উত্তর কোরীয় নেতাকে উসকানি দিতে ড্রোন পাঠিয়েছেন দক্ষিণের সাবেক প্রেসিডেন্ট: সিউলের প্রসিকিউটর
দক্ষিণ কোরিয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট নাকি গোপনে ড্রোন পাঠিয়ে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং–উনকে উত্ত্যক্ত করতে চেয়েছিলেন। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রসিকিউটররা এমন অভিযোগের নতুন তথ্য প্রকাশ করেছেন। তাঁরা বলছেন, পরবর্তী সময় সেনাশাসন (মার্শাল ল) জারি করার পথ তৈরি করার অংশ হিসেবে এই পরিকল্পনা করা হয়েছিল।
সেনাবাহিনীর একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার ফোন থেকে পাওয়া কয়েকটি মেমোতে দেখা গেছে, সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইয়ল এবং দুই জ্যেষ্ঠ সামরিক কর্মকর্তা এমনভাবে কিমকে উসকে দিতে চেয়েছিলেন, যাতে উত্তর কোরিয়া সামরিক প্রতিক্রিয়া জানায়। আর সেটাকেই অজুহাত করে যাতে ইউন জরুরিভিত্তিতে সামরিক শাসন জারি করতে পারেন।
প্রসিকিউটররা গত সোমবার এসব প্রমাণ তুলে ধরে বলেছেন, গত বছরের অক্টোবরে দক্ষিণ কোরিয়া গোপনে ড্রোন পাঠিয়ে দেশটির ভেতরে সরকারবিরোধী প্রচারপত্র ফেলেছিল বলে উত্তর কোরিয়ার যে অভিযোগ করেছে, সেটি সত্য হতে পারে। এর পরপরই কিমের বোন কিম ইয়ো জং তীব্র ভাষায় দক্ষিণ কোরিয়ার নিন্দা জানিয়েছিলেন।
এ ঘটনার পর উত্তর কোরিয়া দক্ষিণের সঙ্গে সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার হুমকি দেয় এবং নিজেদের ভেতরে দুটি রাস্তা উড়িয়ে দেয়। তবে তারা সামরিক হামলা চালায়নি। কয়েক সপ্তাহ পর ইউন মার্শাল ল জারি করেন। তিনি দাবি করেন, দক্ষিণ কোরিয়া ‘উত্তর কোরিয়ার কমিউনিস্ট শাসনের’ হুমকির মধ্যে আছে।
দক্ষিণ কোরয়ার সাবেক প্রেসিডেন্ট ইউনের এই আকস্মিক নির্দেশ কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই পার্লামেন্ট বাতিল করে দেয়। সেনাবাহিনীর সদস্যরা পার্লামেন্টে ঢোকার চেষ্টা করলেও এমপিরা তাঁদের সরিয়ে ভেতরে ঢুকে ভোটাভুটি করে আইনটি বাতিল করে দেন। এর পর থেকেই ইউন আদালতে নানা মামলার মুখোমুখি।
ইউন অবশ্য সব অভিযোগ অস্বীকার করছেন। তাঁর আইনজীবীরা বলছেন, অভিযোগ ‘একপক্ষীয়’ এবং ‘আইনগতভাবে ভিত্তিহীন’।
কিন্তু তদন্তকারীরা যেসব নোট প্রকাশ করেছেন তাতে দেখা যায়, উত্তর কোরিয়াকে এমনভাবে অপমান করতে চাওয়া হয়েছিল, যাতে তারা প্রতিক্রিয়া জানাতে বাধ্য হয়। নোটে রাজধানী পিয়ংইয়ং, পারমাণবিক স্থাপনা, কিমের ছুটির বাড়ি, সামজিয়ন ও ওয়ানসানের মতো জায়গা লক্ষ্যবস্তু হিসেবে উল্লেখ ছিল।
সামজিয়ন হচ্ছে কিম জং ইলের জন্মস্থান, যা উত্তর কোরিয়ায় খুবই পবিত্র বলে গণ্য করা হয়। ওয়ানসান হলো কিম জং–উনের বড় এক পর্যটন প্রকল্প, যাকে তিনি ‘বড় সাফল্য’ বলেছিলেন।
একটি নোটে লেখা ছিল—‘কমপক্ষে জাতীয় নিরাপত্তা সংকট, আর বেশি হলে নোয়ার বন্যার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে হবে।’ আরেক নোটে বলা হয়েছিল—‘শত্রুর (উত্তর কোরিয়ার) কোনো না কোনো পদক্ষেপ আগে হওয়া চাই…সেই সুযোগ তৈরি করতে হবে।’
একজন প্রসিকিউটর বলেন, এসব আলোচনা ২০২৩ সালের অক্টোবরের দিকে শুরু হয়েছিল, যখন দক্ষিণ কোরিয়ার সামরিক বাহিনীতে বড় রদবদল হয়।
ওই প্রসিকিউটর বলেন, একজন প্রেসিডেন্ট ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী দক্ষিণ-উত্তর উত্তেজনাকে কাজে লাগিয়ে রাজনৈতিক লক্ষ্য পূরণে যদি সামরিক শাসন জারি করতে চান, সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
বর্তমানে পার্লামেন্ট সদস্য (এসপি) এমন একজন অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা বলেন, ড্রোন দেখার পরও উত্তর কোরিয়ার তরফ থেকে সামরিক প্রতিক্রিয়া না আসা ছিল দক্ষিণ কোরিয়ার জন্য সৌভাগ্য। তারা যদি তখন গুলি করত বা আক্রমণ করত, বড় ধরনের সংঘর্ষ শুরু হতে পারত।
ওই সেনা কর্মকর্তা বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য রাশিয়ায় ১০ হাজারের বেশি সৈন্য পাঠানোয় হয়তো উত্তর কোরিয়ার একসঙ্গে দুই দিকের যুদ্ধ করার সক্ষমতা কমে গিয়েছিল। এ কারণে তারা সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখায়নি।
ইউনের মার্শাল ল ও বিশৃঙ্খলা
ইউন ও তাঁর দুই সাবেক প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা রাষ্ট্রের ক্ষতি, ক্ষমতার অপব্যবহার ও শত্রুকে সাহায্য করার অভিযোগে এখন বিচারের মুখোমুখি। মার্শাল ল ঘোষণার জন্য তারা এরই মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলায় অভিযুক্ত।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর রাতে ইউন টেলিভিশনে এসে মার্শাল ল জারি করেন। তিনি বলেন, সরকারের ভেতরে ‘উত্তর কোরিয়াপন্থী’ শক্তি আছে।
সেনারা হেলিকপ্টারে করে পার্লামেন্ট ভবন এলাকায় নেমে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করে। সাধারণ নাগরিক ও পার্লামেন্টের কর্মীরা দরজা আটকে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। টিভিতে বিশৃঙ্খলার দৃশ্য সরাসরি দেখানো হয়।
পার্লামেন্ট সদস্যরা শেষ পর্যন্ত ভেতরে গিয়ে ভোটের আয়োজন করে আইনটি বাতিল করে দেন। দেশজুড়ে বড় বিক্ষোভ হয় এবং শেষ পর্যন্ত ইউনকে অভিশংসনের মাধ্যমে সরিয়ে দেওয়া হয়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, উত্তর কোরিয়ার ভেতরে ড্রোন পাঠানো সরাসরি যুদ্ধঘোষণার মতো, যা দ্রুত বড় সংঘাতে রূপ নিতে পারত।
যুক্তরাষ্ট্রের জন্যও এর আন্তর্জাতিক প্রভাব বড় হতো। কারণ, তারা দক্ষিণ কোরিয়ার মূল মিত্র এবং সেখানে তাদের হাজার হাজার সেনা আছে।
ড্রোন পাঠানো হলে ১৯৫৩ সালের যুদ্ধবিরতি চুক্তিও লঙ্ঘিত হতো।
এক বিশেষজ্ঞ বলেন, উত্তর কোরিয়া নিয়মিত চুক্তি লঙ্ঘন করে। কিন্তু তাদের দেশে কেউ প্রশ্ন তোলে না। দক্ষিণ কোরিয়ার মতো গণতন্ত্রে এসব কর্মকাণ্ডের রাজনৈতিক দায় থাকে।