উড়ন্ত গাড়ি, স্মার্ট বিছানা, রোবট মানব-কৃত্রিম দ্বীপে প্রদর্শনীতে এক অনন্য আগামীর হদিস

ওসাকা এক্সপোর গ্র্যান্ড রিংছবি: ওসাকা এক্সপোর তত্ত্বাবধানকারী জাপান অ্যাসোসিয়েশনের সৌজন্যে

ব্যাপক আয়োজন ও অংশগ্রহণ শেষে সব ধরনের আশঙ্কা ও উৎকণ্ঠাকে পেছনে ফেলে সফলভাবে শেষ হলো জমজমাট বৈশ্বিক প্রদর্শনী ‘ওসাকা এক্সপো ২০২৫’। বিশ্বজুড়ে নানা স্থানে চলমান বৈরিতা ও সংঘাতের মধ্যে ছয় মাস ধরে ভিন্ন এক জগতের দেখা মিলেছিল জাপানের কানসাই অঞ্চলের ওসাকায় নির্মিত কৃত্রিম ইউমেশিমা দ্বীপে। ১৫৮টি দেশ ও ভূখণ্ডের প্রতিনিধিরা নিজ নিজ প্যাভিলিয়নে সেখানে অবস্থান করেছিলেন পাশাপাশি। ছিল জাতিসংঘ ও রেডক্রসের মতো আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলোও।

মেলার মাস্কট মিয়াকু মিয়াকুর ধন্যবাদ জ্ঞাপন
ছবি: ওসাকা এক্সপোর তত্ত্বাবধানকারী জাপান অ্যাসোসিয়েশনের সৌজন্যে

এ সময় চলেছে জাপানকে কেন্দ্রে রেখে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় কূটনীতি, হয়েছে নানামুখী বাণিজ্যের প্রসার। সেখানে বিশ্বের ক্ষুদ্র থেকে বৃহৎ দেশগুলো নিজ নিজ সামর্থ্য অনুযায়ী নিজেদের সংস্কৃতি, সাফল্য ও আগামীর পরিকল্পনা তুলে ধরেছে। আর এসব কিছুর কেন্দ্রেই ছিল সংঘাতমুক্ত, পরিবেশবান্ধব ও ঐশ্বর্যময় এক পৃথিবীর স্বপ্ন, ছিল বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নতিকে মানবকল্যাণে কাজে লাগানোর যৌথ প্রতিশ্রুতি। বাংলাদেশ, ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব, সুইডেনসহ প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী বেশির ভাগ দেশেরই সরকারপ্রধান থেকে শুরু করে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা এ সময় জাপান সফর করেছেন এবং এই এক্সপোর আঙিনায় পা রেখেছেন।

সমাপনী অনুষ্ঠানে নান্দনিক পরিবেশনা
ছবি: ওসাকা এক্সপোর তত্ত্বাবধানকারী জাপান অ্যাসোসিয়েশনের সৌজন্যে

গত ১৩ এপ্রিল থেকে চলা এই প্রদর্শনীর শুরুটা এত উজ্জ্বল ছিল না। উপস্থিতিও ছিল প্রত্যাশার চেয়ে অনেক কম। এর ফলে কয়েক বছর ধরে সাগরের বুকে কৃত্রিম দ্বীপসহ প্রদর্শনীস্থলের বিশাল অবকাঠামো নির্মাণে অতিরিক্ত ব্যয় আয়োজকদের পাশাপাশি জাপানের জনগণের মধ্যেও উৎকণ্ঠা ছড়িয়েছিল। এই উৎকণ্ঠার পেছনে করোনা মহামারির সীমাবদ্ধতার মধ্যে বিপুল ব্যয়ে আয়োজিত টোকিও অলিম্পিক থেকে সৃষ্ট আর্থিক বোঝাও ভূমিকা রেখেছে। তবে সেই উৎকণ্ঠার মেঘ ধীরে ধীরে কাটতে শুরু করে এবং মেলা প্রাঙ্গণ ক্রমেই পরিণত হয় জনসমুদ্রে। শেষের দিকে এসে টিকিট পাওয়া দুষ্কর হয়ে ওঠে এবং মেলায় প্রবেশের জন্য প্রায় দুই ঘণ্টা লাইনে দাঁড়ানোর অভিজ্ঞতাও হয়েছে লোকজনের। বিভিন্ন প্যাভিলিয়নে প্রবেশে লেগেছে আরও বেশি সময়।

বক্তব্য দিচ্ছেন জাপান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ২০২৫ ওয়ার্ল্ড এক্সপোজিশনের চেয়ারপারসন তোকুরা মাসাইয়ুকি
ছবি: ওসাকা এক্সপোর তত্ত্বাবধানকারী জাপান অ্যাসোসিয়েশনের সৌজন্যে

প্রতিদিন প্রায় দুই লাখের বেশি মানুষ এই এক্সপোতে এসেছেন। ৭ অক্টোবর পর্যন্ত হিসাব অনুযায়ী, এক্সপোতে মোট দর্শনার্থীর উপস্থিতি ২ কোটি ৭০ লাখ এবং টিকিট বিক্রি ২ কোটি ২০ লাখ ছাড়িয়ে যায়। এ ছাড়া পণ্যের বিক্রিও পূর্বাভাসের থেকে বেশি হয়েছে। টিকিট বিক্রি, পণ্য, খাদ্য ও পানীয় থেকে হওয়া বড় অঙ্কের রাজস্ব এবং কার্যকরভাবে খরচ হ্রাসের মাধ্যমে প্রায় ২৩ থেকে ২৮ বিলিয়ন জাপানি ইয়েন বা প্রায় ১৫০ থেকে ১৮৫ মিলিয়ন ডলার পর্যন্ত উদ্বৃত্ত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। এই উদ্বৃত্ত হলে তা ১৯৭০ সালের ওসাকা এক্সপোর চেয়ে বেশি এবং ২০০৫ সালে মধ্য জাপানের আইচিতে অনুষ্ঠিত এক্সপোর উদ্বৃত্তকেও ছাড়িয়ে যাবে। সোমবার সন্ধ্যায় সমাপনী সংবাদ সম্মেলনে এক্সপোর আয়োজক সমিতি ‘জাপান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য ২০২৫ ওয়ার্ল্ড এক্সপোজিশন’-এর চেয়ারপারসন তোকুরা মাসাইয়ুকি ও সেক্রেটারি জেনারেল ইশিগে হিরোইয়ুকি এই সাফল্যের পেছনে তিনটি কারণ তুলে ধরেছেন। প্রথমত, বড় ধরনের কোনো দুর্যোগ না হওয়া, দর্শনার্থীদের সুবিধা বাড়ানোর জন্য প্রতিনিয়ত কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া এবং মেলায় প্রদর্শিত অতুলনীয় সব পণ্য কিংবা ধারণা।

সমাপনী অনুষ্ঠানের জাঁকজমক পরিবেশনা
ছবি: ওসাকা এক্সপোর তত্ত্বাবধানকারী জাপান অ্যাসোসিয়েশনের সৌজন্যে

‘আমাদের জীবনের জন্য ভবিষ্যতের সমাজ গঠন’ প্রতিপাদ্য নিয়ে আয়োজিত এবারের এক্সপোর মূল আকর্ষণ ছিল পরিবেশবান্ধব উপাদান দিয়ে তৈরি প্যাভিলিয়নগুলোর নান্দনিক স্থাপত্যশৈলী। বিশ্বের ছোট থেকে বড় দেশগুলো নিজেদের সংস্কৃতি এবং অন্যান্য অর্জনকে তুলে ধরার বিশাল সুযোগ ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছে। বিপুল ব্যয়ে ধনী দেশগুলো নির্মাণ করেছে চোখজুড়ানো সব প্যাভিলয়ন। ভার্চ্যুয়াল রিয়েলিটি, ডিজিটাল ম্যাপিংসহ অত্যাধুনিক নানা প্রযুক্তি ব্যবহার করে যেখানে উপস্থাপিত হয়েছে নান্দনিক সব প্রদর্শনী। যেমন বেলজিয়াম প্রদর্শন করেছে চিকিৎসা খাতে তাদের সাফল্যের কথা, অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র দিয়েছে মহাকাশ যাত্রার অনুভূতি। আবার ফ্রান্সের প্যাভিলিয়নে ছিল শিল্প ও ফ্যাশনের মিথস্ক্রিয়া।

সমাপনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবা
ছবি: ওসাকা এক্সপোর তত্ত্বাবধানকারী জাপান অ্যাসোসিয়েশনের সৌজন্যে

চক্রাকার জীবনযাত্রার ওপর জোর দেওয়া জাপানের নিজস্ব গ্যালারিসহ এতে উপস্থিত ছিল প্যানাসনিকসহ জাপানের বিভিন্ন কোম্পানির প্যাভিলিয়ন। ছিল বিভিন্ন থিমের আটটি সিগনেচার প্যাভিলয়ন, উড়ন্ত গাড়ি, ভবিষ্যতের স্মার্ট বিছানা, কৃত্রিম হৃৎপিণ্ড কিংবা রোবট মানবসহ বিজ্ঞানের অভিনব সব আবিষ্কার, যার মধ্য দিয়ে অনন্য এক আগামীর হদিস দেওয়া হয়। আর এই প্যাভিলিয়নগুলোকে ঘিরে রেখেছিল প্রায় ২৩ কোটি ডলার ব্যয়ে নির্মিত ‘গ্র্যান্ড রিং’ বা বিশালাকারের এক কাঠের বেষ্টনী। প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে থাকা এই স্থাপনা বিশ্বের বৃহত্তম কাঠের নির্মিত কাঠামো হিসেবে গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ডসের স্বীকৃতি পেয়েছে।

বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের সামনে মানুষের সারি
ছবি: প্রথম আলো

বাংলাদেশের প্যাভিলিয়ন

বৈশ্বিক এই আয়োজনে বাংলাদেশেরও ছিল নিজস্ব প্যাভিলিয়ন, যাতে প্রদর্শিত হয়েছে বিভিন্ন পণ্য, সমৃদ্ধ প্রকৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। প্যাভিলিয়নে প্রদর্শনীর শিরোনাম ছিল ‘সংযোগকারী জীবন: ঐতিহ্য ও উদ্ভাবনের এক সিম্ফনি’। নকশিকাঁথা, জামদানি, মসলিন, পাট ও চামড়াজাত পণ্য, পোশাকশিল্প, ওষুধশিল্প ও বিভিন্ন কৃষিপণ্যের সমাহার যেখানে ছিল। এর পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির মতো তারুণ্যনির্ভর বিভিন্ন খাতের ক্রমবিকাশকেও তুলে ধরা হয়েছে সুন্দর ও পরিশীলিত উপস্থাপনার মধ্য দিয়ে। তুলনামূলকভাবে ছোট পরিসরে হলেও এক্সপোতে বাংলাদেশ প্যাভিলিয়নের উপস্থিতি অনেকেরই দৃষ্টি কেড়েছে। শেষের দিকে প্রতিদিন প্রায় ১০ হাজার দর্শনার্থী প্যাভিলিয়নে এসেছেন বলে জানিয়েছেন সেখানে উপস্থিত এক প্রতিনিধি। বৈশ্বিক এই মেলায় বাংলাদেশের একটি খাবারের দোকানও চোখে পড়েছে, টোকিওভিত্তিক কিং করপোরেশন পরিচালিত এই দোকান বিরিয়ানিসহ বিভিন্ন দেশি খাবারের পাশাপাশি বাংলাদেশের সংস্কৃতিকেও উপস্থাপন করেছে। তাদের উদ্যোগে প্রদর্শিত রিকশা ও পালকি দর্শনার্থীদের নজর কেড়েছে।

বাংলাদেশ প্যাভিলিয়ন দেখছেন দর্শকেরা
ছবি: প্রথম আলো

এদিকে ২০২৮ সালের ফেব্রুয়ারির মধ্যে পুরো প্রদর্শনীস্থল খালি করার লক্ষ্য ধরে নিয়েছে মেলার আয়োজক কর্তৃপক্ষ। ‘গ্র্যান্ড রিং’ নামক কাঠের বেষ্টনীটির ২০০ মিটারের মতো সংরক্ষণ করা হবে। অবশিষ্ট অংশটির উপকরণ পুনর্ব্যবহারের লক্ষ্যে ভেঙে ফেলা হবে। প্যাভিলিয়নগুলোর ক্ষেত্রেও তেমন চিন্তা করা হচ্ছে। মেলার সমাপনী উপলক্ষে সোমবার বিকেলে জাপানের যুবরাজ ও যুবরাজ্ঞী আকিশিনো এবং প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার উপস্থিতিতে জমজমাট এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে সব অংশগ্রহণকারী ও দর্শকদের ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পাশাপাশি পরবর্তী আয়োজক দেশ সৌদি আরবের কাছে এক্সপোর পতাকা হস্তান্তর করা হয়। এ ছাড়া প্রদর্শনীস্থলে আয়োজক দেশগুলোর পতাকা নিয়ে প্যারেড হয়।

পরবর্তী আয়োজক দেশ সৌদি আরবের কাছে পতাকা হস্তান্তর
ছবি: ওসাকা এক্সপোর তত্ত্বাবধানকারী জাপান অ্যাসোসিয়েশনের সৌজন্যে

এবারে এক্সপোতে শত বিভেদ পার করে জাতিতে জাতিতে বিভাজনহীন যে নতুন বিশ্বের দেখা দর্শকেরা পেয়েছেন, সেটি পরবর্তী প্রজন্মের কাছে ছড়িয়ে দেওয়াটাই সবচেয়ে বড় কাজ বলে মনে করছেন আয়োজকেরা। বিশ্ববাসী চাইলেই যে নিজেদের বিভেদ দূর করে ঐক্য ও সৌহার্দ্যের এক আধুনিক জগৎ গড়ে তুলতে পারে, ২০২৫ সালের ওসাকা কানসাই এক্সপো তারই সাক্ষ্য বহন করে যাবে আগামী দিনগুলোতে।