৪০ বছর বয়সী মারওয়া বার্তা সংস্থাকে বলেন, ‘সেই দিন (নির্দেশের দিন) আমি ও আমার মেয়েরা অনেক কেঁদেছিলাম। আমি নিজেকেই বলেছি, হে আল্লাহ, শয়তান আবার ফিরে এসেছে।’

তালেবান সরকার ইসলামের কঠোর ব্যাখ্যা মেনে চলে এবং নারীদের জীবনে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করেছে, যেটিকে জাতিসংঘ ‘লৈঙ্গিক বর্ণবাদ’ বলে অভিহিত করেছে।

আইনজীবীরা বলেছেন, তালেবান কমান্ডাররা বেশ কয়েক নারীর বিবাহবিচ্ছেদ বাতিল করার পর আবার তাঁদের সেই অপমানের সম্পর্কে ফিরে যেতে হয়েছে। তাঁদের একজন মারওয়া।

মারওয়া যখন স্বামীর কাছে ফিরে যান, তখনো তাঁর স্বামীর এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। কয়েক মাস ধরে মারওয়াকে পেটানো, ঘরবন্দী করে রাখা—কিছুই বাদ যায়নি। তাঁর হাত ও আঙুল ভেঙে দেওয়া হয়েছে।

মারওয়া বলেন, ‘এমনও দিন গেছে, আমার জ্ঞান থাকত না। আমার মেয়েরা আমাকে খাইয়ে দিত। তিনি (স্বামী) আমার চুলের মুঠি ধরে টানতেন। এতে আমার মাথার অনেক জায়গায় চুল ওঠে গেছে। তিনি আমাকে এতটাই মারতেন যে আমার সব দাঁত ভেঙে গিয়েছিল।’

একদিন সাহস সঞ্চয় করে দুই ছেলে ও ছয় মেয়েকে নিয়ে শত মাইল দূরে এক আত্মীয়ের বাসায় আশ্রয় নেন মারওয়া। তিনি যখন এএফপির সঙ্গে কথা বলছিলেন, তখন ফাঁকা বাড়ির মেঝেতে বসা। হাতে ছিল তসবি।

মারওয়া বলেন, ‘আমার সন্তানেরা বলে, মা আমরা ক্ষুধা নিয়ে ঘুমাতে যাই, ঠিক আছে। অন্তত নির্যাতন থেকে তো মুক্তি পেয়েছি। এখানে আমাদের কেউ চেনে না, এমনকি প্রতিবেশীরাও।’ তাঁর স্বামী আবার যদি তাঁকে খুঁজে পান, সেই ভয়ে আছেন তিনি।

ইসলাম বিচ্ছেদের অনুমতি দেয়

আফগানিস্তানে কর্মরত জাতিসংঘ মিশনের তথ্যমতে, দেশটিতে প্রতি ১০ নারীর মধ্যে ৯ জন স্বামীর হাতে শারীরিক, যৌন বা মানসিক নির্যাতনের শিকার।

এখনো সেখানে বিবাহবিচ্ছেদকে খারাপ চোখে দেখা হয়। এখানকার সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া নারীদের ‘ক্ষমার অযোগ্য’ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত সরকারের সময় আফগানিস্তানের কয়েকটি শহরে বিবাহবিচ্ছেদের হার অনেকটা বেড়ে গিয়েছিল। ওই সময়ও নারী অধিকার কেবল শিক্ষা ও কর্মস্থানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল।

নাজিফা নামের এক আইনজীবী বলেন, নারীরা একসময় তাঁদের সঙ্গে যা ঘটেছে, তার জন্য তাঁদের ভাগ্যকে দায়ী করতেন। এই আইনজীবী নির্যাতনের শিকার এমন ১০০ নারীর বিবাহবিচ্ছেদের মামলা সফলভাবে পরিচালনা করেছেন। কিন্তু তালেবানশাসিত আফগানিস্তানে এখন তাঁর আর কাজ করার অনুমতি নেই।

নাজিফা বলেন, যখন স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের বন্ধনটাই থাকে না, তখন ইসলামও সেই সম্পর্ক থেকে বিচ্ছেদের মাধ্যমে বেরিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেয়।

আগের সরকারের আমলে এ ধরনের মামলার শুনানির জন্য নারী বিচারক ও আইনজীবীদের নিয়ে বিশেষ পারিবারিক আদালত গড়ে তোলা হয়েছিল। কিন্তু তালেবান কর্তৃপক্ষ তাদের নতুন বিচারব্যবস্থাকে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সাজিয়েছে।

নাফিজা বলেন, তাঁর সাবেক পাঁচ মক্কেল জানিয়েছে, তাঁদের ভাগ্যও মারওয়ার মতোই।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে আরেক আইনজীবী বলেন, তিনি সম্প্রতি আদালতে দেখেছেন, জোর করে সাবেক স্বামীর কাছে পাঠানোর বিরোধিতা করে এক নারী লড়ে যাচ্ছেন। তালেবান শাসনে কেবল স্বামী মাদকাসক্ত বা দেশ ছেড়ে গেছেন, এমন হলেই বিচ্ছেদ ঘটানো যাবে। কিন্তু পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনায় বা স্বামী যদি বিচ্ছেদ না চান, তাহলে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দেওয়া হয় না।

নারীদের সমর্থনে দেশব্যাপী আশ্রয়কেন্দ্র ও পরিষেবার যে নেটওয়ার্ক ছিল, তা পুরোপুরি ভেঙে পড়েছে। এখন মহিলাবিষয়ক মন্ত্রণালয় ও মানবাধিকার কমিশন বলে কিছু রাখা হয়নি।

‘দরজায় টোকা পড়লে কেঁপে উঠি’

সানা (ছদ্মনাম) যখন বিয়ে করেন, তখন তাঁর বয়স ছিল ১৫ বছর। স্বামী ছিলেন তাঁর চেয়ে ১০ বছরের বড়। তিনি এখন আত্মগোপনে আছেন। সেখানে কথা হয় এএফপির সঙ্গে। চুলায় চা বানাতে বানাতে সানা বলেন, ‘যদি বাচ্চা কান্না করত বা রান্না ভালো না হতো, তাহলে তিনি আমাকে মারধর করতেন। তিনি সব সময় বলতেন, নারীদের কথা বলার কোনো অধিকার নেই।’

বিনা পয়সায় আইনি সহায়তাদানকারী একটি প্রকল্পের সহায়তায় সানা স্বামীর কাছ থেকে বিচ্ছেদ নেন। কিন্তু তালেবান আসায় তাঁর স্বস্তি আবার আতঙ্কে রূপ নেয়।

চার মেয়ের অভিভাবকত্ব হারানোর হুমকির ভয়ে সানা তাঁর সাবেক স্বামীর কাছে ফিরেছিলেন। কিন্তু তত দিনে স্বামী আরেকটি বিয়ে করেছেন। এরপর তাঁর স্বামী মেয়েদের বিয়ে তালেবান সদস্যদের সঙ্গে ঠিক করে।

সানা বলেন, ‘মেয়েরা আমাকে বলল, মা আমরা আত্মহত্যা করব।’ এ কথা শুনে সানা কিছু অর্থ নিয়ে এক আত্মীয়ের সহায়তায় সন্তানদের নিয়ে পালিয়ে যান। এখন তাঁরা এক কক্ষের একটি বাড়িতে থাকেন। সেখানে আসবাব বলতে কেবল একটি গ্যাস স্টোভ ও ঘুমানোর জন্য কয়েকটি বালিশ।

সানা বলেন, ‘দরজায় কেউ টোকা দিলেই আমি ভয়ে কেঁপে উঠি। মনে হয়, আমার স্বামী আমাদের দেখে ফেলেছেন। তিনি আমার বাচ্চাদের নিয়ে যেতে এসেছেন।’

শিশুদের জন্য অগ্নিপরীক্ষা

তালেবান এক কর্মকর্তা বলেন, বিবাহবিচ্ছেদ করা নারীদের তাঁদের সাবেক স্বামীদের কাছে ফিরে যেতে বাধ্য করা হয়েছে, এমন ঘটনা খতিয়ে দেখবে কর্তৃপক্ষ।

তালেবান সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র ইনায়েতুল্লাহ বলেন, এ ধরনের অভিযোগ পেলে শরিয়া আইন অনুযায়ী তদন্ত করে দেখা হয়।

তালেবান শাসনের আগের সরকারের আমলে হওয়া তালাককে স্বীকৃতি দেবে কি না, জানতে চাইলে ইনায়েতুল্লাহ বলেন, এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল বিষয়।

সুপ্রিম কোর্টের মুখপাত্র বলেন, ‘শরিয়া আইন মেনে বিচার করা আদালত দার আল-ইফতা এসব বিষয় খতিয়ে দেখছে। যখন এটি একটি অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছাবে, তখন আমরা দেখব।’

মারওয়া ও তাঁর মেয়েরা কাপড় সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। তাঁদের জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা এক মানসিক ক্ষত হয়ে আছে। মারওয়া তাঁর মেয়েদের দিকে তাকিয়ে বলেন, ‘আমি ভয়ে আছি, হয়তো আমি মেয়েদের বিয়ে দিতে পারব না।’

মারওয়া আরও বলেন, ‘মেয়েরা আমাকে বলেছে, “মা দেখো, আগে তোমার জীবন কতটা দোজখ ছিল। এই “স্বামী” শব্দটির প্রতি আমাদের ঘৃণা জন্মে গেছে।’