জনগণ যখন সংকটে, তখন কোন জুজুতে প্রতিরক্ষায় ব্যয় বাড়াচ্ছে জাপান

প্রতিরক্ষা খাতে ব্যয় বাড়িয়ে চলেছে জাপান সরকারফাইল ছবি: রয়টার্স

জাপানের অর্থনীতি খুব একটা ভালো নেই। উন্নত অন্যান্য দেশের মতোই দারিদ্র্য কিংবা অর্ধাহার হয়তো চোখে পড়ছে না। তবে সংবাদমাধ্যম ও অন্যান্য সূত্রের খবরাখবর বলছে, দৃষ্টির বাইরে থাকা এসব সমস্যা ক্রমেই গভীর হয়ে উঠছে। এমন সমস্যা যে উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে জাপানের একার, তা অবশ্য নয়। সে রকম সব কয়টি দেশেই একদিকে সম্পদ মুষ্টিমেয় কিছু পরিবারের নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীভূত, অন্যদিকে বাড়ছে চাকরি হারানো লোকজনের সংখ্যা। সেই সঙ্গে লাগামহীন মূল্যস্ফীতি নিম্ন আয়ের পরিবারগুলোর টিকে থাকা কঠিন করে তুলছে, দৈনন্দিন জীবনের খরচাপাতি মেটাতে হিমশিম খাওয়া পরিবারের সংখ্যা বাড়ছে। ফলে বেড়ে চলেছে অপরাধপ্রবণতা।

চলতি বছরের মাঝামাঝিতে জাপানের কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের প্রচারিত এক জরিপে দেখা যায়, দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ পরিবারকে গত বছর সংসার চালানোর খরচ মেটাতে সংগ্রাম করতে হয়েছে। জীবনযাত্রার খরচ মেটানোর জন্য প্রয়োজন হওয়া অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়া হচ্ছে এর মূল কারণ, যার পেছনে আছে দেশের মুদ্রা ইয়েনের মূল্য পড়ে যাওয়া এবং খাদ্যসামগ্রীর দাম বেড়ে যাওয়া। জাপানকে প্রয়োজনীয় খাদ্যের প্রায় ৬০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। দেশের মুদ্রার দরপতন আমদানির খরচ বাড়িয়ে দেয় বলে খাদ্যপণ্যের মূল্য স্বাভাবিকভাবেই বাড়ে। এর বাইরে ইউক্রেন যুদ্ধের মতো অন্যান্য কারণও রয়েছে। সে রকম অবস্থায় অন্য এক জরিপে জাপানে নিম্ন আয়ের পরিবারের প্রায় ৯০ শতাংশ বলেছে, দাম বেড়ে যাওয়ায় সন্তানদের জন্য খাবার কিনতে তাদের সংগ্রাম করতে হচ্ছে।

এ রকম সমস্যার সমাধান করা যেকোনো দেশেই সরকারের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু বিশ্বের অনেক দেশই এখন অন্য যে দিকটিতে বেশি নজর দিচ্ছে, তা হলো, অলীক শত্রু থেকে হামলার আশঙ্কায় সমর বল বৃদ্ধি। জাপানও এর ব্যতিক্রম নয়। কেন? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেতে হলে জাপানের প্রতিরক্ষা ব্যয়ের দিকে আমাদের নজর দেওয়া দরকার।

এপ্রিল মাস থেকে শুরু হতে যাওয়া পরবর্তী অর্থবছরে জাপান সরকার প্রতিরক্ষা খাতে ৯ ট্রিলিয়ন জাপানি ইয়েন বা আনুমানিক ৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচের পরিকল্পনা করছে। এই অঙ্ক চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৮ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ইয়েন বরাদ্দের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে।

জাপানের প্রভাবশালী দৈনিক সংবাদপত্র আসাহি শিম্বুন বিভিন্ন সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে শনিবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, এপ্রিল থেকে শুরু হতে যাওয়া পরবর্তী অর্থবছরে জাপান সরকার প্রতিরক্ষা খাতে ৯ ট্রিলিয়ন জাপানি ইয়েন বা আনুমানিক ৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার খরচের পরিকল্পনা করছে। এই অঙ্ক চলতি অর্থবছরের বাজেটে ৮ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ইয়েন বরাদ্দের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। জাপান সরকারের পক্ষ থেকে এর আগে বলা হয়েছিল, চীন ও উত্তর কোরিয়ার দিক থেকে প্রতিরক্ষা চ্যালেঞ্জের মুখে দেশকে পড়তে হওয়া ও সেই সঙ্গে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের দাবি মেটাতে সামরিক খাতে বরাদ্দ এতটা বৃদ্ধি করতে হচ্ছে। দেশের ক্ষমতাসীন নেতৃস্থানীয় রাজনীতিবিদেরা অবশ্য বলে থাকেন, নাগরিকদের রক্ষা করার ব্রত নিয়েই জাপান সরকার তা করছে।

জাপানের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়
ফাইল ছবি: রয়টার্স

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অবশ্য অনেক দিন ধরেই প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ বৃদ্ধির দাবি জাপানের প্রতি জানিয়ে আসছেন। পূর্ববর্তী মেয়াদে ক্ষমতাসীন থাকা অবস্থাতেও একই দাবি তিনি করে গিয়েছিলেন এবং এখন তা আরও বেশি করে করছেন। কেন তিনি এই দাবি করছেন, তা বুঝতে খুব বেশি বুদ্ধি খাটানোর দরকার মনে হয় নেই। ব্যবসায়িক বুদ্ধিতে সিদ্ধহস্ত হিসেবে পরিচিত ট্রাম্প ভালোভাবে জানেন যে জাপানের প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি হবে যুক্তরাষ্ট্রের ঘরে সেই অর্থের বড় এক অংশ চলে আসা। কেননা সর্বাধুনিক সব রকম সমরাস্ত্র জাপান কিনে থাকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকেই। আর এসব সমরাস্ত্র যে আকাশচুম্বী মূল্যে বিক্রি হয়, তা অবশ্য অনেকেরই অজানা নয়। ফলে অন্যের কাঁধে ভর করে আমেরিকাকে কীভাবে আবারও মহান করে তোলা যায়, সেই বার্তাই পরোক্ষে ট্রাম্প দিয়ে চলেছেন। পাশাপাশি সেই চাল কাজে না লাগলে দস্যুবৃত্তিতে জড়িত হতেও তিনি যে পিছপা নন, ভেনেজুয়েলার সাম্প্রতিক পরিস্থিতি তা আমাদের দেখিয়ে দিচ্ছি এবং আমরা সবাই যেন মহান সেই দেশটিকে অনেকটা ভয় পেয়েই দেখেও না দেখার ভান করছি।

অল্প কিছুদিন আগপর্যন্ত দীর্ঘ এক সময় জুড়ে জাপান দেশের প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয় মোট দেশজ উৎপাদন জিডিপির ১ শতাংশের নিচে ধরে রেখেছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জাপান অবশ্য সেই অলিখিত সীমা অতিক্রম করে গেছে এবং অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর তাকায়ে সানাইচি বলেছেন যে প্রতিরক্ষা ও সম্পর্কিত অন্যান্য খাতের ব্যয় তিনি আগামী দুই বছরের মধ্যে জিডিপির ২ শতাংশ নির্ধারণের পরিকল্পনা করছেন।

জাপান সরকার ২০২২ অর্থবছরে পরবর্তী পাঁচ বছরে ৪৩ ট্রিলিয়ন ইয়েন ব্যয়ে প্রতিরক্ষা সামর্থ্য গড়ে তোলার যে পরিকল্পনা করেছিল, ২০২৬ অর্থবছরে সেই পরিকল্পনার চতুর্থ বর্ষে সরকারের প্রাথমিক বাজেট পরিকল্পনার খসড়ায় ওপরে উল্লেখ থাকা ৯ ট্রিলিয়ন ইয়েন অন্তর্ভুক্ত রাখা হয়েছে এবং চলতি মাসের শেষ দিকে প্রধানমন্ত্রী সানায়ে তাকাইচির মন্ত্রিসভা সেটা অনুমোদন করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। নতুন যেসব সমরাস্ত্র সংগ্রহের পরিকল্পনা জাপান সরকার করছে, হাইপারসনিক নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত ক্ষেপণাস্ত্র সেখানে অন্তর্ভুক্ত আছে, শব্দের চেয়ে পাঁচ গুণ বেশি গতিতে উড়ে গিয়ে শত্রুর লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে যেগুলো সক্ষম বলে বলা হচ্ছে। এর বাইরে আরও আছে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র বাধাগ্রস্ত করার মাঝারি পাল্লার ভূমি থেকে আকাশে নিক্ষেপের ক্ষেপণাস্ত্রব্যবস্থা উন্নত করে নেওয়া এবং উপকূল রক্ষার জন্য ভূমি ও সমুদ্রের নিচে চলাচল করতে সক্ষম স্বচালিত যান মোতায়েনের পাশাপাশি প্রচুর পরিমাণ ড্রোন সংগ্রহ করা। এ রকম সব প্রাণঘাতী অস্ত্রের বড় অংশের চালান অবশ্যই আসবে ট্রাম্প সাহেবের অস্ত্রের ভান্ডার থেকে এবং অবশ্যই বিনা পয়সায় নয়।

গত অক্টোবরে টোকিওতে জাপানের প্রধানমন্ত্রী তাকায়ে সানাইচির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প
ফাইল ছবি: রয়টার্স

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পারমাণবিক বোমার ক্ষত বয়ে চলা জাপান অল্প কিছুদিন আগে পর্যন্ত দীর্ঘ এক সময়জুড়ে দেশের প্রতিরক্ষা খাতের ব্যয় মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১ শতাংশের নিচে ধরে রেখেছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় জাপান অবশ্য সেই অলিখিত সীমা অতিক্রম করে গেছে এবং অক্টোবর মাসে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর তাকায়ে সানাইচি বলেছেন যে প্রতিরক্ষা ও সম্পর্কিত অন্যান্য খাতের ব্যয় তিনি আগামী দুই বছরের মধ্যে জিডিপির ২ শতাংশ নির্ধারণের পরিকল্পনা করছেন। ট্রাম্প সাহেব অবশ্য চাইছেন সেই লক্ষ্যমাত্রা যেন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ হয়। যুক্তি হিসেবে তিনি ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরে চীনের সামরিক উপস্থিতি জোরদার করে নেওয়া এবং উত্তর কোরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানো ও পরমাণু উন্নয়নের উল্লেখ করছেন। যেসব তৎপরতা জাপানের সামনে এ রকম হুমকি হয়ে দেখা দিতে পারে, যুক্তরাষ্ট্রের একার পক্ষে যেসব হুমকির জবাব দিয়ে মিত্রকে রক্ষা করা হয়তো সম্ভব হবে না বলেও তিনি ইঙ্গিত দিচ্ছেন।

এসব হিসাব-নিকাশ থেকে আমরা যা দেখছি তা হলো দেশের নাগরিকদের নানা রকম সমস্যা যখন তীব্র আকার ধারণ করছে, তখন প্রায় সব কটি অগ্রসর দেশ এসব সমস্যা মোকাবিলায় অর্থের ঘাটতির দোহাই দিয়ে গেলেও সমর বল বৃদ্ধির পেছনে খরচ বাড়িয়ে চলেছে। এ রকম অশুভ প্রতিযোগিতায় যে কেবল উন্নত দেশগুলো যোগ দিচ্ছে, তা অবশ্য নয়। উন্নয়নশীল বিশ্বের অধিকাংশ দেশও জিডিপির বড় এক অংশ খরচ করে চলেছে সেই একই খাতে, দেশের মানুষকে অভুক্ত রেখে হলেও।

বলা হয় যে পাকিস্তান জিডিপির এক-তৃতীয়াংশের বেশি বরাদ্দ প্রতিরক্ষা খাতে করে থাকে। উন্নয়নশীল বিশ্বের অন্য অনেক দেশও এর চেয়ে খুব বেশি পিছিয়ে নেই। ফলে মনে হতে পারে, যেন এক অন্ধকার পথ ধরে আমরা চলছি, আর আমাদের সেই চোখে না দেখতে পাওয়া অবস্থার সুযোগ নিয়ে নিজেদের মুনাফার অঙ্ক যারা সমানে ভারী করে চলেছে, তারা হচ্ছে মারণাস্ত্রের ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি অত্যাধুনিক প্রযুক্তি যারা উদ্ভাবন করছে তারাও। কেননা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসহ অগ্রসর প্রযুক্তির বড় এক অংশ যে মারণাস্ত্র তৈরি ও উন্নয়নে ব্যবহার করা হচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চলতে থাকা সীমিত সব যুদ্ধে অত্যাধুনিক নানা রকম ড্রোন ও অন্যান্য অস্ত্রের ব্যবহার তা দেখিয়ে দিচ্ছে নাকি?