যুক্তরাজ্যকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ বলছেন আফগান যোদ্ধারা

২০২১ সালে আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলের পর ব্রিটিশ সেনাদের সহযোগিতাকারীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে তালেবানছবি: এএফপি ফাইল ছবি

একসময় আফগানিস্তানে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন আফগান বিশেষ বাহিনীর সদস্যরা, তবে ২০২১ সালে আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখল করার পর তাঁদের অনেকেই নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত হন।

এসব সেনাদের অনেকে পাকিস্তানে পালিয়ে যান। এখন পাকিস্তানও বলছে, আফগান শরণার্থীদের বিতাড়িত করা হবে।

আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সাবেক সদস্যদের গোপন একটি নেটওয়ার্কের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের বরাতে বিবিসি খবরটি প্রকাশ করেছে। বিতাড়িত হতে যাওয়া কয়েকজন আফগান সেনাসদস্যদের সঙ্গেও কথা বলেছে বিবিসি। তাঁরা বলছেন, তালেবানশাসিত আফগানিস্তানে ফিরে যাওয়াটা তাঁদের জন্য নিরাপদ নয়। তাঁদের কেউ কেউ মনে করেন, যুক্তরাজ্য আশ্রয় না দিয়ে তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। যুক্তরাজ্যের সাবেক এক জেনারেলও বলেছেন, এসব আফগান যোদ্ধাকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে না নিতে পারলে তা হবে যুক্তরাজ্যের ‘বিশ্বাসঘাতকতা’।

সম্প্রতি খবর বেরিয়েছে, জ্যেষ্ঠ ব্রিটিশ কূটনীতিক ও সামরিক সদস্যরা ঝুঁকিতে থাকা আফগান নাগরিকদের আশ্রয় দেওয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিলেন, তবে তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। আর এরপরই পাকিস্তানে পালিয়ে থাকা এসব আফগান সেনার আতঙ্ক বেড়েছে।

‘এটা বিশ্বাসঘাতকতা’

২০২১ সালে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন পার্লামেন্টে বলেছিলেন, আফগান বিশেষ বাহিনীর যোদ্ধাদের নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে নিতে যুক্তরাজ্য যথাসাধ্য কাজ করবে।

১২ বছরের বেশি সময় ধরে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন জেনারেল রিচার্ড ব্যারনস। বিবিসি নিউজনাইটকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, ‘এসব সেনাকে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করতে না পারাটা যুক্তরাজ্যের জন্য অসম্মানের। কারণ, এর মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে হয় জাতি হিসেবে আমরা ধোঁকাবাজ, নয়তো অযোগ্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘এর কোনোটাই গ্রহণযোগ্য নয়। এটা বিশ্বাসঘাতকতা। আর এ বিশ্বাসঘাতকতার কারণে যেসব মানুষ একসময় আমাদের হয়ে কাজ করেছিলেন, তাঁদেরই এখন হয় মরতে হবে, নয়তো কারাগারে থাকতে হবে।’

২০২২ সালের মার্চে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানো একটি গোপন চিঠিও হাতে পেয়েছে বিবিসি। ওই চিঠিতে আফগানিস্তানের ৩২ সাবেক গভর্নর, কৌঁসুলি ও কর্মকর্তাকে জরুরি ভিত্তিতে সহায়তা প্রদানের আবেদন করা হয়েছিল। তাঁরা সবাই ২০০৬ থেকে ২০১৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে হেলমান্দ প্রদেশে অভিযানের সময় যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রকে সহযোগিতা করেছেন। যুক্তরাজ্যের কয়েকজন জ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ও সামরিক সদস্য চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন।

বিশেষ বাহিনীর ২০০ সেনার বেশির ভাগের মতোই এই ৩২ কর্মকর্তাও যুক্তরাজ্যে যাওয়ার জন্য আবেদন করেছিলেন। আফগান রিলোকেশনস অ্যান্ড অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রাম (এআরএপি) কর্মসূচির আওতায় যুক্তরাজ্যে আশ্রয়ের আবেদন জানিয়েছিলেন তাঁরা। যুক্তরাজ্য সরকারের নিয়োগপ্রাপ্ত এবং যাঁরা আফগানিস্তানে যুক্তরাজ্যের সরকারি বিভাগের হয়ে কাজ করেছেন, তাঁদের জন্য কর্মসূচিটি পরিচালিত হয়ে থাকে।

তবে ওই ৩২ কর্মকর্তা ও সেনাদের বেশির ভাগেরই আবেদন প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। অন্যরা এক বছরের বেশি সময় ধরে সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছেন।

আফগান নিরাপত্তা বাহিনীর সাবেক সদস্যদের গোপন একটি নেটওয়ার্কের সংগ্রহ করা তথ্য বলছে, বছরের শেষ নাগাদ পাকিস্তান থেকে প্রায় ২০০ আফগান সেনাসদস্য বিতাড়িত হতে পারেন। এ তথ্য বিবিসিকে জানানো হয়েছে। এর সংখ্যা যাচাই করা বিবিসির পক্ষে সম্ভব হয়নি, তবে জ্যেষ্ঠ ব্রিটিশ কূটনীতিক সূত্র বলেছে, এটিই এখন পর্যন্ত সবচেয়ে যথাযথ হিসাব।

আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখল করার পর ব্রিটিশ সেনাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়া হয়
ছবি: এএফপি ফাইল ছবি

‘আমরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছি’

পাকিস্তান থেকে আফগান বিশেষ বাহিনীর যে সেনারা বিতাড়িত হওয়ার ঝুঁকিতে আছেন, তাঁদেরই একজন আলী। তিনি এআরএপি কর্মসূচির আওতায় যুক্তরাজ্যে আশ্রয়ের আবেদন জানান, তবে সুফল পাননি। তিনি বিবিসিকে বলেন, তাঁর মনে হয়েছে যুক্তরাজ্য তাঁর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এবং ছুড়ে ফেলেছে।

পাকিস্তানে একটি এক কক্ষের ঘরে থাকেন আলী। তিনি যুক্তরাজ্যের সেনাবাহিনীর সঙ্গে কাজের অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দিন–রাত একসঙ্গে ছিলাম। প্রশিক্ষণের সময় আমরা এক তাঁবুর নিচে ঘুমিয়েছি, একই পাত্র থেকে খাবার তুলে খেয়েছি। অভিযানের সময় আমরা ব্রিটিশদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছি, যেন আমরা একই পরিবারের সদস্য।’

আলী কমান্ডো ফোর্স ৩৩৩ নামের একটি এলিট ইউনিটের সদস্য ছিলেন। আফগানিস্তানে আফিম উৎপাদনজনিত সমস্যা মোকাবিলায় ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্য এ দলটি গড়ে তুলেছিল। তাদের আবার আফগান টেরিটরিয়াল ফোর্স ৪৪৪ নামের একটি সহযোগী দল ছিল। এটি ‘দ্য ট্রিপলস’ নামে পরিচিত ছিল। দ্রুতই তারা তাদের সক্রিয়তা, সততা ও সাহসিকতার জন্য সুনাম অর্জন করেছিল।

প্রায় ১২ বছর ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে থাকা জেনারেল স্যার রিচার্ড ব্যারনস বলেন, যুক্তরাজ্য–সমর্থিত সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে দ্য ট্রিপলস সম্মুখসারিতে লড়াই করেছে। ব্রিটিশ সেনাদের পাশাপাশি তাঁরা সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ, কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য অর্জনে কাজ করেছেন।

আরও পড়ুন

২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করে তালেবান। আফগানিস্তানে তখন পর্যন্ত হাতে গোনা যে কয়েকটি সেনা দল টিকে ছিল, তার একটি সিএফ৩৩৩। ব্রিটিশ পাসপোর্টধারীদের সুরক্ষা দিতে আলী তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে রাজধানী কাবুলের ব্যারন হোটেলে চলে যান। ব্রিটিশ পাসপোর্টধারীদের পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছিলেন তিনি।

তবে আলী নিজেই পালানোর জন্য উড়োজাহাজে উঠতে পারেননি। পরে তিনি স্থলপথে পাকিস্তান চলে যান। আলীর ধারণা ছিল, প্রায় দুই দশক ধরে যে ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করেছেন, তারা হয়তো শিগগির সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেবে, তবে তাঁর সে ধারণা ভুল ছিল।

আলী আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমরা কখনো ভাবিনি যে বীরদের ছুড়ে ফেলা হবে। আমরা সব ঝুঁকি নিয়েছিলাম। আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সহযোগিতার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। আমরা মুক্ত মত এবং মানবজীবনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলাম। এরপর সব উল্টো হয়ে গেল। এটা সত্যিই হতাশার।’

পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ এখন অনথিভুক্ত আফগানদের বিরুদ্ধে ধরপাকড় চালাচ্ছে। যাঁরা ধরা পড়ছেন, তাঁদের বিতাড়িত করার হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে আলী বলেন, ‘আমি কাজ করতে পারি না। পুলিশের ভয়ে স্ত্রী ও পাঁচ সন্তান নিয়ে একটি কক্ষে আছি। তিন মাস ধরে আমি নিজেই নিজেকে গৃহবন্দী করে রেখেছি।’

যুক্তরাজ্য বলছে, তারা ইতিমধ্যে কয়েক হাজার আফগানকে নিরাপদ আশ্রয় দিয়েছে।

‘আমরা হুমকিতে আছি’
হেলমান্দের গ্রামসির জেলার গভর্নর ছিলেন মোহাম্মদ ফাহিম। সম্মুখসারি থেকে তালেবানের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়েছিলেন তিনি। ২০০১ সালের আগপর্যন্ত গ্রামসির ছিল তালেবানের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি।

অজ্ঞাত একটি এলাকা থেকে বিবিসিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ফাহিম বলেন, ‘গভর্নর থাকাকালে আমরা কয়েকজন তালেবান নেতাকে গ্রেপ্তার করেছি। তাঁরা জানতেন, আন্তর্জাতিক বাহিনীর পক্ষে আমরা লড়াই করছি, সুতরাং সত্যিকার অর্থে আমি হুমকিতে আছি।’

ব্রিটিশ সেনা কর্মকর্তা রিচার্ড ব্যারনস বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে লজ্জিত। কারণ, আমি মনে করি আমরা তাঁদের একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম, আর তা আমরা পূরণ করিনি।’

এআরএপি কর্মসূচিটি ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন পরিচালিত হয়।

ব্রিটিশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় বলছে, আফগানিস্তানের মানুষদের আশ্রয় দিতে যুক্তরাজ্যের যে লক্ষ্য সাধারণ প্রতিশ্রুতি ছিল, তা তারা পূরণ করেছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ২৪ হাজার ৬০০ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয় দেওয়া হয়েছে।

আরও পড়ুন

মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, ব্যক্তিভেদে আলাদা আলাদা করে এআরএপি আবেদনগুলো মূল্যায়ন করা হয়। চাকরির ভূমিকা অনুযায়ী স্বয়ংক্রিয়ভাবে যোগ্যতা নির্ধারণের সুযোগ এখানে নেই।

তবে সবকিছুর পরও আলী ও ফাহিম দুজনই মনে করেন, ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাঁরা যেসব কাজ করেছেন, তার জন্য গর্ব বোধ করেন তাঁরা।

ওই সময়ের একটি স্মৃতির কথা উল্লেখ করে আলী বলেন, ঠান্ডার মধ্যে ব্রিটিশ ও মার্কিন বাহিনীর এক কমান্ডার নিজের কম্বল তাঁর গায়ে জড়িয়ে দিয়েছিলেন।

আলী বলেন, ‘এটা আমার জন্য এক মধুর স্মৃতি। তবে পরে যা কিছু ঘটেছে, তা খুব হতাশার।’