এক সপ্তাহে এভারেস্ট জয় কি সত্যিই সম্ভব
একটি বাণিজ্যিক কোম্পানি জেনন গ্যাসের সাহায্যে অভূতপূর্ব সময়ে পর্বতারোহীদের বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছে দেওয়ার পরিকল্পনা করেছে। তবে পর্বতারোহণ ও চিকিৎসাজগতের কিছু মানুষ প্রশ্ন তুলেছেন, এটা অকারণে জীবন বাজি রাখা হয়ে যাবে কি না।
১৯৫৩ সালে প্রথমবার এভারেস্ট জয় করেন তেনজিং নোরগে ও এডমন্ড হিলারি। এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে তাঁদের দুই মাসের বেশি সময় লেগেছিল।
উঁচুতে উঠতে থাকলে বাতাসে অক্সিজেন কমতে থাকে। এভারেস্ট জয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে বাতাসে অক্সিজেনের স্বল্পতা। হিলারি ও তাঁর দল কমতে থাকা অক্সিজেনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কয়েক সপ্তাহ ধরে ধীরে ধীরে ওপরে উঠেছেন। বেজক্যাম্পে পৌঁছানোর পর তাঁরা সাত সপ্তাহ ধরে ওঠানামা করে ওপরে দড়ি বেঁধেছেন, মই পেতেছেন, উঁচু থেকে উঁচুতে ক্যাম্প পেতেছেন। এভাবে তাঁরা একটু একটু করে চূড়ার বিরূপ আবহাওয়া মোকাবিলা করেছেন।
উঁচুতে উঠতে থাকলে বাতাসে অক্সিজেন কমতে থাকে। এভারেস্ট জয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে ওঠে বাতাসে অক্সিজেনের স্বল্পতা। হিলারি ও তাঁর দল কমতে থাকা অক্সিজেনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে কয়েক সপ্তাহ ধরে ধীরে ধীরে ওপরে উঠেছেন। বেজক্যাম্পে পৌঁছানোর পর তাঁরা সাত সপ্তাহ ধরে ওঠানামা করে ওপরে দড়ি বেঁধেছেন, মই পেতেছেন, উঁচু থেকে উঁচুতে ক্যাম্প পেতেছেন। এভাবে তাঁরা একটু একটু করে চূড়ার বিরূপ আবহাওয়ার মোকাবিলা করেছেন।
এখন শেরপারা মাইলের পর মাইল পথে আগে থেকেই দড়ি টানিয়ে দেন। আর বাণিজ্যিক গাইডিং কোম্পানিগুলো তাদের গ্রাহকদের জন্য নিখুঁত সব ব্যবস্থা করে রাখে। ফলে প্রতিবছর শত শত পর্বতারোহী এভারেস্টের চূড়ায় উঠতে সক্ষম হন।
কিন্তু এত সব সুবিধা থাকার পরও হিলারির প্রথমবার এভারেস্টের চূড়ায় আরোহণে যে সময় লেগেছে, অধিকাংশ পর্বতারোহীরই এখনো তেমন সময়ই লাগে। এভারেস্টের চূড়ায় ওঠার সময়ে নাটকীয় কোনো পরিবর্তন আসেনি।
অনেক অভিযানেই পর্বতারোহীদের চূড়ায় পৌঁছানোর জন্য দুই মাসের মতো সময় লেগে যাবে বলে দেওয়া হয় এবং নিবিড়ভাবে খাপ খাওয়ানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। তবে এই সময়টা আবহাওয়া, পাহাড়ে মানুষের ভিড় ও পর্বতারোহীর স্বাস্থ্য-সবলতার ওপরও নির্ভর করে।
সাধারণত হেঁটে বেজক্যাম্পে পৌঁছাতে এক সপ্তাহ লাগে। সেখানে পৌঁছানোর পর বেশির ভাগ মানুষের এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছাতে আরও প্রায় ৪০ দিন লাগে। তবে কিছু কিছু কোম্পানি তাদের গ্রাহকদের দুই সপ্তাহের কম সময়ে এভারেস্ট জয়ের প্রস্তাব দিয়ে থাকে।
‘শুধু এরিথ্রোপয়েটিনের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে কোনো প্রভাব পড়ে না। এই ক্ষেত্রে আসল প্রশ্ন হলো, এটি কি সত্যিই এত অল্প সময়ের মধ্যে রক্তে লোহিত কণিকার উৎপাদন উদ্দীপিত করতে পারে?’
কিন্তু এবার একটি গাইডিং কোম্পানি গ্রাহকদের মাত্র এক সপ্তাহে এভারেস্টে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে। তাদের ওই প্যাকেজে যাত্রা শুরু হবে লন্ডন বিমানবন্দর থেকে। লন্ডন থেকে তারা গ্রাহকদের উড়োজাহাজে সরাসরি নেপালের কাঠমান্ডুতে নিয়ে যাবে। তারপর সেখান থেকে হেলিকপ্টারে সরাসরি এভারেস্টের বেজক্যাম্পে উড়িয়ে আনা হবে। সেখান থেকে কয়েক দিন পাহাড় বেয়ে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছাবেন। এ জন্য জনপ্রতি ১ লাখ ৭০ হাজার ডলার ব্যয় হবে।
পর্বতারোহীদের জন্য এভারেস্ট জয়ের এই প্রস্তাব দিয়েছেন অস্ট্রিয়ান গাইড লুকাস ফুর্টেনবাখ। এ জন্য তিনি অপ্রত্যাশিত নতুন একটি কৌশল বেছে নিয়েছেন। সেটি হলো শ্বাসের মাধ্যমে জেনন গ্যাস টেনে নেওয়া। এই গ্যাস কখনো কখনো চেতনানাশক হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
ফুর্টেনবাখের এই প্রস্তাবে অনেকের চোখ কপালে উঠলেও তাঁর এই পরিকল্পনার পেছনে যুক্তি মোটামুটি সরল। প্রায় ১০ বছর আগে জেনন গ্যাসের একটি অদ্ভুত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কথা জানা যায়, আর সেটি হচ্ছে, এই গ্যাস শরীরে এরিথ্রোপয়েটিন নামক একটি প্রোটিন উৎপাদন বৃদ্ধি করে। এরিথ্রোপয়েটিন সংক্ষেপে ইপিও।
ইপিও একটি গ্লাইকোপ্রোটিন, রক্তে পর্যাপ্ত মাত্রার অক্সিজেন না থাকলে সেটা সামাল দিতে আমাদের কিডনি ইপিও তৈরি করে।
ইপিও হাইপোক্সিয়ার সঙ্গে লড়াই করে। রক্তে পর্যাপ্ত পরিমাণে অক্সিজেন না থাকলে হাইপোক্সিয়া হয়। শরীরে হাইপোক্সিয়া দেখা দিলে ইপিও রক্তে লোহিত কণিকার সংখ্যা এবং হিমোগ্লোবিন প্রোটিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। লোহিত কণিকার ভেতর থাকা গুরুত্বপূর্ণ প্রোটিন হিমোগ্লোবিন রক্তে অক্সিজেন বহন করে এবং সারা দেহে ছড়িয়ে দেয়।
তাদের ওই প্যাকেজে যাত্রা শুরু হবে লন্ডন বিমানবন্দর থেকে। লন্ডন থেকে তারা গ্রাহকদের উড়োজাহাজে সরাসরি নেপালের কাঠমান্ডুতে নিয়ে যাবে। তারপর সেখান থেকে হেলিকপ্টারে করে সরাসরি এভারেস্টের বেজক্যাম্পে উড়িয়ে আনা হবে। সেখান থেকে কয়েক দিন পাহাড় বেয়ে মাউন্ট এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছাবেন। এ জন্য জনপ্রতি ১ লাখ ৭০ হাজার ডলার ব্যয় হবে।
অতি উচ্চতায় শরীরে প্রাকৃতিকভাবে এই প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য পর্বতারোহীদের একাধিকবার পর্বতে ওঠানামা করতে হয়। এর মাধ্যমে শরীর স্বল্প অক্সিজেনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অভ্যস্ত হয়ে ওঠে।
জেনন গ্যাসের সাহায্যে কম সময়ে শরীরে এই প্রক্রিয়া ঘটানো যায় বলে দাবি করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, অভিযান শুরুর ঠিক আগে দিয়ে খুব সাবধানে নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় জেনন গ্যাস প্রশ্বাসে টেনে নিলে অভিযোজন প্রক্রিয়া দ্রুত করা এবং স্বল্প অক্সিজেনের সঙ্গে শরীরকে খাপ খাইয়ে নেওয়া সম্ভব।
ফুর্টেনবাখ বলেছেন, তিনি আগের কয়েকটি অভিযানে নিজের ওপর সফলভাবে জেনন গ্যাসের পরীক্ষা করেছেন।
যদিও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক তেমন কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
সম্প্রতি একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার পদ্ধতিগত পর্যালোচনায় এটা নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত হয়নি যে জেনন গ্যাস শ্বাসের মাধ্যমে গ্রহণ করলে তা মানবদেহে ইপিওর কার্যকারিতার ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে।
এ বিষয়ে যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চতাজনিত চিকিৎসা বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক অ্যান্ড্রু পিকক বলেন, ‘শুধু এরিথ্রোপয়েটিনের পরিমাণ বৃদ্ধির মাধ্যমে কোনো প্রভাব পড়ে না। এই ক্ষেত্রে আসল প্রশ্ন হলো, এটি কি সত্যিই এত অল্প সময়ের মধ্যে রক্তে লোহিত কণিকার উৎপাদন উদ্দীপিত করতে পারে?’
ফুর্টেনবাখ বলেন, তাঁর এই কৌশলের মূল লক্ষ্য পর্বতারোহীদের এভারেস্ট জয় দ্রুততম সময়ের মধ্যে শেষ করা। এর ফলে তাঁদের বিরূপ আবহাওয়ার মুখোমুখি হওয়া, তুষারধসে পড়া বা অসুস্থ হয়ে পড়ার ঝুঁকি কমবে। তিনি আরও বলেন, ‘আপনি যত কম সময় পর্বতে থাকবেন, তত আপনার অভিযান নিরাপদ হবে।’
২০২৫ সালে এভারেস্টে আরোহণের মৌসুমে ফুর্টেনবাখ তাঁর চারজন ব্রিটিশ ক্লায়েন্টের সাহায্যে জেনন গ্যাস ব্যবহারের পরিকল্পনা করেছেন। মে মাসের শুরুতে তাঁদের এভারেস্টের চূড়ায় পৌঁছানোর কথা।