কারাগারে ৮০তম জন্মদিন কাটছে সু চির, মায়ের জন্য ৮০ কিলোমিটার দৌড়ালেন ছেলে

সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলছেন অং সান সু চি। ৫ জুলাই ২০১১, মিয়ানমারের মন্দিরের শহর বাগানফাইল ছবি: এএফপি

মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী অং সান সু চির ৮০তম জন্মদিন আজ বৃহস্পতিবার। সামরিক জান্তার কারাগারে বন্দী অবস্থায় তিনি জন্মদিন পার করছেন। তাঁর বিরুদ্ধে এতসব অভিযোগ আনা হয়েছে, বাকি জীবন তাঁকে হয় তো কারাগারে কাটাতে হতে পারে।

মিয়ানমারের দশকব্যাপী গণতন্ত্রের উত্থানের প্রধান মুখ ছিলেন সু চি। যখন দেশটি ধীরে ধীরে সেনাশাসন থেকে বেরিয়ে আসছিল, তখন তিনি আসলে দেশের কার্যত নেতা হয়ে উঠেছিলেন।

কিন্তু ২০২১ সালে সেনাবাহিনী সু চির সরকারকে উৎখাত করে আবার ক্ষমতা দখল করে এবং তাঁকে কারাবন্দী করে। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি থেকে শুরু করে কোভিড–১৯ বিধি ভাঙার মতো নানা অভিযোগ আনা হয়েছে। এখন তিনি ২৭ বছরের কারাদণ্ড ভোগ করছেন।

যুক্তরাজ্যে বসবাসরত সু চির ছেলে ৪৭ বছর বয়সী ছেলে কিম অ্যারিস বলেন, ‘এই মুহূর্তে জন্মদিন উদ্‌যাপন করা কঠিন।’ তিনি বলেন, ‘যেহেতু এত বছর ধরে চলছে, আমরা সহ্য করতে শিখে গেছি।’

সু চির জন্মদিনকে স্মরণীয় করে তুলতে ছেলে কিম ৮ দিনে ৮০ কিলোমিটার দৌড়েছেন এবং তাঁর মায়ের জন্য শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে ৮০ হাজারের বেশি শুভেচ্ছাবার্তার ভিডিও সংগ্রহ করেছেন।

কিন্তু সু চি এসব কিছুই দেখতে পারবেন না। কারণ, তিনি মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে বন্দী অবস্থায় আছেন। এখান থেকে জান্তা সরকার দেশজুড়ে গেরিলা যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে।

কিম অ্যারিস জানান, গত দুই বছরে তাঁর মায়ের কাছ থেকে শুধু একটি চিঠি পেয়েছেন। তিনি বলেন, ‘আমরা জানি না, তিনি এখন কেমন আছেন।’

বিদেশে জনপ্রিয়তা কমেছে, দেশে এখনো জনপ্রিয়

সু চি মিয়ানমারে এখনো বেশ জনপ্রিয়, বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ জনগোষ্ঠীর মধ্যে।

তবে আন্তর্জাতিক মহলে সু চির গণতন্ত্রের প্রতীক হিসেবে অবস্থান বেশ নড়বড়ে হয়ে গেছে। কারণ, তিনি রোহিঙ্গা মুসলিমদের ওপর সেনাবাহিনীর নির্যাতনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন।

অং সান সু চির সরকার থাকা অবস্থায় মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছেন। অবশ্য তাঁর পক্ষের মানুষের যুক্তি, সেনাবাহিনীর ওপর সু চির কোনো নিয়ন্ত্রণই ছিল না।

এক সময় যেসব আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তিত্ব সু চিকে পুরস্কার ও সম্মাননা দিয়েছিলেন, তাঁদের অনেকেই এখন দূরত্ব বজায় রাখছেন। তাঁর দ্বিতীয়বারের কারাবাস আগের মতো আন্তর্জাতিক দৃষ্টিও আকর্ষণ করতে পারছে না।

জন্মদিনে বন্দিত্ব

সু চি ছিলেন মিয়ানমারের স্বাধীনতা সংগ্রামী অং সান-এর মেয়ে। তিনি মূলত ‘ঘটনাচক্রে গণতন্ত্রের নেত্রী’ হয়ে ওঠেন।

দীর্ঘ সময় বিদেশে কাটিয়ে সু চি ১৯৮৮ সালে অসুস্থ মাকে দেখতে মিয়ানমারে ফেরেন। তখন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তিনি জনতার আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। কিন্তু সেনাবাহিনী তা দমন করে।

তখন সু চিকে ১৫ বছর গৃহবন্দী করে রাখা হয়। সেই বন্দিত্বকালে বেশির ভাগ সময় তিনি কাটান ইয়াঙ্গুনে পারিবারিক বাড়িতে। সেখানে দেয়ালের ওপার থেকে জনগণ তাঁর বক্তৃতা শুনত।

প্রবাসে চলে যাওয়ার শর্তে সেনাবাহিনী সু চিকে মুক্তি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তিনি সাহসিকতার সঙ্গে তা প্রত্যাখ্যান করেন। এতে তিনি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পান এবং ১৯৯১ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পান।

কিন্তু এবার সামরিক অভ্যুত্থানের ঠিক আগ মুহূর্তে সু চি জনদৃষ্টি থেকে পুরোপুরি উধাও হয়ে গেছেন।

চিকিৎসা সমস্যা ও সরকারের নীরবতা

কিম অ্যারিস বলেন, তাঁর আশঙ্কা, তাঁর মায়ের হৃৎপিণ্ড, হাড় ও দাঁতের সমস্যাগুলোর চিকিৎসা হচ্ছে না।

মিয়ানমারের সামরিক সরকার মাঝেমধ্যে সু চির অবস্থা নিয়ে সামান্য তথ্য দেয়।
গত মার্চে সরকারের মুখপাত্র জাও মিন তুন বলেন, সু চি সুস্থ আছেন এবং নিয়মিত তাঁর স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো হচ্ছে। তাঁর গুরুতর কোনো কিছু নেই।

সু চি ২০১০ সালে প্রথমবার বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পান। এরপর তাঁর দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ২০১৫ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়। তবে সেনাবাহিনীর তৈরি নিয়মের কারণে তিনি প্রেসিডেন্ট হতে পারেননি।

মিয়ানমারের সামরিক জান্তা চলতি বছরের শেষ দিকে নির্বাচন আয়োজনের ঘোষণা দিয়েছে। তবে অনেক দলই নির্বাচন বর্জন করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। বিশেষ করে যাঁরা একসময় সু চির অহিংস রাজনীতির সমর্থক ছিলেন, কিন্তু এখন তাঁরা জান্তার বিরুদ্ধে বন্দুক হাতে তুলে নিয়েছেন।

সু চির ছেলে কিম অ্যারিস বলেন, যদি সু চি মুক্তি পান, তবে তিনি সম্ভবত আর সরাসরি রাজনৈতিক নেতৃত্বে থাকবেন না।