হাজার হাজার সেনা কেন মিয়ানমারের জান্তা বাহিনী ছেড়েছেন
গত বছরের আগস্ট মাসের এক রাত। ঝরছিল মৌসুমি বৃষ্টি। এমন আবহাওয়ার মধ্যেই মিয়ানমারের একটি সামরিক ঘাঁটি ছেড়ে চলে যান ওউনা কিয়াও। সঙ্গে ছিলেন তাঁর মতো আরও কয়েকজন সেনাসদস্য। এর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তাঁদের এমন এক জায়গায় মোতায়েনের কথা ছিল, যেখানে দেশটির গণতন্ত্রপন্থী সশস্ত্র বিদ্রোহীদের সঙ্গে জান্তা বাহিনীর চলছিল তুমুল লড়াই।
মিয়ানমারের ওই সামরিক ঘাঁটিটির অবস্থান কারেন প্রদেশে। রাতের যে সময় ওউনা কিয়াও ও তাঁর সহকর্মীরা চলে গিয়েছিলেন, তখন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা ও সেনা কমান্ডাররা ঘুমাচ্ছিলেন। এমন পদক্ষেপের জন্য কমপক্ষে সাত বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। তবে ওউনা কিয়াওয়ের ভাষ্য, ‘আমার বিশ্বাস, চলে না গেলে আমি মারা পড়তাম।’
জানা গেছে, আত্মসমর্পণ করা দায়ে ওই ছয় জেনারেলের কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে।
ওউনা কিয়াওয়ের মনে শুধু কিছুক্ষণ বাদে লড়াইয়ে যোগ দেওয়ার ভয়ই কাজ করছিল না, বেসামরিক লোকজনের ওপর সামরিক বাহিনীর সহিংসতা নিয়েও আপত্তি ছিল তাঁর। দুই কারণেই তাঁর ঘাঁটি ছেড়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত। তিনি বলেন, ‘আমি সেখানে আর থাকতে চাচ্ছিলাম না। মানুষের জন্য আমার খারাপ লাগে। আমার বাবা–মায়ের বয়সী মানুষগুলোকে মেরে ফেলা হচ্ছে। অকারণে তাঁদের ঘরবাড়িগুলো ধ্বংস করা হচ্ছে। আমি এসব দেখেছি। চোখের সামনেই সব ঘটেছে।’
ওউনা কিয়াওয়ের ওই ঘটনার পরের কয়েক মাসে জান্তা বাহিনীর আরও হাজার হাজার সেনা বিদ্রোহীদের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন বলে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এই সেনাদের অনেকে জানিয়েছেন, নৈতিকভাবে তাঁরা ওই অন্যায় মেনে নিতে পারেননি। তা ছাড়া রাজনৈতিক কারণও এ সিদ্ধান্তের পেছনে ভূমিকা রেখেছে। অনেকে আবার জানিয়েছেন, প্রতিপক্ষের হামলার মুখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে জান্তা বাহিনী। তখন থেকে বিরোধীদের ওপর ব্যাপক দমন–পীড়ন চালিয়ে যাচ্ছে সামরিক সরকার। এই বিরোধীদের মধ্যে রয়েছেন জান্তার সহিংসতা ও দমন–পীড়নের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়া গণতন্ত্রপন্থী বিভিন্ন গোষ্ঠী এবং দীর্ঘ সময় ধরে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর সশস্ত্র বিদ্রোহীরা।
বিদ্রোহীদের এই তৎপরতার মধ্যে গত ২৭ অক্টোবর থেকে নাটকীয়ভাবে জান্তা বাহিনীর ওপর চাপ বেড়েছে। সেদিন মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় শান রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালায় ‘থ্রি ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্স’ নামে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর বিদ্রোহীদের একটি জোট। এ হামলায় তারা সহায়তা পেয়েছিল সেনাবাহিনীর ক্ষমতা দখলের বিরুদ্ধে থাকা গোষ্ঠীর কাছ থেকেও।
এর পর থেকেই মিয়ানমারের বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্রোহীদের সঙ্গে সামরিক বাহিনীর লড়াই ছড়িয়ে পড়েছে। দেশটির অনেক অঞ্চল বিদ্রোহীরা দখলে নিয়েছেন। তাঁদের জান্তাবিরোধী এ অভিযানের নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন ১০২৭’। তবে বিদ্রোহীদের এ অগ্রগতির মানে সামরিক বাহিনী বড় পরিসরে পরাজয়ের দ্বারপ্রান্তে রয়েছে—আগেভাগে এমন প্রত্যাশা করা উচিত হবে না বলে সতর্ক করেছেন বিশ্লেষকদের অনেকে।
বিশ্লেষকেরা যাই বলুক না কেন, গত অক্টোবর থেকে শুধু মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলেই বিদ্রোহীদের হাতে জান্তা বাহিনীর যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে অস্ত্র ও গোলাবারুদ। প্রধান কিছু শহরও দখলে নিয়েছেন বিদ্রোহীরা। এটা সামরিক বাহিনীটির জন্য অপমানজনক। এ নিয়ে মিয়ানমারের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে দেশটির অভ্যন্তরে ক্ষোভও দেখা দিয়েছে।
মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এখনো বিদ্রোহীদের চেয়ে অভিজ্ঞ। তাদের ভালো প্রশিক্ষণ রয়েছে। আর অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়েও তারা বহু এগিয়ে।
২০২১ সালে রাজনৈতিক বিবেচনায় সেনাবাহিনী ছেড়েছিলেন সাবেক ক্যাপ্টেন হতেত মিয়াত। তিনি বলেন, ‘আমি যখন সামরিক বাহিনীতে ছিলাম, তখন কোনো ক্যাপ্টেনকে হত্যা—এমনকি আটকের খবরও খুবই বিরল ছিল। সে সময় শত্রুপক্ষের হাতে সামরিক বাহিনীর কোনো যুদ্ধবিমান ভূপাতিত হওয়া বা ট্যাংক ও ক্ষেপণাস্ত্র বেহাত হওয়ার কোনো ঘটনাই ঘটেনি।’
চলতি মাসের শুরুর দিকে চীন সীমান্তের কাছে লুয়াক্কাই নামের একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর দখলে নেন জান্তাবিরোধী যোদ্ধারা। ওয়াশিংটনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান উইলসন সেন্টারের বিশ্লেষক ইয়ে মিও হেইন ওই ঘটনাকে ‘মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সবচেয়ে বড় আত্মসমর্পণ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। বলেছিলেন, তাঁর জানামতে সামরিক বাহিনীর ছয় ব্রিগেডিয়ার জেনারেলসহ ২ হাজার ৩৮৯ সেনা আত্মসমর্পণ করেছেন।
পরে খবর প্রকাশ হয়েছে যে আত্মসমর্পণ করার দায়ে ওই ছয় জেনারেলের কয়েকজনকে মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে। তবে এমন খবর নাকচ করে দেওয়া হয়েছে জান্তা বাহিনীর পক্ষ থেকে।
মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে গড়ে তোলা জাতীয় ঐক্যের সরকারের আন্তর্জাতিক সমন্বয়বিষয়ক মন্ত্রী ডা. সাসার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের ২৭ অক্টোবর বিদ্রোহীদের অপারেশন ১০২৭ শুরুর পর থেকে মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর চার হাজারের বেশি সেনা হয় বাহিনী ছেড়েছেন, না হয় আত্মসমর্পণ করেছেন। এর আগে ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর থেকে আরও ১৪ হাজার সেনা সদস্য বাহিনী ছেড়েছিলেন।
সেনাসদস্যদের বাহিনী ত্যাগের এসব তথ্যের সত্যতা যাচাই করাটা কঠিন। বিশ্লেষক ইয়ে মিও হেইনের হিসাবে, এখন পর্যন্ত মিয়ানমার সেনাবাহিনীর কমপক্ষে ১০ হাজার সদস্য বাহিনী ছেড়ে গেছেন। এ ছাড়া অপারেশন ১০২৭ শুরুর পথ থেকে সেনাদের মধ্যে আত্মসমর্পণের প্রবণতা বেড়েছে। তিনি বলেন, পুরো এক ব্যাটালিয়ন সেনার আত্মসমর্পণ এবং সবশেষ গোটা আঞ্চলিক অপারেশন কমান্ডের আত্মসমর্পণ মিয়ানমারের সামরিক বাহিনীর ইতিহাসে নজিরবিহীন একটি ঘটনা।
তবে মিয়ানমার সামরিক বাহিনী এখনো বিদ্রোহীদের চেয়ে অভিজ্ঞ। তাদের ভালো প্রশিক্ষণ রয়েছে। আর অস্ত্রশস্ত্রের দিক দিয়েও তারা বহু এগিয়ে। সামরিক বাহিনীর হাতে চীন ও রাশিয়ার দেওয়া যুদ্ধবিমান রয়েছে। তবে সম্প্রতি বিদ্রোহীদের কাছে সামরিক বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের পরাজয় নিম্ন পদের সেনাদের মনোবল ভেঙে দেবে এবং তাঁদের মধ্যে অসন্তোষ বাড়াবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকদের অনেকে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের দক্ষিণ–পূর্ব এশীয় রাজনীতিবিষয়ক গবেষক মর্গান মাইকেলস বলেন, বিদ্রোহীদের হাতে সেনাসদস্যদের পরাজয়ের কারণে নৈতিক সমস্যা বা বিব্রতকর পরিস্থিতি সৃষ্টির মতো কোনো সমস্যা তৈরি হোক বা না হোক, জান্তা সরকারের ভেতরে একধরনের অস্থিতিশীলতা দেখা দেবে।