পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্ক কেন খারাপ হচ্ছে

পাকিস্তান সেনাপ্রধান আসিম মুনির।
ছবি: এএফপি

তালেবান আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হওয়ার দুই বছর পার হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন বিদেশি সেনারা আফগানিস্তান ছাড়ার মধ্য দিয়ে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট তালেবান কাবুলের দখল নেয়। কিন্ত এই দুই বছরে দীর্ঘদিনের মিত্র ও প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানের সম্পর্কের ক্রমে অবনতি হয়েছে। বর্তমানে তা গিয়ে ঠেকেছে তলানিতে।

আফগানিস্তান সীমান্তবর্তী পাকিস্তানের আদিবাসী–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোয় একের পর এক প্রাণঘাতী হামলার জন্য কাবুলকে দায়ী করে আসছে ইসলামাবাদ। সর্বশেষ এ ধরনের হামলা হয়েছে গত জুলাইয়ে পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের বাজাউর জেলায়।

এ হামলায় ৫৪ জনের প্রাণহানি হয়। ওই হামলার দায় স্বীকার করেছিল জঙ্গি গোষ্ঠী আইএসের আফগানিস্তান শাখা ইসলামিক স্টেট ইন খোরাসান প্রভিনস, সংক্ষেপে যা আইএসকেপি নামে পরিচিত।

আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করে এ রকম হামলা ২০২০ সালে তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত দোহা শান্তি চুক্তিরও লঙ্ঘন।
আসিম মুনির, পাকিস্তান সেনাপ্রধান
তালেবান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ
ছবি: রয়টার্স

পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তাদের অভিযোগ, সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো এভাবে পাকিস্তানে হামলা চালাচ্ছে। কিন্তু এসব গোষ্ঠীর তৎপরতা বন্ধে যথাসাধ্য চেষ্টা করছে না আফগানিস্তানের শাসকগোষ্ঠী তালেবান।

বাজাউর জেলায় এক রাজনৈতিক সমাবেশে হামলার ওই ঘটনার পর পাকিস্তানের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিলাওয়াল ভুট্টো জারদারি বলেছিলেন, ‘আত্মরক্ষায় আমরা আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পদক্ষেপ নেব। যদি আফগানিস্তানের শাসকেরা কোনো পদক্ষেপ না নেয়, সে ক্ষেত্রে অভ্যন্তরীণ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। তবে প্রথমেই তা করব না।’

পাকিস্তানের ভূখণ্ডে একের পর এক হামলার জন্য ‘আফগান নাগরিকদের জড়িত থাকার’ নিন্দা জানিয়েছেন পাকিস্তান সেনাপ্রধান জেনারেল সৈয়দ আসিম মুনিরও। বাজাউরে হামলার এক সপ্তাহ পর তিনি বলেছিলেন, ‘এটা আঞ্চলিক শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর।’

পাকিস্তান সেনাপ্রধান আসিম মুনির বলেছিলেন, আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করে এ রকম হামলা ২০২০ সালে তালেবান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে স্বাক্ষরিত দোহা শান্তি চুক্তিরও লঙ্ঘন। চুক্তি অনুযায়ী, তালেবান আফগানিস্তানে কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীর কার্যক্রম পরিচালনা করতে না দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল।

পাকিস্তানে হামলা ঠেকানো কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের দায়িত্বও নয়।
জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ, তালেবান মুখপাত্র

পাল্টাপাল্টি দোষারোপ

আফগানিস্তানে তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর পাকিস্তান সীমান্ত এলাকায় টিটিপি আবার শক্তিশালী হয়ে ওঠে
ফাইল ছবি: এএফপি

বাজাউরে রাজনৈতিক সমাবেশে ওই বোমা হামলার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছিল তালেবান। আর পাকিস্তান যেসব অভিযোগ করে আসছে, সেগুলো অবশ্য বরাবরের মতো অস্বীকার করে আসছে তালেবান।

গত সপ্তাহে প্রথমবারের মতো এ নিয়ে প্রকাশ্যে একটি বিবৃতি দেয় তালেবান কর্তৃপক্ষ। তালেবান প্রশাসনের প্রধান মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ ওই বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘পাকিস্তানে সাম্প্রতিক নিরাপত্তাসংক্রান্ত ঘটনার জন্য দেশটির কর্মকর্তারা নিজেদের দেশের নিরাপত্তা জোরদার না করে আবারও এ জন্য আফগানদের দোষারোপ করছেন।’

জাবিহুল্লাহ বলেন, ‘এ অঞ্চলের কোনো দেশের নিরাপত্তাজনিত ব্যর্থতার জন্য তালেবান কর্তৃপক্ষকে দায়ী করা উচিত নয়। আফগানিস্তানে কোনো হামলার জন্য তালেবান কর্তৃপক্ষ পাকিস্তানকে দায়ী করার বদলে তার ভূখণ্ডের নিরাপত্তা জোরদারের পদক্ষেপ নিয়েছে।’

জাবিহুল্লাহ বিবৃতিতে আরও বলেন, ‘ইসলামিক আমিরাত অব আফগানিস্তান আবারও জোর দিয়ে এ কথা বলতে চায়, আমরা পাকিস্তানে হামলার পক্ষে নই এবং পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হামলা চালাতে আফগানিস্তানের ভূখণ্ড ব্যবহার করতে আমরা কখনোই দিব না। আর পাকিস্তানে হামলা ঠেকানো কিংবা নিয়ন্ত্রণ করা আমাদের দায়িত্বও নয়।’

আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় কর্মকর্তাদের এমন ‘বাগ্‌যুদ্ধ’ দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের যে ক্রমে অবনতি হচ্ছে, তার প্রমাণ দিচ্ছে।

সংকটের মূলে টিটিপি

খাইবার পাখতুনখাওয়ার বাজাউরে গত ৩১ জুলাই বোমা হামলায় ৫৪ জন নিহত হয়। এ হামলায় টিটিপি জড়িত বলে ধারণা করা হয়
ছবি: এএফপি

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, শুধু পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে এ বছর তিন শতাধিক হামলার ঘটনা ঘটেছে। সিংহভাগ হামলার দায়ই স্বীকার করেছে পাকিস্তানের সশস্ত্র গোষ্ঠী তেহরিক–ই–তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি)। পাকিস্তান সরকার এই টিটিপিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।

মতাদর্শিকভাবে তালেবানের সঙ্গে অনেক মিল থাকায় ২০০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত টিটিপি ‘পাকিস্তানি তালেবান’ হিসেবেই সমধিক পরিচিত। তবে মতাদর্শগত মিল থাকলেও টিটিপি পৃথকভাবে তাদের তৎপরতা চালায়।

টিটিপির দাবিগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—ইসলামি শরিয়াহ আইনে দেশ পরিচালনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তার সদস্যদের মুক্তি এবং খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে সামরিক উপস্থিতি কমানো।

সম্পর্কে ক্রমে বাড়তে থাকা এই উত্তেজনা কমাতে আলোচনার জন্য গত ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল কাবুল সফরে যায়। এরপর গত মে মাসে ইসলামাবাদ সফর করেন আফগান পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমির খান মুত্তাকি।

কিন্তু দুই দেশের সরকারের পক্ষ থেকে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলের এমন সফর সহিংসতা তো কমাতে পারেইনি, বরং তা আরও বেড়ে গেছে। শুধু গত জুলাইয়ে পাকিস্তানে ৯০টির বেশি হামলা করেছে টিটিপি।

ভবিষ্যৎ কী

পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল সাদ মুহাম্মদ আফগানিস্তানে পাকিস্তান দূতাবাসের প্রতিরক্ষাপ্রধান ছিলেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে যেসব হামলার ঘটনা ঘটেছে, তার ৯০ শতাংশের বেশি হামলায় টিটিপি জড়িত।

তালেবান বারবার এসব হামলায় তাদের ভূমিকার কথা অস্বীকার করে এলেও সাবেক সেনা কর্মকর্তা সাদ বলছেন, অদূর ভবিষ্যতে দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির কোনো সম্ভাবনা দেখেন না তিনি। কারণ হিসেবে তিনি পাল্টাপাল্টি দোষারোপের কথা বলেন।

ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল সাদ মুহাম্মদ বলেন, বর্তমান যে পরিস্থিতি, তাতে করে দুই দেশ স্বাভাবিক সম্পর্ক রাখার আশা করতে পারে, এর বেশি কিছু নয়।

সন্ত্রাসবাদ নির্মূলবিষয়ক একজন বিশেষজ্ঞ আমিরা জাদুন। পাকিস্তান ও আফগানিস্তান বিষয়ে তাঁর জানাশোনা বেশি। তিনি বলেন, বাজাউরে ওই হামলা দুই দেশের মধ্যে চলমান এ উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে তুলবে।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্লেমসন ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক জাদুনের মতে, পাকিস্তানের প্রত্যাশা ছিল, তালেবান সরকার টিটিপির বিরুদ্ধে বড় ধরনের পদক্ষেপ নেবে। কিন্ত তালেবান প্রত্যাশিত সেই পদক্ষেপ নেয়নি।

আমিরা জাদুন বলেন, পাকিস্তানের আদিবাসী–অধ্যুষিত সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোয় আইএসকেপি তাদের অবস্থান সংহত ও শক্তি অর্জন অব্যাহত রেখেছে। আর আফগানিস্তানে তাদের তৎপরতা কমে এসেছে। এতে স্পষ্ট, পাকিস্তানবিরোধীরা আফগানিস্তানে আশ্রয় পেতে পারে।

আমিরা জাদুন বলেন, তালেবানকে নিষ্ক্রিয় বা সীমাবদ্ধ, যে হিসেবেই দেখা হোক না কেন, তালেবানের প্রতি পাকিস্তানের হতাশা ক্রমে বাড়ছেই।

ইসলামাবাদভিত্তিক একজন গবেষক নিজাম সালারজাই। পাকিস্তানের আদিবাসী–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে অস্থিতিশীলতা ও অস্থিরতা নিয়ে কাজ করেন তিনি। নিজাম সালারজাই বলেন, সন্ত্রাসবাদ নির্মূলের অবস্থান থেকে পাকিস্তানের জন্য বরাবরই সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো টিটিপি।