ক্লান্তির মধ্যেও এত দিন একমুহূর্তের জন্য ঘুমাতে পারিনি। চোখ বাঁধা থাকলে সবগুলো ইন্দ্রিয় এত সজাগ হয়ে থাকে যে চাইলেও ঘুম আসে না। আজ ভয়ের সঙ্গে আরও একটা অনুভূতি যোগ হয়েছে—রোমাঞ্চ! বহুদিন পর ভোরের আলো দেখার রোমাঞ্চ।

কিছুক্ষণ পর পাখির কিচিরমিচির ডাক কানে আসতে লাগল। বুঝতে পারলাম, আমাকে যেখানে রাখা হয়েছে, তার খুব কাছেই কোনো গাছ আছে। পাখিরা হয়তো সেই গাছ ঘিরেই ছোটাছুটি করছে।

একটু পর একজন এসে আমার হাত ও পায়ের বাঁধন খুলে দিল। বলল, ‘ফজরের আজান হয়ে গেছে। নামাজ পড়ে নাও।’ আমি যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, এত দিনে ওরা জেনে গেছে। চোখ বাঁধা অবস্থায় ফজর, জোহর, আসর, মাগরিব…হিসাব করে বুঝে নিতাম, এখন দিন না রাত। এই প্রথমবারের মতো আমার চোখ খোলা অবস্থায় নামাজ পড়ার সুযোগ হলো।

ভোর হয়ে এসেছে। আমাকে যে ঘরে রাখা হয়েছে, সে ঘরের দরজা–জানালা সবই বন্ধ। কিন্তু দরজা–জানালায় প্রচুর ছোট–বড় ছিদ্র। সেই ছিদ্র দিয়েই একটা অদ্ভুত আলো এসে পড়ল।

প্রথমেই আমি নিজের হাত–পায়ের দিকে তাকালাম। এবং চমকে উঠলাম। এ কী অবস্থা হয়েছে আমার!

বাঁ হাতের তালুতে দগদগে ঘা হয়ে গেছে। হাত পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় এক তালেবান লাথি মেরেছিল। পাথরের ওপর পড়ে হাতের তালুর বেশ খানিকটা মাংস উঠে গেছে। সেখানেই কখনো পুঁজ জমেছে, কখনো চামড়া উঠে এসেছে। চোখ বাঁধা থাকায় এত দিন হাতটা দেখার সুযোগ হয়নি। কিন্তু পুঁজের গন্ধ আমি পেয়েছি। পায়ের তলায় কাটা ঢ়ুকে, ক্ষতবিক্ষত হয়ে সেখানেও পচন ধরে ছিল। চামড়া পচা গন্ধ যে এত বিকট, আগে কখনো জানতাম না। পচা চামড়া খসে গিয়ে পায়ে নতুন চামড়া উঠতে শুরু করেছে।

হাত–পা শুকিয়ে এমন অবস্থা হয়েছে, মনে হচ্ছে স্রেফ হাড় ছাড়া কিছু নেই। শিকল দিয়ে বাঁধা থাকতে থাকতে পায়ের গোড়ালিতেও ঘা হয়ে গেছে। শিকলে একটু টান লাগলেই রক্ত বের হয়।

চোখের ওপর শক্ত করে কাপড় বাঁধা ছিল দুই মাসের বেশি সময়। নাকের ওপরও বেশ বড় একটা ঘা হয়ে গেছে। অজান্তেই বারবার আমার হাত চলে গেল নাকের কাছে। ধরে বোঝার চেষ্টা করলাম, অবস্থা কতখানি খারাপ।

দেয়াল ধরে আমি দাঁড়ানোর চেষ্টা করলাম। অল্প একটু উঠতে উঠতেই মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল। নাহ্‌। পারব না।

কিছুক্ষণের মধ্যে আমার জন্য খাবার এল। আবারও সেই শুকনো রুটি আর চা। কেন যেন মনে হলো, আগে যাদের কাছে ছিলাম, তাদের তুলনায় এই মানুষগুলো একটু ভালো। আগের কমান্ডারের সঙ্গে আমার বেশ ভাব হয়েছিল। তাকে আমি বুঝিয়েছিলাম, ‘তোমরা চাও টাকা। আর আমি চাই আমার দেশে ফিরে যেতে। দুজনের উদ্দেশ্যই এক।’ মাঝেমধ্যে মনে হতো, সে আমাকে বেশ পছন্দই করে। আমাকে বলত, ‘মোহাম্মদ নূর, তুমি খুব ভালো মানুষ।’

প্রহরীদের কারও কারও সঙ্গেও ভালো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সাত–আট দিন পরপরই লোক বদলে যেত। কখনো ভালো, কখনো বদরাগী, কখনো কম বয়সী তরুণ, কখনো মধ্যবয়স্ক, নানা রকম মানুষের সঙ্গে আমাকে সময় কাটাতে হয়েছে।

দেখতে দেখতে এই নতুন ঠিকানার সঙ্গে আমি মানিয়ে নিলাম। আমাকে রাখা হয়েছে একটা রান্নাঘরমতো জায়গায়। এতে খানিকটা সুবিধা হয়েছে। মাঝেমধ্যে পেঁয়াজ, আলু রান্নাঘরে এনে রাখা হয়। প্রচণ্ড ক্ষুধায় আমি কাঁচা আলু চিবিয়ে খাই। একদিন পাশের ঘর থেকে মাংসের ঘ্রাণ নাকে এসে লাগল। হাতে একটা পেঁয়াজ নিয়ে আমি অধীর হয়ে থাকলাম, আজ হয়তো একটু মাংস জুটবে। নাহ্‌। থালায় করে এল সেই একই রুটি আর একখানা আলু। হয়তো মাংস শেষ হয়ে গেছে। পেঁয়াজ দিয়ে রুটি–আলুই আমি খেয়ে নিলাম তৃপ্তি করে।

একদিন সন্ধ্যায় নানা বাদ্যযন্ত্রের শব্দ আমার কানে এল। বাজনা চলল সারা রাত, ভোর পর্যন্ত। এভাবে প্রায় ছয়–সাত দিন ধরে প্রতিদিন রাতেই উৎসব হচ্ছে বলে মনে হলো। এর মধ্যে একজন আমাকে কিছু বাদাম, মিষ্টি, আরও নানা ধরনের খাবার দিয়ে গেল। বলল, পাশেই কোথাও বিয়ে হচ্ছে। ওরা নাকি খাবার পাঠিয়েছে।

এখানে আসার পর থেকে চোখ খোলাই থাকে, তবে নামাজের সময় ছাড়া হাত–পা থাকে বাঁধা। মলত্যাগ করতে চাইলে মাথার ওপর একটা কালো কাপড় দিয়ে ওরা বাইরে নিয়ে যায়। শুধু চা আর শুকনো রুটি খেতে খেতে আমার পেট শক্ত হয়ে গেছে। পায়খানা করতে খুব কষ্ট হয়। কিন্তু ওরা এত সময় দিতে চায় না। বলে, ‘তাড়াতাড়ি কর!’ একদিন দেরি হচ্ছিল বলে এক জওয়ান তালেবান আমার পিঠে লাথি মেরে বসল। প্রচণ্ড রাগে ইচ্ছা হচ্ছিল ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলেছি।

যখন বাইরে গিয়েছি, কালো কাপড়ের ফাঁক দিয়ে আমি দেখেছি, চারদিক উঁচু প্রাচীরে ঘেরা। বেশ কয়েকটা ঘর আছে এখানে। বিকেলবেলা ছেলেদের চিৎকার চেঁচামেচির শব্দ আমার কানে আসে। কাছেই কোথাও ওরা বোধ হয় ফুটবল খেলে। মাঝেমধ্যে মার্কিন সেনাদের হেলিকপ্টারের শব্দ পাই। আর পাই একটা মোটরসাইকেলের শব্দ। সকাল সাতটা–আটটার দিকে মোটরসাইকেলটা বেরিয়ে যায়, আবার বিকেল পাঁচটায় ফেরে।

এখানে আমি আমার নিজের নিয়মে একটা ঘড়ি বানিয়ে নিয়েছি। দরজায় একটা বড় ফুটো আছে। সেখান দিয়ে চিকন আলোর রেখা এসে পড়ে দেয়ালে। আমি বুঝি সকাল হয়েছে। দিন যত গড়ায়, আলোর গতিপথ বদলায়। দেয়ালের এক প্রান্ত থেকে পৌঁছে যায় আরেক প্রান্তে। অদ্ভুত এই ‘দেয়ালঘড়ি’র দিকে তাকিয়ে থেকে আমার দিন পেরিয়ে যায়।

এভাবে দিন গড়াল। আর আমি দুলতে থাকলাম আশা–নিরাশার দোলাচলে। অফিসের সঙ্গে দফায় দফায় কথা হতে থাকল। কিন্তু সমাধান হলো না।

এরই মধ্যে প্রচণ্ড শীত পড়েছে। রাতের বেলা ভীষণ কষ্ট হয়। মনে হতে লাগল, এভাবে আর কিছুদিন গেলে শীতেই আমি মারা যাব।

আফগানিস্তান থেকে ফিরে আসার পর স্ত্রী রানী ও ছেলে আরিয়ানের সঙ্গে নূর ইসলাম
ছবি প্রথম আলো

ঝড়ের পরের নিস্তব্ধতা

ফরিদপুর, বাংলাদেশ

‘নূর ইসলামের বউটা বোধ হয় পাগলই হইয়ে গেল। আহারে মাইয়াটা…’ আড়ালে–আবডালে বলাবলি করে প্রতিবেশী, স্বজনেরা। রানী শুনেও শোনে না। তার সত্যিই পাগল পাগল লাগে।

একটা সময় পর্যন্ত সাংবাদিকেরা নিয়মিত যোগাযোগ করত, খোঁজ নিত। এরই মধ্যে ১৫ নভেম্বর বয়ে গেল প্রচণ্ড ঝড়—সিডর। এরপর থেকে মিডিয়ার সমস্ত মনোযোগ চলে গেছে সেদিকে। একজন নূর ইসলাম আর তার পরিবারের কথা যেন সবাই ভুলেই গেছে।

একটা রাতও ঘুম হয় না রানীর। অনবরত সে শুধু জিকির করতে থাকে। কেন জানি মনে হয়, যতক্ষণ মুখে আল্লাহর নাম আছে, ততক্ষণ নূর ইসলামকে কেউ কিছু করতে পারবে না। মাঝরাতে একটু তন্দ্রামতো এলেও রানী ধড়ফড় করে উঠে বসে। মনে হয়, নূর ইসলামের কিছু হয়ে গেল না তো! আবারও জিকির করতে থাকে সে।

ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আমিনুল আলম দায়িত্ব নিয়েছিলেন, প্রতিদিন রানীর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন, আপডেট জানাবেন। তখন বোধ হয় ভাবেননি, রানী এমন জোঁকের মতো লেগে থাকবে। প্রতিদিন আমিন ভাইকে ফোন করে সে। মাঝে কিছুদিনের জন্য অফিসের কাজে আমিনুল সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন। নানাভাবে নম্বর জোগাড় করে রানী প্রতিদিন সিঙ্গাপুরেও ফোন করে গেছে। ঘুরেফিরে তার এক কথা, ‘একটা কিছু করেন। টাকা লাগলে বলেন। আমি দিব। কত টাকা লাগবে? লাগলি আমি দেশের পত্যেকটা মানুষের কাছে যেয়ে হাত পাতব…’

মাঝেমধ্যে আফগানিস্তান থেকে সদরউদ্দীনের ফোন আসে রানীর কাছে। কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ওপাশ থাকে সদরউদ্দীন নিজের নাম বলে না। শুধু বলে, ‘ভাবি, আমি আপনার একজন শুভাকাঙ্ক্ষী। আপনি ধৈর্য ধরেন। আমরা সব ব্যবস্থা করছি। ভাইকে ফিরায়ে আনবই।’

যশোরের স্থানীয় পত্রিকাগুলোতে তখন প্রকাশিত হয়েছিল নানা সংবাদ
ছবি: প্রথম আলো

দোস্ত

স্থান: অজানা, আফগানিস্তান

‘হ্যালো, সদরউদ্দীন!’ আশায় আমার বুক দুলে উঠল।

এত দিন বহুবার আমাকে ওরা অফিসের সঙ্গে কথা বলতে দিয়েছে। কখনো গুণেন দা, কখনো বা অন্য কোনো কর্মকর্তার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। কেউই খুব একটা আশার বাণী শোনাতে পারেননি। বারবারই বলে গেছেন, ‘আমরা চেষ্টা করে যাচ্ছি।’ আজকে প্রথম ফোনের ওপাশে সদরউদ্দীনকে পেয়ে আমার মনে হলো, একটা উপায় হলেও হতে পারে।

‘গুরু! আপনি বেঁচে আছেন!’ সদরউদ্দীনের গলায় অবিশ্বাস, শঙ্কা, দুঃখ, উত্তেজনা, সবকিছুর মিশেল।

আমি বললাম, ‘তোমাকে কিছু কাজ করতে হবে…’

কথা শেষ করতে পারলাম না। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সদরউদ্দীন লাইন কেটে দিল, নাকি তালেবান, জানি না।

এক ঘণ্টা পর আমি কমান্ডারকে ডাকলাম। মরিয়া হয়ে তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলাম। ‘আমি আমার দোস্তকে পেয়ে গেছি। তোমরা আমাকে আরেকবার কথা বলার সুযোগ করে দাও। আমি তোমাদের টাকার ব্যবস্থা করে দেব।’

তত দিনে বুঝে গেছি, একটা না একটা সুরাহার জন্য ওরাও মরিয়া হয়ে গেছে। অতএব রাজি হয়ে গেল। এখন পর্যন্ত যতবার ফোনে কথা বলেছি, প্রতিবারই তালেবানের কড়া নির্দেশ ছিল, ফারসি বা দারি ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় কথা বলা যাবে না। কারণ, আমি কী বলছি, ওরা শুনতে চায়। কিন্তু এবার কমান্ডারকে বুঝিয়ে বললাম, সদরউদ্দীন বাংলা ছাড়া কিছু বোঝে না। আমাকে যা বলার বাংলায়ই বলতে হবে। এই অনুরোধও কমান্ডার মেনে নিল।

আবারও ফোন করা হলো সদরউদ্দীনকে।

‘সদরউদ্দীন, শোনো…’

‘আপনি আগে আমার কথা শোনেন,’ ধমক দিয়ে বলল সে, ‘ভাবি আর আপনার মায়ের সঙ্গে আমি কথা বলেছি। তারা খুব কান্নাকাটি করছে। আপনি প্লিজ তাদের সঙ্গে একবার কথা বলেন।’

‘কথা বলা যাবে না। সমস্যা আছে।’

একবার এদের বলেছি, বাড়ির নম্বর আমার মনে নেই। আমি যে মিথ্যা বলেছি, এটা বুঝতে দিতে চাই না। বললে নতুন কী বিপদ হয় কে জানে।

১৫–২০ মিনিট কথা হলো সদরউদ্দীনের সঙ্গে। আমি তাঁকে বুঝিয়ে বললাম, টাকা ছাড়া তালেবান ছাড়বে না। কোথা থেকে কীভাবে টাকা জোগাড় করবে, সে কথাও সদরউদ্দীনকে বুঝিয়ে বললাম।

সদরউদ্দীন বলল, ‘ভাই, আমরা অনেকটা গুছিয়ে এনেছি। আপনাকে ছাড়ানোর জন্য পাঁচ–ছয়জনের একটা টিম লোগারে পড়ে আছে। আফগান সরকার এবং তালেবানের সঙ্গে আমাদের সব সময় যোগাযোগ চলছে। আরেকটু ধৈর্য ধরেন। যেভাবে হোক আপনাকে ছাড়ায়ে আনব। এর জন্য যদি আমার চাকরিও যায় যাক।’

‘আমার খুব বাঁচতে ইচ্ছা করছে সদরউদ্দীন…’ বলতে বলতে আমি কেঁদে ফেললাম।

ফোন রাখার পর কেন যেন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না। দুই হাঁটুর মাঝখানে মুখ রেখে আমি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলাম। চোখের পানিতে আমার পা, বুক, সব ভিজে গেল। শরীর ভীষণ দুর্বল। গায়ে হাজারো যখম। এ অবস্থায় কখন, কীভাবে ঘুমিয়ে পড়লাম, জানি না।

আলোর দেখা

স্থান: অজানা, আফগানিস্তান

আমি কি স্বপ্ন দেখছি? এগুলো কি সত্যিই ঘটছে, নাকি কোনো ধরনের হ্যালুসিনেশন?

আধো আধো ঘুমের মধ্যে টের পেলাম, তিন–চারজন তালেবান এসে আমাকে জড়িয়ে ধরছে। মুখে, গালে চুমু খাচ্ছে।

ওদের চিৎকারে ঘোর ভাঙল, ‘সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে নূর। তুমি আজ মুক্তি পেয়ে যাবে।’

আমি জানতাম, ওদের সর্বশেষ শর্ত ছিল—তিনজন তালেবান বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে। সঙ্গে দিতে হবে ৩০ লাখ আফগানি।

বললাম, ‘ব্র্যাক কি ৩০ লাখ আফগানি দিয়ে দিয়েছে?’

‘হ্যাঁ! সব পয়সা দিয়ে দিয়েছে।’

‘আর যেই তালেবান সদস্যদের ছেড়ে দেওয়ার কথা ছিল?’

‘ওরা সবাই এতক্ষণে বাড়ি চলে গেছে…’ চিৎকার করে বলল ওরা। খুশি দেখে মনে হলো আজ ওদের ঈদের আনন্দ।

‘তুমি খুশি হওনি?’ একজন প্রশ্ন করল।

আমি শুধু মৃদু স্বরে বললাম, ‘আলহামদুলিল্লাহ।’

তালেবান তাদের ঘরে চলে যাওয়ার পর আমি দুই রাকাত নফল নামাজ পড়লাম। সত্যি বলতে তখনো খুশি হতে পারছিলাম না। ওরা যা পাওয়ার পেয়ে গেছে। এখন তো আমাকে মেরেও ফেলতে পারে। মাথা থেকে এসব চিন্তা ঠেলে দূর করে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। যা হয় হোক।

একজন আমার হাতে একটা কাঁচি আর আয়না দিয়ে গেল। বলল, ‘সুন্নত করে নাও।’

আমার গোঁফ অনেক বড় হয়ে গেছে। গোঁফ কেটে নেওয়ার কথাই সে বলছে। আয়নায় তাকিয়ে নিজেই নিজেকে চিনতে পারলাম না। বড় বড় দাড়ি। মাথায় অল্প যে চুল আছে, তা–ও ধুলা ময়লায় জট পাকিয়ে গেছে। কাঁপা হাতে গোঁফ কাটতে গিয়ে আমার ঠোঁট কেটে গেল।

কিছুক্ষণ পর একজন এসে একটা শ্যাম্পুর বোতল হাতে দিল। আমাকে নিয়ে গেল অন্য একটা রুমে। সেখানে এক বালতি গরম আর দুই বালতি ঠান্ডা পানি। আমাকে বলল, ‘তুই গোসল করে নে।’

আমি যতই শ্যাম্পু মাখি, দেখি গা থেকে শুধু ময়লা বের হয়। শ্যাম্পুর ফেনা আর হয় না। পুরো তিন বালতি পানি দিয়ে ডলে ডলে গোসল করার পর বুঝলাম, আমার সারা শরীর সাদা হয়ে গেছে।

ওরা আমাকে একটা কাবলি পোশাক দিল। গলায় আচকান আর মাথায় টুপি পরিয়ে দিল। একজন এসে বলল, ‘তোকে খাঁটি মুসলমান বানিয়ে দিলাম।’ এর কিছুক্ষণ পর আমার চোখ বেঁধে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো। বাইরে কী ভীষণ ঠান্ডা! মাইনাস ৭–৮ ডিগ্রি তাপমাত্রা হবে। একজন একটা গরম শাল আমার গায়ে জড়িয়ে দিল।

বেশ কিছুক্ষণ হাঁটার পর একটা জায়গায় গিয়ে থামলাম। শুনতে পেলাম কারও সঙ্গে ফোনে কথা হচ্ছে। একটু পর যখন চোখের বাঁধন খুলে দিল, দেখলাম চারদিকে ধু ধু মরুভূমি। দূরে একটা আলোর রেখা দেখা যায়।

পাশেই দাঁড়িয়ে একজন। তার হাতে একে–৪৭। বলল, ‘ওই যে দূরে আলো দেখতে পাচ্ছিস? আলো বরাবর হাঁটতে থাক। যা, তুই তোর দেশে চলে যা।