‘ক্ষুধার্ত সন্তানকে দুধের বোতলে চা দিয়ে ভোলাই’

আফগানিস্তানের মানুষদের এই সংকট কাটিতে তুলতে প্রয়োজন ১০০ কোটি মার্কিন ডলারছবি: ডব্লিউএফপি

‘আমার ১৫ মাস বয়সী দুধের শিশুর জন্য সর্বশেষ দুধ কিনেছিলাম তা–ও দুই মাস আগে। এরপর আর পারিনি। এখন আমি ওর দুধের বোতলে চা ভরে দিই। অথবা চায়ের মধ্যে রুটি ভিজিয়ে তাকে খাওয়াই।’ কাবুলের পূর্বাঞ্চলে একটি পাহাড়ে নিজের মাটির ঘরের মেঝেতে বসে কথাগুলো বলছিলেন সোহেলা নিয়াজি।

ছয় সন্তান নিয়ে বিধবা সোহালিয়ার সংসারেও চা হয়। তবে তাতে থাকে না দুধ, চিনি। তাই গরম পানিতে চায়ের পাতার তৈরি এই পানীয় থেকে তাঁর শিশু পায় না কোনো পুষ্টি।

সোহালিয়া হলেন সেই এক কোটি মানুষের একজন, যারা জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) জরুরি খাদ্য সহায়তা থেকে বঞ্চিত। বড় ধরনের তহবিলসংকটের কারণে গত বছর থেকে এই সহায়তা দেওয়া বন্ধ রয়েছে। এর ফলে দেশটিতে বিশেষ করে নারীরা, যাঁরা সংসার চালান, তেমন আনুমানিক দুই মিলিয়ন পরিবার বড় ধাক্কা খায়।

২০২২ সালে তালেবান ও তালেবান–বিরোধীদের মধ্যকার লড়াইয়ে প্রাণ যায় সোহালিয়ার স্বামীর। কিন্তু তালেবান শাসনের কারণে তিনি বাড়ির বাইরে গিয়ে কাজ করতে পারেন না। তাঁর সবচেয়ে বেশি সহায়ক হয়ে দাঁড়ায় এই বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির দেওয়া খাবার (আটা, তেল ও বীজ)। এরপর এই তহবিল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন আত্মীয় ও প্রতিবেশীরা যা দেয়, তার ওপর নির্ভর করে থাকতে হয় সোহালিয়াকে।

আফগানিস্তানে এক কোটি মানুষ জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির জরুরি খাদ্য সহায়তা থেকে বঞ্চিত
ছবি: ডব্লিউএফপি

সোহালিয়া বলেন, ‘এমন অনেক রাত যায়, যখন খালি পেটে ঘুমাতে হয়। আমি তখন এই রাতে আমি কোথায় হাত পাততে যাব। যদি কোনো প্রতিবেশী খাবার নিয়ে আসে, সন্তানেরা, “আমাকে দাও আমাকে দাও” বলে হইচই বাঁধিয়ে দেয়। আমি তখন সবার মধ্যে ভাগ করে দিই।’

আর ক্ষুধার্ত ছোট সন্তানের কান্না থামাতে সোহালিয়াকে ‘ঘুমের ওষুধ’ দিতে হয়। তিনি বলেন, ‘এ জন্য দিই, যাতে ঘুম না ভাঙে আর উঠেই যেন দুধের জন্য কান্না না করে। ওষুধ (অ্যান্টিহিস্টামিন বা অ্যান্টি অ্যালার্জি) খেয়ে সে এক সকাল থেকে পরের সকাল পর্যন্ত ঘুমায়।’

এখন ডব্লিউএফপি বলছে, তারা বর্তমানে মাত্র ৩০ লাখ মানুষকে সহায়তা করতে সক্ষম। তবে প্রকৃত অর্থে এই সংখ্যা ক্ষুধার্ত মানুষের চার ভাগের একভাগেরও কম।
ইউনিসেফের ভাষ্য, ৩০ লাখের বেশি শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে। তাদের মধ্যে এক চতুর্থাংশের বেশি মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। জাতিসংঘ বলছে, এতটা খারাপ অবস্থা আফগানিস্তানের আগে কখনো ছিল না।

২০২১ সালে দেশটির ক্ষমতা পরিবর্তন হওয়ার পর সৃষ্ট অস্থিরতার মধ্যে জরুরি ভিত্তিতে ৩০টি হাসপাতালের স্বাস্থ্যকর্মীদের বেতন এবং ওষুধ ও খাবারের জন্য অর্থায়ন করে কাজ চালিয়ে গেছে দ্য ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব দ্য রেড ক্রস। কিন্তু এখন আর এটি চালিয়ে যাওয়ার মতো তাদের সক্ষমতা নেই। এমনকি আফগানিস্তানের একমাত্র শিশু হাসপাতাল কাবুলে ইন্দিরা গান্ধী চিলড্রেনস হসপিটালসহ বেশির ভাগ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সহায়তা প্রদান প্রত্যাহার করা হয়েছে।

এক মা সর্বশেষ এই খাদ্য সহায়তা পেয়েছিলেন
ছবি: এএফপি

এ অবস্থায় আরও বেশি তহবিল পেতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রাজি করাতে তাঁরা কী করছেন জানতে চাইলে তালেবানের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ বিবিসিকে বলেন, ‘দাতা দেশগুলোর অর্থনীতি ভালো না হওয়ায় সাহায্য বন্ধ করা হয়েছে। বিশ্বে দুটি বড় বিপর্যয় ঘটেছে—কোভিড এবং ইউক্রেনে যুদ্ধ। তাই আমরা তাদের কাছ থেকে সাহায্য আশা করতে পারি না।  কথা বলেও আমরা তাদের কাছ থেকে সাহায্য পাব না। আমাদের স্বনির্ভর হতে হবে।’

তালেবান নীতিসমূহ তহবিল বন্ধের কোনো কারণ কি না, জানতে চাইলে মুজাহিদ বলেন, ‘যদি সাহায্যকে চাপ প্রয়োগের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তাহলে ইসলামি আমিরাতের নিজস্ব যে মূল্যবোধ আছে, তা যেকোনো মূল্যে রক্ষা করা হবে।’