হিন্দুত্ববাদীরা যেভাবে বদলে দিচ্ছে ভারতের পরিচয়

আরএসএস ভারতের গোঁড়া হিন্দু সংগঠন, যে সংগঠনের হাত ধরে বেড়ে উঠেছেন নরেন্দ্র মোদি, তা এখন বদলে দিচ্ছে ভারতের পরিচয়। লক্ষ্য, অসাম্প্রদায়িক ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে পরিণত করা। আরএসএস সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর গভীরে ঢুকে এগুলোকে এতটাই নিজেদের প্রভাববলয়ের মধ্যে এনেছে যে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও সংগঠনটির প্রভাব সেখানে থেকে যাবে।

হিন্দু জাতীয়তাবাদী কট্টর সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এর সারা ভারতে ৮৩ হাজার শাখা রয়েছে। সংগঠনটি এখন ভারতে ক্ষমতার নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেফাইল ছবি: রয়টার্স

ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি চলতি বছরে তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণটি দিয়েছিলেন গত আগস্টে, দেশের স্বাধীনতা দিবসে। ওই ভাষণটি দিতে এমন একটি সংগঠনের মঞ্চকে ব্যবহার করে সংগঠনটিকে সম্মানিত করেছিলেন তিনি, যা শুধু তাঁর জীবনই নয়, গোটা ভারতকে নতুন পরিচয়ে গড়ে তুলছে।

মোদির ১১ বছরের শাসনকালে কট্টর ডানপন্থী হিন্দু জাতীয়তাবাদী সংগঠন রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ বা আরএসএসের প্রতি এটিই ছিল তাঁর সবচেয়ে জোরালো ও প্রকাশ্য স্বীকৃতি। মোদি যখন একজন কিশোর, তখন থেকেই তাঁর ব্যক্তিগত ও পেশাজীবন গড়ে তুলেছে এই সংগঠন। চলতি বছর আরএসএস যখন তাদের শতবর্ষ উদ্‌যাপন করেছে, তখন মোদির এই স্বীকৃতি এটা দেখিয়ে দেয় যে সংগঠনটি কীভাবে আজ ভারতে ক্ষমতার নেপথ্যের এক নিয়ন্ত্রক শক্তিতে পরিণত হয়েছে।

ভারতে মুসলমানদের দীর্ঘ শাসন এবং ঔপনিবেশিক শাসনের পর হিন্দু গৌরব নতুন করে জাগিয়ে তোলার লক্ষ্যে একটি ছায়া সংগঠন হিসেবে আরএসএসের জন্ম। গত শতকের ত্রিশ ও চল্লিশের দশকে সংগঠনটির প্রথম দিকের নেতারা ইউরোপের ফ্যাসিবাদী দলগুলোর জাতীয়তাবাদী মডেল থেকে খোলাখুলিভাবেই অনুপ্রেরণা নিয়েছিলেন। মহাত্মা গান্ধী হত্যায় অভিযুক্ত হওয়াসহ একাধিকবার নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ার পরও আএসএস টিকে থাকে। আর ধীরে ধীরে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ডানপন্থী শক্তিতে রূপ নেয়।

গত ১৫ আগস্ট দিল্লির লালকেল্লায় আরএসএসের সমাবেশে নরেন্দ্র মোদি
ছবি: দ্য হিন্দুর সৌজন্যে

নরেন্দ্র মোদিকে আরএসএসের সবচেয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও যোগ্যতাসম্পন্ন সদস্যদের একজন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এক দশকের বেশি সময় ধরে তিনি জাতীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করায় আরএসএস এমন সব সাফল্য ও প্রসার পেয়েছে, যা সংগঠনটির অনেক নেতার ভাষায় আগে কখনো কল্পনাও করা যেত না। শক্ত হাতে শাসন করা এই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আরএসএসের মাঝেমধ্যে টানাপোড়েন দেখা দিলেও সংগঠনটি এখন তাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্নের একেবারে কাছাকাছি। স্বপ্নটি হলো ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র থেকে সরিয়ে নিয়ে একটি শক্তিশালী হিন্দু-ফার্স্ট বা হিন্দুদের অগ্রাধিকার দেওয়া একটি রাষ্ট্রে রূপান্তর করা।

আরএসএস ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর গভীরে ঢুকে প্রতিষ্ঠানগুলোকে এতটাই নিজেদের প্রভাববলয়ের মধ্যে এনেছে যে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলেও সংগঠনটির প্রভাব সেখানে দীর্ঘ সময় ধরে থেকে যাবে। বিপুলসংখ্যক সহযোগী গোষ্ঠীর মাধ্যমে আরএসএস ভারতের সমাজ, সরকার, আদালত, পুলিশ, গণমাধ্যম ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভেতরে প্রবেশ করেছে। এসব স্থানে নিজেদের প্রধান প্রধান সদস্যদের বসিয়েছে। তারা রাজনৈতিক ক্যারিয়ার গড়ে তোলে, আবার ভেঙেও দেয়। হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাধ্যমে তরুণদের নিজ নিজ সমাজে গুরুত্ব ও প্রভাব অর্জনের একটি পথ দেখিয়েছে আরএসএস। এভাবে দেশজুড়ে আনুগত্য আদায় করেছে তারা।

যদিও আরএসএস এখনো নিজেদের একটি গোপন সংগঠন হিসেবে তুলে ধরার পুরোনো ধারাটা বজায় রেখেছে, তারপরও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় তারা আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রকাশ্য। সংগঠনটির সদস্য এবং প্রভাব আজ দৃশ্যমান সর্বত্র।

আরএসএসের রাজনৈতিক আধিপত্য ১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারতকে ধর্মীয়ভাবে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি বিভক্ত করেছে। সংগঠনটির যে দর্শন রয়েছে, তাতে ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলমান ও খ্রিষ্টানকে বিদেশি আক্রমণকারীদের বংশধর হিসেবে দেখা হয়। আরএসএস মনে করে, এই মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের তাদের নিজ নিজ স্থানে ফিরে যেতে হবে।

আপনারা যখন গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে মোদির ভারতীয় জনতা পার্টির আধিপত্য দেখবেন, আপনারা আসলে আরএসএসের রাজনৈতিক ব্যবস্থা কাজ করতেই দেখছেন। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে সংগঠনটি দলের প্রার্থীদের ভাগ্য ও ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করছে। আবার আপনি যখন দেখবেন হিন্দু উগ্রবাদীরা মুসলিম পাড়ার দিকে মিছিল নিয়ে যাচ্ছে বা গির্জায় হামলা করছে, তখন আসলে আপনারা আরএসএসের সহযোগী সংগঠনগুলোর আধিপত্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগই দেখছেন।

আরএসএসের এই রাজনৈতিক আধিপত্য ১৪০ কোটি মানুষের দেশ ভারতকে ধর্মীয়ভাবে আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি বিভক্ত করেছে। সংগঠনটির যে দর্শন রয়েছে, তাতে ভারতের প্রায় ২০ কোটি মুসলমান ও খ্রিষ্টানকে বিদেশি আক্রমণকারীদের বংশধর হিসেবে দেখা হয়। আরএসএস মনে করে এই মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের তাদের নিজ নিজ স্থানে ফিরে যেতে হবে।

আরও পড়ুন
নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজরাটে প্রশিক্ষণে আরএসএস সদস্যরা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

গত শতকের আশির দশকে আরএসএসের রাজনৈতিক শাখায় দায়িত্ব দেওয়া হয় মোদিকে। এর আগে তিনি সংগঠনটির একজন সংগঠক হিসেবে পরিচিতি পান। আরএসএসকে একটি বিশাল নদীর সঙ্গে তুলনা করেছেন মোদি। এই নদী থেকে অসংখ্য শাখাপ্রশাখা বেরিয়ে ভারতের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারতীয় সমাজ যখন পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এমন একটি কঠিন সময়ে ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ রক্ষার জন্য আরএসএসের প্রশংসা করেছেন মোদি।

লালকেল্লায় বৃষ্টিভেজা স্বাধীনতা দিবসের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী মোদি বলেছিলেন, ‘সেবা, নিষ্ঠা, সংগঠিত থাকা ও অতুলনীয় শৃঙ্খলা—এগুলোই এর (আরএসএস) বৈশিষ্ট্য।’

ওপরে ওপরে আরএসএস একটি বড় সমাজসেবামূলক সংগঠন। এর সাংগঠনিক কাঠামো গড়ে উঠেছে পাড়া–মহল্লাভিত্তিক ছোট ছোট বিভিন্ন দলের মাধ্যমে। ছোট এই দলগুলোয় শারীরিক অনুশীলন ও আধ্যাত্মিক চর্চার মধ্য দিয়ে আজীবনের জন্য ‘বয় স্কাউটের’ মতো সদস্য তৈরি করা হয়। এই দলগুলোই আরএসএসের সদস্য সংগ্রহের প্রধান জায়গা এবং সামাজিক কাঠামো নতুন করে গড়ে তোলার শক্তি। এই স্তর থেকেই আরএসএস পরিকল্পিতভাবে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিজেদের প্রভাব ছড়িয়ে দেয়।

বিজেপি নিজেদের বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বলে দাবি করে। এই দলের সদস্য সংখ্যা ১০ কোটির বেশি। আর আরএসএসের রয়েছে বহু শাখা। এর মধ্যে আছে বড় ছাত্রসংগঠন, শ্রমিক ইউনিয়ন, কৃষক সংগঠন, পেশাজীবীদের নেটওয়ার্ক, ধর্মীয় সংগঠন ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান। নিয়মিত সমন্বিত বৈঠকের মাধ্যমে এসব সহযোগী সংগঠন আরএসএসের হিন্দু এজেন্ডাকে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ দিতে কাজ করে। এর লক্ষ্য হলো ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠা করা।

দুর্গা নন্দ ঝা একজন শিক্ষাবিদ। তিনি দীর্ঘদিন ধরে আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত আছেন। সংগঠনটি-সংশ্লিষ্ট একটি চিন্তক প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বও দিচ্ছেন। দুর্গা নন্দ ঝা বলেন, ‘আমাদের হাতে যদি ক্ষমতা থাকে, সবকিছুই সঠিক পথে চলে আসবে।’

তবে অতীতে ভারতের প্রতিষ্ঠাকালীন ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে সাংঘর্ষিক অবস্থানের কারণে যে দমন–পীড়নের মুখে আরএসএসকে পড়তে হয়েছিল, তার প্রভাব আজও রয়ে গেছে। বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশের ওপর বিপুল প্রভাব খাটালেও আরএসএস তা করে খুব সীমিত স্বচ্ছতা ও জবাবদিহির মাধ্যমে। সংগঠনটি বিস্তারিত নথিপত্র সংরক্ষণ করে না। অসংখ্য ছোট ও স্বাধীন সংগঠন ও দাতব্য প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তারা বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছে।

ভারতের আর্থিক রাজধানী মুম্বাইয়ে আরএসএসের নেতা ড. নিশিথ ভাণ্ডারকর বলেন, ‘আরএসএসের নিজের কিছুই নেই। আমাদের আছে শুধু মানুষ।’

আরএসএসের উত্থান এবং ভারতের ভবিষ্যৎ নিয়ে তাদের লক্ষ্য বোঝার জন্য দ্য নিউইয়র্ক টাইমস সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে কথা বলেছে, তাদের সম্মেলনে অংশ নিয়েছে এবং তৃণমূল পর্যায়ের শাখাগুলো ঘুরে দেখেছে।

আরএসএসের উত্থান নিয়ে নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনের প্রচ্ছদ

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় আরএসএস নেতারা তুলনামূলক জনমুখী একটি অবস্থান নিয়েছেন, যা দেশের জন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসনের জন্য আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক একটি ধারণা তুলে ধরেছে। কিন্তু বাস্তবে এ অবস্থান অনেক সময় হারিয়ে যায়। আরও চরম ডানপন্থী নেতাদের একটি নতুন প্রজন্ম মনোযোগ কাড়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কারণে তাদের বক্তব্য আরও জোরদার হচ্ছে। ফলে সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে সহিংসতা অনেক ক্ষেত্রে স্বাভাবিক হয়ে উঠছে।

আরএসএসের সহযোগী সংগঠনগুলোর সদস্য পরিচয় নিয়ে গর্ব করা উগ্রবাদীরা ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে জনজীবন নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা মুসলিম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক বর্জন কর্মসূচি জোরদার করছে। হিন্দু উৎসবগুলোকে শক্তি প্রদর্শনের মঞ্চে পরিণত করছে। জোরপূর্বক ধর্মান্তরের অভিযোগ তুলে তারা গির্জায় হামলা চালিয়েছে, বড়দিনের অনুষ্ঠান ভাঙচুর করেছে, মুসলমানদের কবরগুলো খুঁড়ে ফেলেছে। ভিন্ন ধর্মের দুজনের মধ্যে সম্পর্ক রয়েছে—এমন সন্দেহে ট্রেন থেকে যুগলকে টেনেহিঁচড়ে নামানো হয়েছে। গরুর মাংস বহনের অভিযোগে মানুষজনকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

ভারতে আরএসএসের বিক্ষোভ থেকে অন্য ধর্মের মানুষের আক্রান্ত হওয়ার অভিযোগ রয়েছে
ফাইল ছবি: রয়টার্স

আরএসএসের ধারণাগুলো ভারতে গভীরভাবে প্রোথিত হচ্ছে। তা ছড়িয়ে পড়েছে দেশটির ইতিহাসের পাঠ্যবইয়ের পাতা থেকে শুরু করে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে, টেলিভিশন বিতর্ক—এমনকি আদালতেও। এই আদালতকে দীর্ঘদিন ধরে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতার রক্ষক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

গত ডিসেম্বরে ভারতের অন্যতম বৃহত্তম ও প্রাচীন আদালত এলাহাবাদ হাইকোর্টের চত্বরে সেমিনারের আয়োজন করে আরএসএসের সবচেয়ে কট্টর সহযোগী সংগঠনগুলোর একটি। সেখানে মূল বক্তৃতায় বিচারপতি শেখর কুমার যাদব বলেন, হিন্দু সমাজ তার দুর্বলতাগুলো সংশোধন করেছে। তখন ‘এই মানুষগুলোর’ ভুলের একটি তালিকা তুলে ধরেন তিনি। পরে তিনি খোলাসা করেন ‘এই মানুষগুলো’ বলতে তিনি মুসলমানদের বুঝিয়েছেন।

ওই বিচারপতি বলেন, ‘আমার বলতে কোনো দ্বিধা নেই যে এটা ভারত এবং এই দেশ সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা অনুযায়ীই চলবে।’

ভিত স্থাপন

গত আগস্টের এক ভোর। মুম্বাইয়ের একটি পার্কে আঁধারের মধ্যে বৃষ্টি উপেক্ষা করে ধীরে ধীরে জড়ো হন প্রায় এক ডজন মানুষ। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সম্পত্তি ব্যবসায়ী, বিজ্ঞাপন এজেন্ট ও নৌবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। আরএসএসের সঙ্গে তাঁরা পাঁচ বছর থেকে শুরু করে ৫৫ বছর পর্যন্ত জড়িত।

তাঁরা সবাই একটি ছোট গেরুয়া পতাকার সামনে শ্রদ্ধা জানান। তারপর দলের নেতার প্রতি সমর্থন জানিয়ে বৃত্তাকারে দাঁড়িয়ে ভক্তিমূলক গান গাইতে শুরু করেন। এরপর একজন প্রশিক্ষক বাঁশি বাজান। বাঁশির শব্দে শুরু হয় শরীরচর্চা। অংশগ্রহণকারীদের দেহে বার্ধক্যে ন্যুব্জ হলেও তাঁদের শরীরচর্চা ছিল সুসংগঠিত। তাতে ছিল সামরিক তৎপরতার ছাপ। এরপর হয় কুচকাওয়াজ।

নরেন্দ্র মোদির রাজ্য গুজরাটে প্রশিক্ষণে আরএসএস সদস্যরা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

প্রতিদিনের মতোই সেই সকালটাও শেষ হয় একই বন্দনার মধ্য দিয়ে। সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে বুকের সামনে ডান হাত বাড়িয়ে দেন অংশগ্রহণকারীরা। তাঁদের হাতের তালু ছিল নিচের দিকে। গেরুয়া পতাকার সামনে মাথা নত করেছিলেন তাঁরা।

আরএসএসের ছোট ছোট অংশের এই সম্মিলনগুলো ‘শাখা’ নামে পরিচিত। ১৯২৫ সালে একজন চিকিৎসকের হাতে আরএসএসের প্রতিষ্ঠার পর থেকেই সংগঠনটির ভিত্তি হিসেবে কাজ করে আসছে এসব শাখা।

ভারত যখন ব্রিটিশ শাসন থেকে স্বাধীনতার জন্য লড়াই করছিল, তখন ডানপন্থী মতাদর্শের কিছু ব্যক্তি নিজেদের সামনে আরও বড় একটি সংগ্রাম দেখেছিলেন। তাঁদের মতে, শত শত বছর আগের মুসলমানদের আক্রমণ হিন্দুদের আত্মবিশ্বাস ভেঙে দিয়েছিল এবং পরবর্তী ঔপনিবেশিক শক্তির জন্য পথ তৈরি করেছিল। সেই অবস্থা থেকে হিন্দুদের পুনরুজ্জীবিত করাই ছিল তাঁদের ওই সংগ্রাম। সমাজকে নতুন করে গড়ে তুলতে একেবারে নিচের স্তর থেকে ওপরে ওঠার কৌশল হাতে নেয় আরএসএস।

বিজেপি নিজেদের বিশ্বের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বলে দাবি করে। এই দলের সদস্যসংখ্যা ১০ কোটির বেশি। আর আরএসএসের রয়েছে বহু শাখা। এর মধ্যে আছে বড় ছাত্রসংগঠন, শ্রমিক ইউনিয়ন, কৃষক সংগঠন, পেশাজীবীদের নেটওয়ার্ক, ধর্মীয় সংগঠন ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান। নিয়মিত সমন্বিত বৈঠকের মাধ্যমে এসব সহযোগী সংগঠন আরএসএসের হিন্দু এজেন্ডাকে রাজনৈতিক শক্তিতে রূপ দিতে কাজ করে।

বর্তমানে সারা দেশে আরএসএসের ৮৩ হাজার শাখা রয়েছে। পাড়া–মহল্লা স্তর থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত এসব শাখা হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে একে অপরের সঙ্গে যুক্ত। আরএসএস যে ধরনের মানুষদের ভারতের ভবিষ্যৎ যোদ্ধা হিসেবে গড়ে তুলতে চায়, সেই ছাঁচ তৈরির মূল ভিত্তি এই শাখাগুলোই। মানুষের একটি মৌলিক চাহিদা হলো সম্প্রদায়ের মধ্যে থাকা ও বন্ধুত্ববোধ। এই চাহিদার ওপর ভর করে প্রতিদিনের সাধারণ অনুশীলনের মাধ্যমে আরএসএস মানুষের মধ্যে অভ্যাস তৈরি করে এবং আদর্শ গেঁথে দেয়।

এই শাখাগুলোর ভেতরেই আরএসএস তাদের সম্ভাবনাময় সদস্যদের খোঁজ করে এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি করে। (নরেন্দ্র মোদি ছেলেবেলায় শাখায় যাওয়া শুরু করেন এবং তরুণ বয়সে আরএসএসের পূর্ণকালীন প্রচারক হন) এই সদস্যরাই পরে আরএসএসের বিশাল নেটওয়ার্কের আওতায় থাকা সহযোগী সংগঠনগুলোয় ছড়িয়ে পড়েন।

আরএসএসের বর্তমান প্রধান মোহান ভাগবত
ছবি: রয়টার্স

সম্প্রতি এক বক্তৃতায় শাখাগুলো সম্পর্কে কথা বলেন আরএসএসের ষষ্ঠ ও বর্তমান প্রধান মোহন ভাগবত। তাঁর ভাষ্যে, ‘১০০ বছর ধরে আমাদের স্বেচ্ছাসেবকেরা সব ধরনের পরিস্থিতিতেই এই ব্যবস্থাকে ধারাবাহিকভাবে টিকিয়ে রেখেছেন।’

আরএসএসপ্রধানের ভূমিকাকে অনেক সময় রোমান ক্যাথলিক চার্চের পোপের সঙ্গে তুলনা করা হয়। প্যারিসের সায়েন্সেস পো–এর গবেষকেরা আরএসএস নিয়ে গবেষণা করেছেন। সংগঠনটির কার্যপ্রণালিকে তাঁরা বর্ণনা করেছেন এভাবে, ‘একটি পরিকল্পিত প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নতুন নতুন সংস্থা গড়ে তোলা, যাতে তাদের নেটওয়ার্ক বড় হয়। একই সঙ্গে এটা নিশ্চিত করা যে সংস্থাগুলো যেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত থাকে।’

সায়েন্সেস পোর গবেষকদের গবেষণায় দেখা গেছে, আরএসএসের অন্তত ২ হাজার ৫০০টি সংগঠন রয়েছে। এই সংগঠনগুলোর মধ্যে ‘সুস্পষ্ট, অনুসরণযোগ্য ও বাস্তব সম্পর্ক’ রয়েছে । এই সম্পর্ক সংগঠনগুলোকে ‘একটি একক সত্তার ঘনিষ্ঠ অংশে’ পরিণত করেছে।

আরএসএসের প্রথম দিকের নেতারা কোনো রাখঢাক না রেখেই তাঁদের লড়াইয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। সেটি হলো, ভারতের পরিচয় হবে একটাই। তা হলো হিন্দু।

এম এস গোলওয়ালকর, যিনি সবচেয়ে বেশি সময় আরএসএস প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন
ছবি: সংগৃহীত

১৯৩৯ সালে প্রকাশিত একটি বইয়ে আরএসএসের দ্বিতীয় ও সবচেয়ে দীর্ঘ সময় ধরে দায়িত্ব পালন করা প্রধান এম এস গোলওয়ালকর জার্মানিতে হিটলারের ইহুদি নিধনের উদাহরণ টেনে বলেছিলেন, ভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতিকে একক জাতিতে পরিণত করা সম্ভব নয়।

গোলওয়ালকরের যুক্তি ছিল, যাঁরা হিন্দু নন, তাঁরা কেবল তখনই ভারতে থাকতে পারবেন, যখন তাঁরা হিন্দু জাতির পুরোপুরি অধীনস্থ থাকবেন, কোনো দাবি না তুলবেন, কোনো সুযোগ প্রত্যাশা না করবেন, এমনকি নাগরিক অধিকার পর্যন্ত দাবি না করবেন।

তবে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভেতরে থাকা এই রক্ষণশীল ধারাকে প্রথম দিকে ছাপিয়ে গিয়েছিল একটি উদারপন্থী ধারা। তারা বহুত্ববাদী ভারতের স্বপ্ন আঁকড়ে ধরেছিল। এই ধারার নেতৃত্বে ছিলেন মহাত্মা গান্ধী। তিনি ধর্মীয় সহিংসতার প্রতিবাদে অনশন পর্যন্ত করেছিলেন।

১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসান হয়। তখন মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের জন্য ভারতবর্ষের বড় একটি অংশ আলাদা করে দেওয়া হয়। এতে হিন্দু ডানপন্থীরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। তাদের ক্ষোভের মূল লক্ষ্য হয়ে ওঠেন গান্ধী। তিনি পরে সন্ধ্যাকালীন এক প্রার্থনাসভায় গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।

ভারতের স্বাধীনতাসংগ্রামের অন্যতম অগ্রনায়ক মহাত্মা গান্ধী
ছবি: ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ওয়েবসাইট থেকে নেওয়া

গান্ধীর ঘাতক ছিলেন একজন ডানপন্থী হিন্দু কর্মী। তাঁর সঙ্গে আরএসএসের সংশ্লিষ্টতা ছিল। সংগঠনটি তখন দাবি করে, ওই ব্যক্তি বহু বছর আগেই আরএসএস ছেড়ে দিয়েছিলেন। তবু আরএসএসকে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর তারা দীর্ঘদিন ধরে সমাজে একঘরে হয়ে ছিল।

ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র হিসেবে কল্পিত ভারত ছিল সমাজের ওপরের স্তর থেকে চাপিয়ে দেওয়া এক আদর্শবাদী প্রকল্প। এই আদর্শবাদী প্রকল্পে মুসলিম শাসন এবং ঔপনিবেশিক যুগের ক্ষত ও অপমানের বিষয়গুলো অমীমাংসিতই থেকে যায়। গভীরে থাকা এই ক্ষোভকেই আরএসএস তাদের বিস্তৃত হওয়ার হাতিয়ার করে তোলে।

পঞ্চাশের দশকে একটি রাজনৈতিক শাখা গড়ে তুলে আরএসএস ধীরে ধীরে রাজনীতিতে প্রবেশ করে। ওই শাখাটি পরে বিজেপি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। সত্তরের দশকে তারা প্রথম বড় সাফল্য পায়। এরপর থেকে তারা ক্রমাগত নিজেদের ভিত্তি আরও শক্ত করে তুলতে থাকে।

ক্ষমতার উত্থান

১৯৭৫ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ও কংগ্রেস নেতা ইন্দিরা গান্ধী দেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া স্থগিত করেছিলেন। আদালতের রায়ে তাঁর নির্বাচনী বিজয় বাতিল হওয়ার পর এমন পদক্ষেপ নেন তিনি। ওই সময় আরএসএসসহ বিভিন্ন সংগঠনের বিরুদ্ধে তাঁর সরকার নিপীড়নমূলক অভিযান চালায়। ফলে ওই সংগঠনগুলোর প্রতি মানুষের বড় সহানুভূতি সৃষ্টি হয়। সে সময় বিপুলসংখ্যক আরএসএস নেতা গ্রেপ্তার হন। তখন থেকেই নিজেদের ভারতের গণতন্ত্র রক্ষার আন্দোলনের অন্যতম স্তম্ভ হিসেবে তুলে ধরতে শুরু করে আরএসএস।

এস এম বাঘাডকা ভারতের একজন সরকারি কর্মচারী। দীর্ঘদিন ধরে আরএসএস সদস্য তিনি। ভারতের নাগপুরে এক সকালে শরীরচর্চার সময় তিনি বলেন, ‘আমার মা কংগ্রেসে ভোট দিতেন। কিন্তু বাবা ছিলেন আরএসএসের সঙ্গে। ইন্দিরা গান্ধী যখন আমার বাবাকে জেলে পাঠালেন, তখন আমার মা–ও পক্ষ বদল করেন।’

নব্বইয়ের দশকে একটি বিতর্কিত ধর্মীয় স্থানকে কেন্দ্র করে চালানো আন্দোলন আরএসএসকে দ্বিতীয় বড় সুযোগটি এনে দিয়েছিল। এর মধ্য দিয়ে ভারতের রাজনীতির গতিপথ চিরদিনের জন্য বদলে যায়।

উত্তর প্রদেশের অযোধ্যা শহরে ষোলো শতকের একটি মসজিদ আরএসএসের প্রতীকী লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়। আরএসএসের দাবি ছিল, ওই জায়গায় একসময় হিন্দু দেবতা রামের একটি মন্দির ছিল। বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে ভারতের আদালতে ঘুরপাক খাচ্ছিল। তবে হিন্দু ডানপন্থীদের ভিন্ন পরিকল্পনাও ছিল।

বিজেপির তৎকালীন সভাপতি একটি ট্রাককে রথের আদলে সাজিয়ে সারা দেশে সফর করেন। তাঁর এই বহর এগোতে থাকলে একের পর এক এলাকায় প্রাণঘাতী উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। আরএসএস নেতাদের ভাষায়, এই আন্দোলনের বৃহত্তর লক্ষ্য ছিল—হিন্দু ধর্মের বিশাল বৈচিত্র্যকে একত্র করা। ‘জয় শ্রী রাম’—তাদের যুদ্ধধ্বনি হয়ে ওঠে।

১৯৯২ সালে এই উত্তেজনার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে। লোহার রড, গাঁইতি হাতে ক্ষুব্ধ উচ্ছৃঙ্খল জনতা মসজিদের গম্বুজে উঠে সেটি ভেঙে ফেলে। এই জনতার মধ্যে আরএসএসের সহযোগীরাও ছিলেন।

এরপর আবারও আরএসএস নিষিদ্ধ হয়। তবে সেই সময় গড়ে ওঠা কৌশলই পরবর্তীকালে সংগঠনটির সাফল্যের মূল সূত্র হিসেবে থেকে যায়। তা হলো অতীতের ক্ষোভকে কেন্দ্র করে হিন্দুদের ঐক্যবদ্ধ করা এবং স্থানীয় পর্যায় পর্যন্ত এক ধরনের যুদ্ধংদেহী প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা ছড়িয়ে দেওয়া। আরএসএসের ওই কৌশলে ভারতের মুসলিম ও খ্রিষ্টানদের অতীতের অবশিষ্টাংশ হিসেবে দেখা হয়।

নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে জোট সরকারের অংশ হিসেবে আরএসএস প্রথম ক্ষমতার স্বাদ পায়। তবে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই নিজেদের উদ্দেশ্য পুরোদমে বাস্তবায়ন শুরু করে সংগঠনটি।

১৯৯২ সালে ভেঙে ফেলা হয় অযোধ্যার বাবরি মসজিদ। এর নেতৃত্বে ছিলেন আরএসএস নেতারা
ছবি: ভিডিও থেকে

মসজিদ ভাঙায় উচ্ছৃঙ্খল জনতার ভূমিকার বিষয়টি ভারতের সুপ্রিম কোর্ট একপ্রকার ছাড় দেওয়ার পর অযোধ্যায় একটি বিশাল রামমন্দির নির্মাণে দ্রুত পদক্ষেপ নেন মোদি। একই সঙ্গে তিনি মুসলিম–সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও কাশ্মীর রাজ্যের দীর্ঘদিনের আধা স্বায়ত্তশাসন বাতিল করে অঞ্চলটিকে সরাসরি নয়াদিল্লির নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসেন।

গত এক দশকে সারা দেশে আরএসএসের সামাজিক উপস্থিতিও দ্বিগুণ হয়েছে। সংগঠনটির নেতারা এখন অসীম ক্ষমতার জেরে পাওয়া স্বাধীনতা ও বিলাসিতা উপভোগ করছেন। নয়াদিল্লিতে তাঁরা ৩ দশমিক ৭ একর জমির ওপর তিনটি ১৩ তলা ভবন নিয়ে একটি জাঁকজমকপূর্ণ প্রাঙ্গণ গড়ে তুলেছেন। প্রধানমন্ত্রী মোদির নিরাপত্তাবহরের প্রায় সমান নিরাপত্তা নিয়ে চলাফেরা করেন মোহন ভাগবত। ‘সমাজ আমাদের কথা শোনে,’ বলছেন তিনি।

সবকিছু অবশ্য মসৃণভাবে এগোয়নি। আরএসএসের কিছু নেতা মনে করেন, মোদি এতটাই ক্ষমতাবান হয়ে উঠেছেন যে তিনি সংগঠনকে ছাপিয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের মতে, সবকিছুর মধ্যে নিজের নাম ও ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার যে প্রবণতা নরেন্দ্র মোদির রয়েছে, তা সামলাতে শিক্ষা ও সংস্কৃতির মতো ক্ষেত্রে সূক্ষ্ম কৌশল খাটাতে হয়েছে ভাগবতকে। এই ক্ষেত্রগুলো আরএসএসের মূল মনোযোগের জায়গা।

তবে সংগঠনের মূল কাঠামো ও তার রাজনৈতিক শাখার মধ্যে বিরোধের খবর প্রকাশ্যে অস্বীকার করে এসেছেন ভাগবত। তিনি বলেন, ‘প্রতিদবন্দ্বিতা আছে। কিন্তু ঝগড়া নেই।’

আরএসএসের বিস্তৃত নেটওয়ার্কের জন্য মোদির প্রতীকী গুরুত্ব ব্যাপক। নাগপুরের মানবসম্পদ পরামর্শক আল্হাদ সদাচার (৪৯) ছেলেবেলা থেকেই আরএসএসের স্বেচ্ছাসেবক। তিনি বলেন, মোদি একেবারে তৃণমূল থেকে উঠে এসেছেন। তাই তিনি বিষয়গুলো আরও ভালো বোঝেন।

‘প্রতিটি ঘর, প্রতিটি রাস্তা’

অক্টোবরে যখন আরএসএসের শতবর্ষ উদ্‌যাপন শুরু হয়েছিল, তখন অতীতের কোনো কলঙ্কের ছাপ আর চোখে পড়েনি।

টেলিভিশন চ্যানেলগুলো দিনভর সরাসরি সম্প্রচার করেছে। প্রভাবশালী রাজনীতিকেরা বাদামি প্যান্ট, সাদা শার্ট ও কালো টুপি পরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আরএসএসের চিরচেনা ধারায় অভিবাদন জানান। অভিনন্দনবার্তা এসেছিল সব জায়গা থেকে—বলিউড তারকা থেকে শুরু করে দালাই লামার কাছ থেকেও।

আরএসএসের জন্মস্থান ও প্রধান কার্যালয় নাগপুরে। সেখানে শতবর্ষ উদ্‌যাপন অনুষ্ঠানে মোহন ভাগবত দেখেন ইউনিফর্ম পরা হাজার হাজার স্বেচ্ছাসেবকের কসরত, গান আর যোগব্যায়াম। তাঁদের এ প্রদর্শন ছিল প্রায় ১০ হাজার মানুষের সামনে। দর্শকদের মধ্যে ছিলেন কয়েক ডজন বিদেশি কূটনীতিকও।

সমাপনী ভাষণের জন্য যখন প্রধান আদর্শিক নেতা (ভাগবত) মঞ্চে উঠলেন, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ছিল স্পষ্ট—আরএসএসকে ছড়িয়ে দিতে হবে, যতক্ষণ না ‘প্রতিটি ঘর, প্রতিটি রাস্তা’ তাদের আওতায় আসে।

আরএসএস যেসব বিষয়ে দীর্ঘদিন ধরে ধীরে এগিয়েছে, সেসব ক্ষেত্রে পরিবর্তনের চেষ্টার জন্য কৃতিত্ব দেওয়া হয় গোঁফওয়ালা এই নেতাকে। এর মধ্যে রয়েছে ভারতের কঠোর বর্ণব্যবস্থার প্রভাব কমিয়ে একটি ‘শোষণমুক্ত’ সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা। তিনি উগ্রবাদীদের সমালোচনা করেছেন এবং বলেছেন যে আরএসএস মসজিদ ভেঙে মন্দির নির্মাণের পক্ষে নয় (অযোধ্যারটি ছাড়া)। তবে তিনি এ-ও যোগ করেন, ব্যক্তিগত পরিসরে কোনো সদস্য যদি এমন আন্দোলনে অংশ নেয়, তাহলে আরএসএস আপত্তি জানাবে না।

আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের সঙ্গে নরেন্দ্র মোদি
ফাইল ছবি: রয়টার্স

আরএসএসের চূড়ান্ত লক্ষ্য একটি ‘হিন্দুরাষ্ট্র’ প্রতিষ্ঠা করা। এটি একটি সর্বব্যাপী ব্যবস্থা। একে অনেক সময় ধর্মনিরপেক্ষ ভারতকে হিন্দুরাষ্ট্রে রূপান্তরের বিষয় হিসেবে সরলীকরণ করা হয়। ভাগবত বলেন, এই শব্দটির ‘ভুল’ ব্যাখ্যা হয়েছে। তাঁদের আসল উদ্দেশ্য হলো হিন্দু জাতির সংহতি। তাঁর ভাষায়, এটি একটি সাংস্কৃতিক সংজ্ঞা আর ভারতে বসবাসকারী সবাইকেই তাঁরা হিন্দু হিসেবে দেখেন।

তবে সাম্প্রতিক বক্তব্যগুলোতে ভাগবত বারবার ‘অন্যান্য সম্প্রদায়ের’ কথাও বলেছেন। এটি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বোঝাতে ব্যবহার করা একটি পরিভাষা। এক সময় তিনি তিনটি সন্তান নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন। কারণ, তাঁর দাবি হিন্দুদের জন্মহার ‘অন্যান্য সম্প্রদায়ের’ তুলনায় দ্রুত কমছে।

নাগপুরে আরএসএসের শতবর্ষ উপলক্ষে দেওয়া ভাষণে ভাগবত বিদেশিদের হাত ধরে আসা ধর্মগুলোর অনুসারীদের গ্রহণ করে নেওয়ার কথা বলেন। তাঁদের উপাসনালয়গুলোর প্রতি ‘সৌহার্দ্যপূর্ণ ও শ্রদ্ধাশীল’ আচরণের আহ্বান জানান। ‘দাঙ্গায় জড়ানো’ এবং সহিংসতা উসকে দেওয়ার বিরুদ্ধেও কথা বলেন তিনি।

তারপর, তিনি প্রায়ই যেমন করেন, তেমনভাবেই দরজা খানিকটা খোলাও রাখেন ভাগবত। তিনি বলেন, ‘তবে সমাজের ভালো মানুষদের এবং তরুণ প্রজন্মকে সজাগ ও সংগঠিত থাকতে হবে। প্রয়োজনে তাদের হস্তক্ষেপও করতে হবে।’

এই ধরনের দ্বিমুখী বক্তব্য কীভাবে কাজ করে, তা দেখতে হলে নজর দিতে হবে ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশের দিকে। সেখানে জনসংখ্যা ২০ কোটির বেশি। রাজ্যটিতে বিজেপি থেকে ক্ষমতাধর মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথকে প্রায়ই মোদির সম্ভাব্য উত্তরসূরি হিসেবে দেখা হয়।

আদিত্যনাথ প্রায়ই বড় বড় হিন্দু অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং হেলিকপ্টার থেকে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের শোভাযাত্রার ওপর ফুল বর্ষণ করেন। কিন্তু তাঁর রাজ্যের পুলিশ যখন মুসলমানদের প্রকাশ্য ধর্মাচরণের ওপর কড়াকড়ি করে, তখন এ কথা বলে তিনি এই কড়াকড়ির পক্ষে যুক্তি দেখান যে ভারত একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র, তাই মুসলমানদের উচিত তাদের ধর্ম ব্যক্তিগত পরিসরে পালন করা।

ভারতের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ
ফাইল ছবি: রয়টার্স

আদিত্যনাথ একজন হিন্দু সন্ন্যাসী। গেরুয়া পোশাকেই তিনি সরকারি কাজকর্ম করেন। তিনি বলেন, ‘ধর্ম এমন কিছু নয়, যা মোড়ে মোড়ে প্রদর্শন করতে হবে।’

আদিত্যনাথ যখন আরএসএসের শতবর্ষে সংগঠনটির প্রশংসা করছিলেন, তখন তাঁর রাজ্যের বিস্তীর্ণ অংশ কয়েক দিন ধরেই উত্তাল ছিল। এর জেরে তাঁর সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়।

মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর জন্মদিন উপলক্ষে ‘আই লাভ মুহাম্মদ’ লেখা প্রদর্শনের জন্য পুলিশ এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করার পর উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। ওই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে মুসলমানরা বড় সমাবেশ করলে আদিত্যনাথ আরও পুলিশ মাঠে নামান। লাঠিপেটা করে বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ করা হয়। ডজনখানেক মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। এক হাজারের বেশি মানুষের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করা হয়। ওই বিক্ষোভের নেতাদের বাড়িঘর ভাঙতে আনা হয় বুলডোজার। এই কারণে আদিত্যনাথ ‘বুলডোজার বাবা’ তকমা পেয়েছেন।

এর বিপরীতে আদিত্যনাথের দমননীতির সমর্থনে যখন একই ধরনের ধর্মীয় আবহে তাঁর হিন্দু সমর্থকেরা বিপুল সংখ্যায় রাস্তায় নামেন, তখন পুলিশের তেমন কোনো শক্তি প্রদর্শন দেখা যায়নি। তাঁদের হাতে থাকা প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল, ‘আই লাভ মহাদেব’, ‘আই লাভ যোগী’ ও ‘আই লাভ বুলডোজার’।

লেখক

  • মুজিব মাশাল, নিউইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়া ব্যুরোপ্রধান

  • হরি কুমার, নিউইয়র্ক টাইমসের ভারত রিপোর্টার

[প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেন সুহাসিনী রাজ (বেঙ্গালুরু), প্রগতি কে বি (নয়াদিল্লি), অনুবাদ করেছেন শেখ নিয়ামত উল্লাহ]