তাইওয়ানে গেছেন ন্যান্সি পেলোসি, হোটেলের বাইরে বিক্ষোভ

তাইওয়ানে এসে পৌঁছেছেন ন্যান্সি পেলোসি
ছবি: রয়টার্স

চীনের কড়া হুঁশিয়ারির পরও তাইওয়ানে গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। মঙ্গলবার রাতে তিনি নির্ধারিত সময়ের কিছুটা আগেই তাইপেতে এসে পৌঁছান। স্থানীয় সময় ১০টা ৪৪ মিনিটে তাঁর উড়োজাহাজ তাইপের মাটি স্পর্শ করে। মার্কিন সামরিক বাহিনীর একটি বিমানে করে মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর থেকে তিনি তাইপেতে এসে পৌঁছান। উড়োজাহাজের সিঁড়ি দিয়ে নামার পর তাইওয়ানের একদল প্রতিনিধি তাঁকে স্বাগত জানান। খবর বিবিসির

পেলোসির সফর ঘিরে ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে উত্তেজনা চলছে। তাইওয়ানের পূর্বাঞ্চলের জলসীমায় একটি যুদ্ধবিমানবাহী রণতরিসহ চারটি যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে চীন। আকাশে চক্কর দিয়েছে চীনা যুদ্ধবিমান।

গত ২৫ বছরের মধ্যে তাইওয়ান সফর করা সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ মার্কিন রাজনীতিবিদ পেলোসি। তবে তাঁর এই সফরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সমর্থন দেননি।

রাশিয়া ও চীন যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করে বলেছে, পেলোসির সফর উসকানিমূলক এবং তা এ অঞ্চলের জন্য অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি করবে।
তাইওয়ানে পৌঁছানোর পর টুইট করে পেলোসি বলেন, তাঁর প্রতিনিধিদলের সফর ‘তাইওয়ানের গতিশীল গণতন্ত্রের’ প্রতি আমেরিকার অবিচল প্রতিশ্রুতিকে সম্মানিত করেছে।

পেলোসি লিখেছেন, তাইওয়ানের ২ কোটি ৩০ লাখ মানুষের সঙ্গে আমেরিকার সংহতি আজ আগের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর সফর কোনোভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী নীতির বিরোধিতা করে না।

পেলোসি তাইপের গ্র্যান্ড হায়াত হোটেলে রাত কাটাবেন। তাঁর সফরের বিরোধিতা করে হোটেলের বাইরে চীনপন্থী লোকজন বিক্ষোভ করছেন।

তাইওয়ানের গণমাধ্যম বলছে, আগামীকাল সকালে তাইওয়ানের প্রেসিডেন্ট সাই ইংওয়েনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করবেন ন্যান্সি পেলোসি। এরপর তিনি তাইওয়ানের পার্লামেন্টে যাবেন। এ ছাড়া তিনি মানবাধিকার জাদুঘরেও যাবেন।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের তীব্র নিন্দা করেছে এবং একে এক চীন নীতির গুরুতর লঙ্ঘন হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। তারা বলেছে, এই সফর চীন-মার্কিন সম্পর্কের রাজনৈতিক ভিত্তির ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলবে।
দীর্ঘদিনের ‘শত্রু’ পেলোসির এই সফর নিয়ে অনেক গা-জ্বলা রয়েছে চীনের। কারণ, তাইওয়ানকে নিজের ভূখণ্ড মনে করে বেইজিং। কিন্তু তাইওয়ানের মানুষ নিজেদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবেই দেখেন। যুক্তরাষ্ট্র তাইওয়ানকে অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করে আসছে দীর্ঘদিন ধরে।

চীন বলে আসছিল, পেলোসি তাইওয়ান সফরে গেলে এর পরিণাম হবে ভয়াবহ। আর সেটার মূল্যও চুকাতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকেই। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র হুয়া চুনয়িং বলেছিলেন, পেলোসির সফরের দায় যুক্তরাষ্ট্রকে বহন করতে হবে এবং চীনের সার্বভৌম নিরাপত্তা স্বার্থকে ক্ষুণ্ন করার জন্য মূল্য দিতে হবে। সামরিক উপায়ে এর জবাব দেওয়ারও হুমকি দেয় বেইজিং। গত সপ্তাহে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে এক টেলিফোন আলাপে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ‘আগুন নিয়ে খেলার’ বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রকে সতর্ক করেন।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আরেক মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেছিলেন, যুক্তরাষ্ট্র সরকারের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি। তিনি যদি তাইওয়ান সফর করেন, তাহলে এর রাজনৈতিক পরিণতি হবে গুরুতর। তাইওয়ান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চীনের যেকোনোবারের চেয়ে এবারের হুমকি হবে কঠোর।

পেলোসির সফরকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট উত্তেজনায় তাইওয়ান প্রণালিতে বেইজিং ও ওয়াশিংটন—উভয়ই যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন করেছে। এ ছাড়া তাইওয়ানের জলসীমার কাছাকাছি অঞ্চল দিয়ে একাধিক চীনা যুদ্ধবিমান উড়ে গেছে। গত সোমবার থেকে সেখানে বেশ কিছু চীনা যুদ্ধজাহাজ মোতায়েন রাখা হয়েছে। এ বিষয়ে অবশ্য চীনের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো মন্তব্য করা হয়নি।

একটি সূত্র বলেছে, চীনের যুদ্ধবিমান ও যুদ্ধজাহাজের তাইওয়ান ও চীনের মধ্যবর্তী অঘোষিত সীমানায় অবস্থান করার বিষয়টি অনেকটাই অস্বাভাবিক ও উত্তেজনা সৃষ্টিকারী। ওই সূত্র আরও বলেছে, চীনা যুদ্ধবিমান বারবার কৌশলগতভাবে মধ্যরেখা বরাবর এসে আবার প্রণালির অন্যদিক প্রদক্ষিণ করেছে।

তাইওয়ানের বিপরীতে চীনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় শহর শিয়ামেনের বাসিন্দারা সাঁজোয়া যান চলাচল করতে দেখেছেন। গত সপ্তাহ থেকে চীনের সেনাবাহিনী দক্ষিণ চীন সাগর, পীতসাগর ও বোহান সিতে একাধিক সামরিক মহড়া চালিয়েছে।

এদিকে মার্কিন রণতরি ইউএসএস রোনাল্ড রিগ্যান বর্তমানে ফিলিপাইন সাগরে অবস্থান করছে। মার্কিন নৌবাহিনীর একজন কর্মকর্তা বলেছেন, যেকোনো উসকানিতে তাঁরা জবাব দিতে সক্ষম।

তাইপেতে পেলোসির হোটেলের সামনে বিক্ষোভ
ছবি: রয়টার্স

মার্কিন নৌ কর্মকর্তা আরও জানান, ইউএসএস ত্রিপোলি নামের আরেকটি উভচর জাহাজও ওই এলাকায় মোতায়েন রাখা হয়েছে। সান ডিয়েগো থেকে গত মে মাসে এটি যাত্রা শুরু করে।

আঞ্চলিক সামরিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, চীন বা যুক্তরাষ্ট্র—কেউই সংঘর্ষ না চাইলেও উত্তেজনার সময়ে সেনা মোতায়েন দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়।

বাইডেন প্রশাসনের কর্মকর্তারাও পেলোসির এখন তাইওয়ান সফরে যাওয়া উচিত নয় বলে পরামর্শ দিয়েছিলেন। মূলত পেলোসি তাইওয়ান সফর করলে বেইজিংয়ের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া নিয়ে উদ্বেগ থেকেই তাঁকে সতর্ক করা হয়। তবে হোয়াইট হাউসের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের মুখপাত্র জন কিরবি বলেছেন, পেলোসি যেখানে খুশি, সেখানে যাওয়ার অধিকারী। তাঁর তাইওয়ান সফরের অধিকার রয়েছে।

কিরবি গোয়েন্দা তথ্যের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেছেন, চীন সম্ভাব্য সামরিক উসকানির প্রস্তুতি নিচ্ছে। পেলোসি সামরিক উড়োজাহাজে ভ্রমণ করছেন। ওয়াশিংটন সরাসরি আক্রমণের ভয় না পেলেও ‘ভুল হিসাবের’ ঝুঁকি বাড়ায় এটি।
তবে রাশিয়া চীনের সুরে কথা বলেছে। দেশটি বলেছে, পেলোসির এই সফর উত্তেজনা বাড়ানোর কারণ।