কারাগার থেকে বের হলে আবার আমি তা-ই করব: মিয়ানমারের শিক্ষার্থী

২০২১ সালের আগস্টে ইয়াঙ্গুনে রাস্তায় বিক্ষোভে নেতৃত্ব দিচ্ছেন লিন লিন (মধ্যে)। তখন তিনি ইয়াঙ্গুন ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি স্টুডেন্টস ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টছবি: এএফপি

মিয়ানমারে জান্তাবিরোধী বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন শিক্ষার্থী লিন লিন। তাঁকে ধরতে উঠেপড়ে লাগে জান্তারা। একপর্যায়ে জান্তা বাহিনীর হাতে তিনি ধরা পড়েন। এখন তিনি ১৫ বছরের কারাভোগ করছেন। তবে এ নিয়ে কোনো অনুশোচনা নেই এই তরুণীর।

আদালতে যখন তাঁর বিচার চলে, তখন এএফপির সঙ্গে তাঁর কথা হয়। তিনি বলেছিলেন, ‘অন্য কিছু করার চেয়ে আমি এটি করতে চেয়েছি। আপনি যদি জানতে চান, ছাড়া পেলে আমি কী করব, তাহলে বলল, আমি আবারও একই কাজ করব।’

মনোবিজ্ঞানের ২৫ বছর বয়সী এই শিক্ষার্থীর বেড়ে ওঠাটা এমন একটি সময়, যখন মিয়ানমারে আধা গণতান্ত্রিক ধারা চলছিল।

নির্বাচনে জালিয়াতির অভিযোগ তুলে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনাবাহিনী যখন অভ্যুত্থানের মাধ্যমে অং সান সু চির সরকারকে উৎখাত করে, তখন লিন লিন রাস্তায় লাখো বিক্ষোভকারীর সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন।

ক্ষুব্ধ জনতাকে লক্ষ্য করে সেনারা গুলি ছুড়েছিল। গ্রেপ্তার করা হয়েছিল হাজারো মানুষকে। সন্দেহভাজন ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর রাতভর অভিযান চালায়।

বিক্ষোভের তীব্রতা ধীরে ধীরে ম্লান হয়ে যায়, কিন্তু লিন লিন সাধারণ মানুষের মনে জান্তার বিরুদ্ধে ক্ষোভ জিইয়ে রাখার উপায় খুঁজে বের করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন।

লিন লিন হংকংসহ বিভিন্ন দেশে মানুষের গণতান্ত্রিক সমাবেশ দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে ইয়াঙ্গুনের চারপাশে বিক্ষোভ সংঘটিত করতে শুরু করেন।

মেসেজিং অ্যাপ ব্যবহার করে লিন লিন তরুণ বিক্ষোভকারীদের ডেকে আনেন। তাঁরা শপিং মলের বাইরে বা পার্ক ও মার্কেটে হঠাৎ একত্র হয়ে গণতন্ত্রের পক্ষে বিক্ষোভ দেখাবে।

২০২১ সালে এএফপি যখন তাঁর সাক্ষাৎকার নেয়, তখন লিন লিন পুলিশ ও নিরাপত্তা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে বেশ ভালোভাবেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছিলেন।

একটি আধো আলোছায়া আছে, এমন একটি কক্ষে ছিলেন লিন লিন। সেখান থেকে তিনি বলেন, ‘বিক্ষোভের সময়, আমার অনেক অ্যাড্রেনালিন থাকে। মনে হতো, যেন আমার হৃদ্‌যন্ত্র মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে।’

ঘুমাতে পারতাম না

ইয়াঙ্গুনে সেনাবাহিনী তাদের অবস্থান কঠোর থেকে কঠোরতর করতে থাকলে বিক্ষোভকারীদের মধ্যেও ভয়শঙ্কাও কাজ করতে থাকে।

লিন লিন তাঁর পরিবারকে বিদায় জানিয়ে আত্মগোপনে চলে যান। কয়েক দিন পরপরই আস্তানা পাল্টেছেন। সব সময় আতঙ্কে থাকতেন, এই বুঝি দরজায় টোকা পড়ল। তিনি এএফপিকে বলেন, ‘ওই সময় আমি রাতে ঘুমাতে পারতাম না।’

লিন লিন বলেন, ‘দিনের আলো ফুটলে মনে হতো এখন আমি নিরাপদ। এরপর আমি ভালোভাবে ঘুমাতে পারতাম।’

মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নিরাপত্তা বাহিনী ভিন্নমতের মানুষের ওপর দমন-পীড়ন চালানোর সময় নির্যাতন ও যৌন হয়রানি করেছে। ২০২২ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর বলেছে, পুলিশি হেফাজতে অন্তত ২৯০ জনের মৃত্যু হয়েছে।

২০২১ সালের ডিসেম্বরে শিক্ষার্থীদের আরেকটি সংগঠন ইয়াঙ্গুনে ঝোড়ো বিক্ষোভ করেছিলেন। সে সময় সামরিক বাহিনীর একটি গাড়ি তাঁদের ধাক্কা দিয়ে চলে যায়। এতে তিনজন আহত হয়েছিলেন।

লিন লিনও ওই মাসে ধরা পড়েছিলেন। একটি বিক্ষোভে যোগ দিতে যাওয়ার পথে সাধারণ পোশাকে থাকা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন তিনি।

লিন লিন কারাগার থেকে বলেন, ‘আমি সবচেয়ে খারাপ কিছুর জন্য প্রস্তুত ছিলাম...কিন্তু আচমকা ধরা পড়ায় আমার মুখ হাঁ হয়ে যায় এবং বলেছিলাম ‘হুহ’।

লিন বলেন, ‘প্রথমে আমি দৌড়ে পালানোর কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু রাস্তা ফাঁকা ছিল, আবার তাদের হাতে বন্দুক ছিল।’

২০২২ সালের মার্চে সামরিক জান্তা নিয়ন্ত্রিত আদালত তাঁকে তিন বছরের কারাদণ্ড দেন। ব্রিটিশ আমলে প্রণীত আইনকে জান্তা সরকার ভিন্নমতের মানুষ বিশেষ করে বিক্ষোভকারী, বিরোধী নেতারা ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে।

এরপর ভুয়া পরিচয়পত্র ব্যবহারের অভিযোগে লিন লিনের আরও দুই বছরের কারাদণ্ড হয়।

স্থানীয় পর্যবেক্ষক সংগঠনের তথ্যমতে, সামরিক অভ্যুত্থান শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত ২৬ হাজারের বেশি রাজনৈতিক নেতা-কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

শিক্ষার্থী লিন লিন
ছবি: এএফপি

বন্ধুদের চিঠি

কারাগারের একঘেয়েমি জীবনে কখনো কখনো আনন্দ নিয়ে আসে বাড়ির খাবার। বাড়ি থেকে আসে খাবারের পার্সেল। আদালতে যেদিন শুনানির দিন থাকে, সেদিন পরিবারের লোকজনের সঙ্গে দেখা হয় তাঁর। তখন তিনি দেশজুড়ে যে অশান্তি চলছে, সেসব খবর শুনতে পান।

লিন লিন বলেন, ‘গ্রেপ্তার হওয়ার আগে আমি কী করেছি, সেগুলো ভেবে নিজের বিষণ্নতা এড়িয়ে যাই।’ প্রতিবাদ লড়াইয়ে যেসব বন্ধুকে পাশে পেয়েছিলেন, তাঁদের চিঠি লেখেন তিনি।

হেলেন (ছদ্মনাম) লিন লিনের তেমনই এক সহযোদ্ধা। নিরাপত্তার আশঙ্কায় ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে। তিনিও কারাগারে সময় কাটিয়েছিলেন। বন্ধু সম্পর্কে হেলেন বলেন, ‘তিনি কখনো তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করেন না। তিনি কখনো চান না, আমরা হতাশ হয়ে পড়ি।’

বন্দীদের লেখা চিঠিগুলো পর্যবেক্ষণ করা হয়। তাই সেখানে রাজনৈতিক বিষয় থাকা নিষিদ্ধ। এর পরিবর্তে তাঁরা হটপট নিয়ে আলাপ করেন। ভবিষ্যতে একসঙ্গে যাওয়ার পরিকল্পনা নিয়ে কথা বলেন।

কিন্তু সম্প্রতি একটি আদালত লিন লিনকে আরও ১০ বছরের কারাদণ্ড দেন। এবারের অভিযোগ ‘সন্ত্রাসী’ সংগঠনের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা।

হেলেন বলেন, ‘লিন লিনকে যদি আরও দীর্ঘ সময় কারাগারে থাকতে হয়, তাহলে তাঁর যা চাওয়া, তিনি আর তা করতে পারবেন না। এ নিয়ে আমি উদ্বিগ্ন।’

তবে কবে মুক্তি পাবেন, সেই দিন গণনা ছেড়ে দিয়েছেন লিন লিন। তিনি বলেন, ‘আমি নিজেকেও আর নিজে জিজ্ঞেস করি না, যে কবে বাড়ি ফিরতে পারব।’

লিন লিন বলেন, ‘জান্তার বিরুদ্ধে বিপ্লবে জয়ী হওয়ার পরই আমি ঘরে ফিরব, সেটি আমি বলতে পারি।’