শ্রীলঙ্কায় একনায়কতন্ত্র বনাম জেভিপির উত্থান

প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে ২০২৫ সাল নাগাদ শ্রীলঙ্কাকে ধনী দেশের তালিকায় তুলে আনার অঙ্গীকার করেছিলেন। অথচ বাস্তবতা হলো এটি এখন নিম্ন আয়ের এক দেশ।

অর্থনৈতিক সংকটের জেরে শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালের মার্চে শুরু হয় বিক্ষোভ। কয়েক মাস ধরে চলা বিক্ষোভে পতন হয় রাজাপক্ষে সরকারের।বিক্ষোভকারীদের এ ছবি গত বছরের ৯ জুলাই প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের সামনের
ছবি: রয়টার্স

শ্রীলঙ্কায় রাজাপক্ষে সরকারবিরোধী গণ–আন্দোলন গত বছর মার্চে শুরু হয়েছিল, এপ্রিল থেকে যা চরম আকার ধারণ করে। সেই আন্দোলনের এক বছর পূর্তি হচ্ছে এ মাসে। অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে দেশটি এখন স্থিতিশীলতার পথে হাঁটছে, এমনই ধারণা আন্তর্জাতিক মহলে।

প্রচারমাধ্যম এ রকম খবর দিচ্ছে। এর মধ্যে গত সপ্তাহে জানা গেল, দেশটি এক লাখ বানর রপ্তানির কথা ভাবছে। বৈদেশিক মুদ্রা জোগাড় করতে শ্রীলঙ্কার নীতিনির্ধারকেরা যে কতটা মরিয়া, তার স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে এ সংবাদে।

দেশে-বিদেশে খুব যত্নের সঙ্গে প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহেকে সফল দেখানো হচ্ছে। সামরিক একনায়কের মতো দেশ চালাচ্ছেন তিনি। শক্তিধর দেশগুলো পাশে থাকলে ছোট দেশগুলোর একনায়কদের জন্য অনেক কিছু যে সহজ হয়ে যায়, রনিল একালে তার ভালো এক নজির।

সর্বশেষ স্থানীয় সরকার নির্বাচন আটকে দিয়েছেন তিনি। এ সিদ্ধান্তের ভেতর রয়েছে শ্রীলঙ্কার বর্তমান ও ভবিষ্যৎ রাজনীতির স্পষ্ট কিছু নিশানা।

স্থানীয় নির্বাচন স্থগিত; প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে চান প্রেসিডেন্ট

২০২৩ ও ২০২৪ সালে মিয়ানমার থেকে শ্রীলঙ্কা পর্যন্ত দক্ষিণ এশিয়াজুড়ে নির্বাচনের বছর। যদিও অনেক দেশেই নির্বাচন হওয়া না–হওয়া নিয়ে বিস্তর টানাপোড়েন আছে।

শ্রীলঙ্কায় এ বছরের শুরুতে প্রথমে স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং নভেম্বরের পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু নির্বাচন কমিশন বলছে, হাতে রুপি নেই, তাই স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে পারছে না তারা। এই সংবাদের পেছনের কারণ হলো রনিল বিক্রমাসিংহের প্রশাসনে এ নির্বাচন দিতে চাইছে না। কারণ, এ নির্বাচনে তাঁর দলের বিজয়ের কোনো সম্ভাবনা নেই।

নির্বাচনের খরচ দেওয়ার কথা অর্থ মন্ত্রণালয়ের। এই বিভাগ দেখেন খোদ প্রেসিডেন্ট। সুতরাং বার্তাটি পরিষ্কার। স্থানীয় সরকার নির্বাচন ২০২২ সালের মার্চে হওয়ার কথা ছিল। তখন নির্বাচন না করে করে পরিষদগুলোর মেয়াদ এক বছর বাড়ানো হয়। আর এখন সেই এক বছর শেষে নির্বাচন স্থগিত করে দেওয়া হলো। এই স্থগিতের বিষয়ে পালিয়ে যাওয়া রাজাপক্ষের দলেরও সমর্থন আছে। নির্বাচন না হওয়ায় পুরো স্থানীয় সরকারব্যবস্থা অনির্বাচিত আমলাতন্ত্রের অধীনে চলে গেল বহুদিনের জন্য। বলা যায়, আমলাতন্ত্র ও এক ব্যক্তির শাসন বেশ পূর্ণতা পেল শ্রীলঙ্কায়।

স্থানীয় নির্বাচনের জন্য শ্রীলঙ্কায় শুরুতে ৫০ কোটি রুপি দরকার হয়। এ অর্থের জোগান দিতে না পারার পরও দেশ-বিদেশের প্রচারমাধ্যম বলছে, প্রেসিডেন্ট অর্থনৈতিক সংকট বেশ সামলে নিয়েছেন। এ রকম বিস্ময়কর প্রশংসার মধ্যে খবর বেরিয়েছে রনিল বিক্রমাসিংহে স্থানীয় নির্বাচন না দিলেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে চান। এর কারণ বোঝা কঠিন নয়।

ক্ষমতার শীর্ষে থাকলেও রনিল বিক্রমাসিংহে অনির্বাচিত। ২০২২ সালে বিরল এক রাজনৈতিক গণ–অভ্যুত্থান ঠেকাতে দেশটির তখনকার শাসকদল ‘পডুজানা পেরামুনা’ তাঁকে প্রেসিডেন্ট বানায়। পার্লামেন্টে তাঁর দলের একমাত্র সদস্য তিনি। অথচ দিব্যি এখন সংখ্যাগরিষ্ঠতা উপভোগ করছেন। এর কারণ, রাজাপক্ষেরা আপাতত দেশের চালকের আসনে আসতে চাইছে না—জনগণও তাদের চাইছে না। স্থানীয় নির্বাচন হলে তারা আগের চেয়ে অনেক খারাপ করবে। কিন্তু চলমান পার্লামেন্টে তারাই বড় দল। সেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে রনিলকে সামনে রেখে অপেক্ষা করার কৌশল নিয়েছে তারা।

রনিলও সময়ক্ষেপণ করে রাজাপক্ষেদের সমর্থন নিয়ে প্রেসিডেন্ট হয়ে আসার কথা ভাবছেন বলে কলম্বোজুড়ে গুঞ্জন। অর্থাৎ একদিকে স্থানীয় সরকার নির্বাচন বন্ধ করে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নিলেন তিনি। অন্যদিকে বিদেশি বন্ধুদের সহায়তায় এমন একটা পরিস্থিতির দিকে তিনি দেশকে নিতে চান, যখন জনগণ তাঁকেই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে। রনিল এমনও বলছেন, ২০৪৮ সাল নাগাদ দেশটিকে ধনী দেশগুলোর মতো করতে চান তিনি—সে জন্য ২৫ বছর মেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি হচ্ছে। বোঝা যাচ্ছে, দীর্ঘস্থায়ী একনায়ক হওয়ার বাসনায় পেয়েছে তাঁকে। ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী থাকাকালেও একবার ২০২৫ সাল নাগাদ শ্রীলঙ্কাকে ধনী দেশের তালিকায় তুলে আনার অঙ্গীকার ছিল তাঁর। অথচ বাস্তবতা হলো এটি এখন নিম্ন আয়ের এক দেশ।

১০টি বছর ‘লাপাত্তা’ হয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কা থেকে

রাজনীতিকে নতুন করে সাজানোর ব্যাপারে রনিল বিক্রমাসিংহের পদক্ষেপে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতের বেশ সায় রয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) এটা চাইছে। অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব সামলাতে খরচ কমানোর নামে শ্রীলঙ্কায় যেসব প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, তাতে জনগণ ক্ষুব্ধ। কিন্তু তারা যাতে আবার রাস্তায় না নামে, সে জন্য আন্তর্জাতিক শক্তিগুলো কঠোর একজন শাসক দেখতে চায় এখানে।

এখনো দেশটিতে ব্যাপক মূল্যস্ফীতি আছে। আইএমএফের ঋণ পেতে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর বেসরকারীকরণ চলছে। ২০২২ সালে এর অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে একই রকম নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি ৩ শতাংশে নেমে আসতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন অর্থনীতিবিদেরা। ২০২৪ সাল নাগাদ দেশটি আবার ইতিবাচক প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরতে পারে। এর মধ্যে করুণ ব্যাপার হলো ২০১৮ সালে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির আকার যে ৮৪ বিলিয়ন ডলার আয়তনের ছিল, ২০২৮ সালেও সেখানেই থাকবে।

দেশটির কুলীনদের রাজনৈতিক অপশাসন মাঝের ১০টি বছর হাওয়া করে দিয়েছে। এই লাপাত্তা হওয়া সময়টিতে নির্বিঘ্নে ক্ষমতায় থাকতে রনিল প্রশাসন সন্ত্রাসবিরোধী নতুন এক আইনের খসড়া প্রস্তুত করেছে। সম্ভাব্য এই আইনে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই মানুষকে গ্রেপ্তারের ক্ষমতা দেওয়া হবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোকে। একই আইনে এক বছর পর্যন্ত কারণ দর্শানো ছাড়াই যে কাউকে আটক রাখা যাবে।

অর্থনৈতিক সংকটে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের পাশাপাশি শ্রীলঙ্কাও আইএমএফের কাছে গিয়েছিল কিছুদিন আগে। শ্রীলঙ্কার জন্য আইএমএফের কর্জের অঙ্ক মাত্র ৩ বিলিয়ন ডলার। পরিমাণ সামান্য হলেও আইএমএফের দাক্ষিণ্য পেলে চীন, ভারত, এডিবিসহ অন্যান্য ঋণদাতা তাদের বকেয়া পুনঃ তফসিল করবে বলে আশা করা হচ্ছে।

এতে দেশটিকে ঘিরে আন্তর্জাতিক আর্থিক আস্থা ফিরতে পারে। এ রকম অবস্থায় আইএমএফ থেকে ৩ বিলিয়ন ডলার পাওয়াকে রনিল বিক্রমাসিংহের বিশাল রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সফলতা হিসেবে দেখানো হচ্ছে সর্বত্র। এ সফলতার আড়ালে দেশটির প্রশাসনকে জনমুখী সব বিনিয়োগ থেকে থামানোর কাজ চলছে গত কয়েক মাস। আইএমএফের নির্দেশাবলির যেকোনো বিরোধিতাকে রাষ্ট্রবিরোধী এবং দেশবিরোধী কাজ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে। অথচ যে রাজনৈতিক শক্তি এবং অর্থনৈতিক তৎপরতার কারণে শ্রীলঙ্কায় আজকের দুর্দশা, সে রকম সব এখনো হাজির আছে।

২০২২ সালের গণ–আন্দোলন এসবের বিপক্ষেই ছিল। দেশটির মধ্যবিত্তরা একটি পরিবারের লুটপাটের বিরোধিতা এবং সুশাসনের দাবিতে অনন্য এক ‘আরাগালায়া’য় (সংগ্রামে) নেমেছিল তখন। সে সময় রাজাপক্ষেরা তিন ভাই প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী ছিল। এখন তারা দৃশ্যপটে নেই বটে—কিন্তু তাদের যৌথ ছায়া হিসেবে রনিল আছেন।

আরাগালায়া পুরোনো রাজনৈতিক ছক পাল্টে দিয়েছে

‘আরাগালায়া’য় প্রধান ভূমিকায় ছিল দেশটির বামপন্থী তরুণ-তরুণীরা। বিশেষভাবে তুলনামূলকভাবে ছোট দুটি দল ফ্রন্টলাইন সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং জনতা বিমুক্তি পেরামুনা (জেভিপি) প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ দখলে সাহসের বড় উৎস ছিল।

এই দলগুলো গণ–আন্দোলনকে ব্যাপকভাবে জ্বালানি জোগাতে পারলেও সেটাকে সফল গণ–অভ্যুত্থানে পরিণত করার সাংগঠনিক কাজে দক্ষতা দেখাতে পারেনি। আন্দোলনের উত্তাপ কমামাত্র রনিলের প্রশাসন তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে রাজাপক্ষেদের হয়ে প্রতিশোধ নিয়েছে।

তবে গত এক বছরে শ্রীলঙ্কায় সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা প্রধান বিরোধী দল সঙ্গী জন বালাওয়েগা বা এসজেবি। এর নেতা সাজিথ প্রেমাদাসা ‘আরাগালায়া’র সময় রাজাপক্ষে ও রনিল জুটির কলাকৌশল মোকাবিলা করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হন। এখন রনিল এসজেবিকে ভেঙে বিরোধী কিছু এমপিকে নিজের দিকে টানার চেষ্টা করছেন। এই কৌশল নিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে তাঁর রাজনৈতিক ভিত শক্ত করবেন বলে মনে হচ্ছে।

রাজপক্ষে বংশ এবং রনিলের মতো সাজিথ প্রেমাদাসাও দেশটির অভিজাত শ্রেণির অংশ। সাজিথ হলেন দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে। ২০২২ সালের গণ–আন্দোলনের একটা ইতিবাচক অবশেষ হলো জনগণ এ রকম অভিজাতদের ঐতিহাসিক আধিপত্য থেকে বের হওয়ার পথ খুঁজছে। দমন–পীড়নের তীব্রতায় মানুষ রাস্তায় সক্রিয় হতে না পারলেও সমাজে রাজনৈতিক পছন্দ-অপছন্দের পাটাতন বদলে যাচ্ছে বলে জনমত জরিপে ইঙ্গিত মিলছে।

জেভিপির উত্থান

শ্রীলঙ্কায় সম্প্রতি যে স্থানীয় নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে, তার বড় কারণ এখন ওই নির্বাচন হলে ‘জনতা বিমুক্তি পেরামুনা’ বা জেভিপি নামের দলটি জিতে আসবে বলে জরিপগুলো জানাচ্ছে। এ বিষয়ে আগ্রহীরা ‘শ্রীলঙ্কা অপিনিয়ন ট্রেকার সার্ভে ২০২৩’ (আইএইচপি) দেখতে পারেন।

জেভিপি শ্রীলঙ্কার শাসকদল কিংবা প্রধান বিরোধী দল নয়। অতীতেও এই দল কখনো ক্ষমতায় ছিল না। তবে শ্রীলঙ্কার ইতিহাসের ব্যাপকভাবে আলোচিত রাজনৈতিক দল এটা। বাংলাদেশে স্বাধীনতার পরপর জাসদ কর্মীদের মধ্যে জেভিপি নিয়ে বিপুল উৎসাহ ছিল। অন্তত দুবার এই দল শ্রীলঙ্কায় সশস্ত্র গণ–অভ্যুত্থান ঘটনানোর চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।

সেই থেকে দেশের অভিজাত শ্রেণি, আমলাতন্ত্র, সশস্ত্র বাহিনী এদের কুনজরে দেখে। আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোও জেভিপিকে ভয় পায়। বামপন্থী-জাতীয়তাবাদী জেভিপিকে দমনের নামে অতীতে জনজীবনে প্রচুর সন্ত্রাস চালানো হয়। ফলে গত তিন দশক সিংহলি সাধারণ মানুষ জেভিপি থেকে দূরে থাকত। অন্যদিকে তামিলরা সিংহলি-প্রধান এই দলকে জাতিগত বিবেচনায় সমর্থন করত না।

কিন্তু ২০২২ সাল থেকে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সংকটে সিংহলি তরুণেরা আবার জেভিপির দিকে ঝুঁকছেন। দলটির জনসভায় প্রচুর লোক হচ্ছে। এনপিপি (ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার) নামে তারা একটা জোটও করেছে। রাজাপক্ষেদের হটাতে পারলেও গণ-অভ্যুত্থানকে কাজে লাগিয়ে প্রত্যাশামতো রাজনৈতিক পরিবর্তন আনতে না পারায় মানুষ প্রধান বিরোধী দল সঙ্গী জন বালাওয়েগাকে নিয়ে আপাতত আর স্বপ্ন দেখছে না শ্রীলঙ্কায়। বরং জেভিপির নেতা ‘একেডি’ নামে পরিচিত অনূঢ়া কুমার দেশনায়েকে রাজনীতির প্রধান এক চরিত্র হিসেবে মনোযোগ কাড়ছেন ইদানীং।

তবে জেভিপির এই নবতরঙ্গ শ্রীলঙ্কার শাসকশ্রেণিকে আদর্শগত মতভেদ ভুলে এক কাতারে দাঁড়াতে বাধ্য করছে। একই কারণে জেভিপিকে ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ভারতও রনিল ছাড়া কারও ওপর ভরসা করতে পারছে না। ১৯৭১ ও ১৯৮৭ সালের বিদ্রোহের সময়ও জেভিপি দমনে ভারত, পাকিস্তান, যুক্তরাষ্ট্র তখনকার সরকারকে বেশ সহায়তা দিয়েছিল।

জেভিপি আপাতত সশস্ত্র সংগ্রাম ছেড়ে নির্বাচনপন্থার রাজনীতিতে চলে এলেও শ্রীলঙ্কার আমলাতন্ত্র ও অভিজাত শ্রেণি তাদের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতায় যেতে দেবে বলে মনে হয় না।

সে ক্ষেত্রে রনিলকে সামনে রেখে বিভিন্ন ধারায় বিভক্ত পুরো অভিজাত শ্রেণি একত্র হয়ে যেতে পারে। আর নিজস্ব সুরক্ষার জন্য সম্ভাব্য ‘সন্ত্রাসবিরোধী আইন’কে ব্যাপকভাবে ব্যবহার করতে পারে তারা। আমলাতন্ত্রও এ রকম আইন চায়।

আবার এ রকম সব শক্তি আগামী বছর প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রনিলকে জয়ী করে আনায় সমস্যা দেখলে জেভিপিকে ঠেকানোর কৌশল হিসেবে প্রধান বিরোধী দল ‘সঙ্গী জন বালাওয়েগা’সহ জাতীয় সরকারের গড়ার প্রস্তাবও দিতে পারে। এ সরকারে তামিলদেরও নেওয়া হতে পারে, যা যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও ইউরোপীয় ইউনিয়নকে খুশি করবে। রনিল সিংহলি এলাকায় স্থানীয় নির্বাচন বন্ধ রাখলেও তামিল হিন্দু ও তামিল মুসলমানদের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ‘প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে’ ছাড় দেওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন সম্প্রতি। তামিল এলাকায় প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন ভারতকে বিশেষভাবে সন্তুষ্ট করবে। তারা তামিলদের এ রকম রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন চায়।

রনিল বিক্রমাসিংহে অতীতে শ্রীলঙ্কায় পাঁচবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সুতরাং দেশটির আজকের বিপন্ন দশায় তাঁর দায় কম নেই। কিন্তু শ্রীলঙ্কার অভ্যন্তরীণ অভিজাতদের মতো ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রও দেশটিকে নিজেদের বলয়ে রাখতে রনিলের ওপরই বাজি ধরেছে। আর রনিলও জানেন এ রকম শক্তি কে কী চায়। জনস্বার্থের তোয়াক্কা না করলে সেসব চাওয়া পূরণ করে যে চমৎকারভাবে ক্ষমতায় থাকা যায়—এই শিল্পকলা ৭৪ বয়সী এই রাজনীতিবিদের ভালো রপ্ত আছে। গত ৩০ বছর এই শিল্পকলার জোরেই তিনি নানাভাবে ক্ষমতার চৌহদ্দিতে আছেন। রনিলকে নিয়ে চলতি সময়ে আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে শোভন লেখালেখির আধা গোপন রহস্য তাঁর ওই রাজনৈতিক কলাবিদ্যা।

  • আলতাফ পারভেজ ‘শ্রীলঙ্কার তামিল ইলম: দক্ষিণ এশিয়ায় জাতিরাষ্ট্রের সংকট’ গ্রন্থের লেখক