ভারত সফরে যাচ্ছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী

জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা
ফাইল ছবি: রয়টার্স

তিন দিনের সফরে আগামীকাল রোববার ভারত যাচ্ছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদা। সোমবার ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক করার কথা রয়েছে তাঁর। দ্বিপক্ষীয় অর্থনৈতিক সহযোগিতার বাইরে ইউক্রেন যুদ্ধ এবং এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলজুড়ে চীনের ক্রমেই আরও বেশি আত্মপ্রত্যয়ী হয়ে ওঠা মনোভাব নিয়ে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে আলোচনা করার কথা।

জাপান এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর আখ্যায়িত না করে ভারত-প্রশান্ত মহাসাগর বলতে অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। সেই অঞ্চলজুড়ে মুক্ত ও অবাধ সমুদ্র চলাচল নিশ্চিত করে নেওয়ার ধারণা এগিয়ে নিতে জাপান সরকার আগ্রহী। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করে নিতে চাইছে জাপান। আগামী মে মাসের শেষ দিকে জাপানের হিরোশিমা শহরে শিল্পোন্নত দেশগুলোর জোট জি–৭ শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। স্বাগতিক দেশ হিসেবে জাপান বিশ্বজুড়ে জোটের স্বার্থ এগিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টায় সাফল্য নিশ্চিত করে নিতে চাইছে। তাই ইউক্রেন যুদ্ধ এবং চীনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা, উভয় দিক থেকেই কিছুটা হলেও ভারতের সমর্থন জাপানের প্রয়োজন। কারণ, ভারত এ বছর বৃহৎ অর্থনীতির দেশের জোট জি-২০–এর সভাপতি দেশ। ফলে নয়াদিল্লিতে অবস্থানকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে জি-৭ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে কিশিদা আমন্ত্রণ জানাবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। কিশিদার আসন্ন ভারত সফরকে তাই এ রকম বেশ কয়েকটি লক্ষ্য অর্জনে জাপানের চালিয়ে যাওয়া প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে দেখা যেতে পারে।

কিশিদা ও মোদি দুজনেই নিজ নিজ দেশের কাছাকাছি এলাকায় চীনের চালানো তৎপরতা নিয়ে উদ্বিগ্ন। এর বাইরে অঞ্চলের বিস্তৃত এলাকাজুড়ে চীনের প্রভাব সম্প্রসারিত হতে থাকাকেও উভয় দেশের নেতৃত্ব সন্দেহের চোখে দেখছে। ফলে ভারত সফরে চীনকে সামাল দেওয়ার লক্ষ্যে চালিত কোয়াড নামে পরিচিত চারটি দেশের অনানুষ্ঠানিক কাঠামো আরও সংহত করে নেওয়ার ধারণায় কিছুটা হলেও ভারতের সমর্থন কিশিদা লাভ করতে পারবেন বলে জাপানের বিশ্লেষকেরা মনে করছেন।

তবে এ ব্যাপারে ভারতের পক্ষ থেকে সীমিত সংযম প্রদর্শন লক্ষ করা যেতে পারে। ভারত ও চীনের মধ্যে বিরাজমান উত্তেজনা শেষ না হলেও আগের সেই সীমান্ত সংঘাত কিছুটা হলেও স্তিমিত হয়ে এসেছে। এর বদলে দুই দেশে যা চলছে তা হচ্ছে পরোক্ষ প্রস্তুতি, সামরিক মহড়া চালানো এবং বহুপক্ষীয় মহড়ায় অংশগ্রহণ। ফলে আপাত এই স্থিতি অবস্থা বজায় রেখে চীনের সঙ্গে পরোক্ষ যোগাযোগ ধরে রাখতে নিজের স্বার্থেই হয়তো ভারত আগ্রহী হবে। আর এ কারণেই তাইওয়ানকে ঘিরে দেখা দেওয়া উত্তেজনা আরও বিস্তৃত হওয়াও নয়াদিল্লি সম্ভবত কামনা করবে না।

অন্যদিকে অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি কোয়াডের সবচেয়ে কট্টর অংশীদার জাপান। যদিও বেইজিংয়ের সঙ্গে সংলাপ অব্যাহত রাখার বিষয়টি নিজের অর্থনৈতিক স্বার্থের কারণেই টোকিওকে গভীরভাবে ভেবে দেখতে হয়। ফলে ভারত-জাপান শীর্ষ বৈঠকে চীন প্রসঙ্গে দুই দেশ উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ জানাবে, তা মনে করে নেওয়া সম্ভবত ঠিক হবে না।

ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ভারত–জাপান অনেক বেশি পরস্পরবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করতে পারে। রাশিয়াকে শায়েস্তা করতে পারার গভীর আগ্রহ নিয়ে যেসব দেশ মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের সঙ্গে এককাট্টা, জাপান সেই তালিকার শীর্ষে অবস্থানরত দেশগুলোর অন্যতম। রাশিয়ার বিরুদ্ধে একের পর এক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেই জাপান বসে নেই। একই সঙ্গে নিষেধাজ্ঞার বিস্তৃতি আরও বাড়িয়ে নিতেও আগ্রহী টোকিও। তবে জাপানের নিষেধাজ্ঞা রাশিয়ার যতটা ক্ষতি করতে পেরেছে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতির হিসাব সম্ভবত নিজেকেই করে নিতে হচ্ছে জাপানকে। জাপানের বৈদেশিক বাণিজ্য সংগঠন জেট্রোর সাম্প্রতিক এক জরিপের ফলাফলে জানা গেছে, ৪০ শতাংশের কিছু কম জাপানি কোম্পানি রাশিয়া থেকে নিজেদের পুরোপুরি গুটিয়ে নেয়নি। অর্থাৎ নিষেধাজ্ঞার কথা বারবার উল্লেখ করা হলেও, নিজের বাণিজ্যিক স্বার্থের কারণেই পেছনের দুয়ার কিছুটা হলেও জাপান খোলা রেখেছে। তবে বাহ্যিক দিক থেকে নিজের কট্টর অবস্থান আরও দৃঢ় করে নেওয়ার প্রকাশ তুলে ধরাও বজায় রাখছে টোকিও।

এদিকে ইউক্রেন প্রশ্নে ভারতের অবস্থান জাপানের বিপরীত। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালানোর জন্য রাশিয়ার সমালোচনায় পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে হাত মেলায়নি ভারত। কেবল তা–ই নয়, রাশিয়া থেকে জ্বালানি ও অন্যান্য আমদানি আরও বাড়িয়েছে নয়াদিল্লি। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্র আয়োজিত আঞ্চলিক কয়েকটি সামরিক মহড়ায় ভারত যোগ দিলেও রাশিয়ার সঙ্গে সামরিক যোগাযোগও বজায় রেখে চলেছে নয়াদিল্লি। ফলে ইউক্রেন প্রশ্নে নরেন্দ্র মোদিকে দলে ভেড়াতে কিশিদা কতটা সক্ষম হবেন, সেই প্রশ্নে সন্দেহ থেকেই যায়।

আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিল এসব হিসাবের বাইরে জাপানের বিনিয়োগ ভারতে আরও সম্প্রসারিত করে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি কিশিদা নিশ্চিতভাবেই দেবেন। কেননা, জাপানের নেতৃত্ব ভারতে দেশের বিনিয়োগকে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের বিপরীতে নিজস্ব পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে দেখে থাকে।

আরও পড়ুন