ইরান আর আগের অবস্থায় নেই। নীতি পুলিশ হেফাজতে কুর্দি তরুণী মাসা আমিনির মৃত্যুর পর থেকে ফুঁসছে জনগণ। বিক্ষোভ থামাতে মরিয়া সরকার। বেছে নিয়েছে দমনপীড়নের পথ। তবে এই পথ তাদের জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। পাশাপাশি ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে ড্রোন দিয়েও সহায়তা করছে দেশটি। তাদের এই রাশিয়া–ঘেঁষার বিষয়টিকেও সহজভাবে নিচ্ছে না যুক্তরাষ্ট্র। তাদের চোখে, ইরান রাশিয়ার যত ঘনিষ্ঠ হবে, তত তারা বাকি বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, ইরান এক ‘চক্রে’ আটকা পড়ে গেছে।
তেহরানে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত রব ম্যালি সম্প্রতি বলেছেন, ইরানের নেতৃত্ব তাদের দেশের মানুষকেই পর করেছে। জনগণের সঙ্গে সরকারের দূরত্ব বেড়েছে। একই সঙ্গে দূরত্ব বেড়েছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে। তারা যেন একটি চক্রে আটকা পড়েছে।
সম্প্রতি ইতালির রাজধানী রোমে এক সম্মেলনে অংশ নেন ম্যালি। সেখানে মার্কিন এই কূটনীতিক বলেন, ইরানের সঙ্গে ছয় দেশের সঙ্গে পারমাণুসংক্রান্ত চুক্তি পুনর্বহাল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা চলছিল। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এখন আর একে গুরুত্ব দিয়ে দেখবে না। এর পরিবর্তে ইরানের চলমান ঘটনাগুলোর ওপর চোখ রাখবে তারা। এ ছাড়া জাতিসংঘের নারীদের মর্যাদা-সম্পর্কিত কমিটি থেকে ইরানকে বাদ দেওয়ার প্রস্তাব আনতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র।
ইরান প্রসঙ্গে রব ম্যালি বলেন, ‘ইরান বিক্ষোভকারীদের যত দমন করবে, তত দেশটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আসবে; যত বেশি নিষেধাজ্ঞা আসবে, ইরান তত বেশি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। ইরান যত বেশি বিচ্ছিন্ন বোধ করবে, ততই তারা রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হবে; যত রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল হবে, তত তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাড়বে; পরিস্থিতি যত খারাপ হবে, ততই পারমাণবিক কূটনীতির সম্ভাবনা শেষ হবে।’ এভাবে দেখলে বোঝা যাবে ইরান এক চক্রে বাঁধা পড়ে গেছে।
এই চক্র থেকে বের হওয়ার পথও অবশ্য মার্কিন কূটনীতিক বলে দিয়েছেন। তাঁর কথায়, ইরানের নেতৃত্ব যদি তাঁদের পথ পরিবর্তন করে, তবে কূটনৈতিক দরজা এখনো খোলা আছে।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে, ইরান আসলে কী চাইছে? মার্কিন জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের পরিচালক এভ্রিল হেইনস বলেন, রাশিয়া ও ইরান সামরিক সহযোগিতা আরও গভীর করতে চাইছে। ইতিমধ্যে এর প্রমাণ পাওয়া গেছে। ইরানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী আলী বাঘেরি চলতি সপ্তাহে মস্কো সফর করেছেন।
ইউরোপের এক জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক বলেন, ইউক্রেনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ইরান একমাত্র দেশ, যারা কিনা রাশিয়াকে অস্ত্র দিচ্ছে। এ সিদ্ধান্তের মূল্য দিতে হচ্ছে ইরানকে।
মাসা আমিনির মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ইরানজুড়ে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভ এখনো চলছে। এর পেছনে বিদেশি ইন্ধনকে দুষছেন ইরানের নেতারা। তবে বিক্ষোভকারীদের শান্ত করতে পারেননি তাঁরা।
দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল মোহাম্মদ জাফর মনতাজেরি বলেছেন, ইরানে হিজাব আইন পরিবর্তনের জন্য কাজ করছে বিচার বিভাগ। বিলুপ্ত করা হচ্ছে নীতি পুলিশও। যেসব বিষয় নিয়ে ইরানে বিক্ষোভ শুরু হয়, তার মধ্যে এ দুটি ছিল অন্যতম। তবে তাঁর এ মন্তব্য নিয়ে নানা আলোচনা শুরু হয়েছে। বিচার বিভাগের এসব বিষয় দেখার অধিকার আছে কি না, তা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন।
ইরানের ‘নীতি পুলিশ’ মূলত ফারসি ‘গাতে-ই এরাদ’ বা ‘গাইডেনস প্যাট্রল’ নামে পরিচিত। তাদের কাজ হলো ইরানের পোশাকবিধি অমান্যকারী ব্যক্তিদের আটক করে ব্যবস্থা নেওয়া। নীতি পুলিশ ইরানের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত, যা ২০০৬ সালে কাজ শুরু করে। ইরানের শীর্ষ ধর্মীয় কর্তৃপক্ষের ঠিক করা ইসলামি নীতিনৈতিকতা মানুষ মানছে কি না, তা তারা নজরদারি করে থাকে।
ইরানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আহমাদ ভাহিদি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করতে অভ্যন্তরীণ ‘ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিশন’ গঠন করেছেন তাঁরা। তবে এই কমিশনে যেসব রাজনৈতিক দল ও ছাত্র প্রতিনিধি রাখা হয়েছিল, তাঁরা যোগ দেননি। ইউরোপের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক মনে করেন, পরিস্থিতি এমন এক অপরিবর্তনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে, যেখান থেকে সহজে ইরানের নেতৃত্ব ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
কূটনীতিকেরা আরও মনে করছেন, রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে ইরানের মধ্যে অভ্যন্তরীণ বিতর্কও বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে ইরান দেশের অভ্যন্তরীণ ও বাইরের চাপ সামলে কতটা এগোতে পারবে, তা সময়ই বলে দেবে।
দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে মিন্টু হোসেন