জাপানে ভূমিকম্পের শতবর্ষ ও কিছু অমীমাংসিত প্রশ্ন

সেকালের সংবাদপত্রে প্রকাশিত কোরীয়দের ওপর নির্যাতনের হাতে আঁকা ছবি
ছবি: সংগৃহীত

সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিনটি ছিল জাপানে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের শতবার্ষিকী। ১০০ বছর আগে এই দিনে জাপানের রাজধানী ও আশপাশের এলাকায় আঘাত হানা প্রচণ্ড ভূমিকম্পে টোকিওর বিশাল এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। একমাত্র টোকিওতেই ২ লাখ ২০ হাজার বাসভবন ভূমিকম্পের পর ছড়িয়ে পরা আগুনে ভস্মীভূত হয়।

জাপান সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের করা হিসাব থেকে জানা যায়, অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতির মোট পরিমাণ ছিল আনুমানিক ৫৫০ কোটি ইয়েন। সেই সময়ের হিসাবে এটি ছিল দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের প্রায় ৩৭ শতাংশ।

টোকিও এবং আশপাশের এলাকায় আঘাত হানা সেই ভূমিকম্পে এক লাখের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। এর মধ্যে ৪০ হাজারের কাছাকাছি বা এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল ভূমিকম্পের পরে ছড়িয়ে পড়া আগুনে পুড়ে। রাজধানী টোকিও এবং পার্শ্ববর্তী শহর ইয়োকোহামার বিস্তৃত এলাকা পরিণত হয়েছিল বিশাল এক ধ্বংসস্তূপে।

ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি পরিদর্শন করছেন সেই সময়ের যুবরাজ হিরোহিতো
ছবি: সংগৃহীত

১৯২৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টার অল্প আগে কান্ত এলাকার ওপর আঘাত হানা ভূমিকম্প ছিল ৭.৯ মাত্রার। এর উৎস বা কেন্দ্র ছিল কানাগাওয়া জেলার দক্ষিণের সমুদ্র উপকূলের অল্প দূরে। ১৯২৩ সালের সেই ভূমিকম্পের পর অবশ্য বড় ধরনের সুনামি দেখা দেয়নি। বরং ভূমিকম্প আঘাত হানার ঠিক পরপর ভেঙে পড়া বৈদ্যুতিক তার থেকে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।  

১০০ বছর আগে জাপানের রাজধানী টোকিওসহ অন্যান্য জনবসতির বেশির ভাগ বাড়ি ছিল কাঠের তৈরি। জরুরি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার মতো কোনো ব্যবস্থা সেসব বাড়িতে প্রায় ছিল না বললেই চলে। ফলে আগুন একবার কোনো একটি এলাকায় শুরু হলে দ্রুত তা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার মতো বিপদের আশঙ্কা ছিল। ভূমিকম্প আঘাত হানার পর মানুষ আরও বেশি অসহায় বোধ করতে থাকায় এবং সেই সঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ব্যবস্থাপনার ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় একের পর এক এলাকাজুড়ে আগুন ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রাণহানির সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।

বড় কোনো ভূমিকম্প আঘাত হানার পর অন্য যে বিপদ সাধারণত দেখা দেয়, তা হলো ভূমিকম্প–পরবর্তী কম্পন। অনেক ক্ষেত্রে সে রকম কম্পনও যথেষ্ট শক্তিশালী হয়ে থাকে এবং প্রথম আঘাতে দুর্বল হয়ে যাওয়া অনেক কাঠামো পরবর্তী কম্পনে ধসে পড়লে প্রাণহানির সংখ্যা তা আরও অনেকটা বাড়িয়ে দেয়। টোকিওর ১০০ বছর আগের ভূমিকম্পের পরও সে রকম ঘটেছিল।

ভূমিকম্পবিধ্বস্ত টোকিও
ছবি: সংগৃহীত

জাপানের সংবাদমাধ্যম ও ভূমিকম্প নিয়ে বিভিন্ন লেখায় জানা যায়, সুমিদা এলাকায় অবস্থিত সামরিক পোশাক তৈরির একটি কারখানা ভূমিকম্পের প্রথম আঘাতের পর অক্ষত ছিল। এলাকাবাসীর অনেকে সেটাকে নিরাপদ ভেবে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এ ছাড়া সেই স্থাপনার পাশেই ছিল প্রায় ৮০ হাজার বর্গমিটারের খোলা একটি জায়গা। মানুষ সেই ভবনেই কেবল আশ্রয় নেননি, অনেকেই তাঁদের ধসে পড়া বাড়িঘরের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আগুন থেকে বাঁচাতে হাতে টানা গাড়িতে তুলে খোলা জায়গায় জমা করে রেখেছিলেন।

তবে পরবর্তী কম্পনের আঘাতে সেই ভবন বিধ্বস্ত হয়ে সেখানে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। অল্প সময়ের মধ্যে জমা করে রাখা আসবাব ও অন্যান্য জিনিসে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। নিরাপদ দূরত্বে মানুষের পালিয়ে যাওয়ার পথ বন্ধ হয়ে যায়। একমাত্র সেই জায়গাটিতেই ৩০ হাজারের বেশি এলাকাবাসীর মৃত্যু হয়েছিল। একই ধরনের ঘটনা টোকিওর অন্যত্র এবং ইয়োকোহামায়ও ঘটেছে এবং মৃত্যুর মোট সংখ্যা ১ লাখের ওপরে নিয়ে গেছে।

সুমিদা এলাকার সামরিক পোশাক তৈরির ওই কারখানার জায়গায় এখন একটি স্মৃতি মিলনায়তন হয়েছে। প্রতিবছর ১ সেপ্টেম্বর ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্তদের স্মরণে সেখানে মানুষ জড়ো হন। নিহতদের স্মরণ করে নীরব প্রার্থনায় যোগ দেন। সেখানে পাশের একটি পার্কে আছে স্মৃতিফলক। এটি ভূমিকম্পের ভয়াবহতা  আজও স্মরণ করিয়ে দেয়। পার্কের এক পাশে আরও আছে একটি জাদুঘর, ভূমিকম্পের সঙ্গে সম্পর্কিত শিল্পীদের আঁকা ছবি, আলোকচিত্র এবং অন্যান্য নানা সামগ্রী। সেখানে ১০০ বছর আগের ভূমিকম্পের নানা স্মৃতি রয়েছে।

সেই সময়ের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হাতে আঁকা একটি ছবিতে দেখা যায় কয়েকটি বালক-বালিকা সমবয়সী এক বালককে ধরে তাকে শায়েস্তা করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেই বালকের দোষ যেটুকু ছিল তা হলো, দেখতে সে ঠিক জাপানিদের মতো নয়।
ভূমিকম্পের পরের দিনগুলোয় বিশেষ করে কোরীয় বংশোদ্ভূত লোকজনের ওপর হামলার অনেক ঘটনা টোকিও এবং অন্যত্র ঘটেছে। এসব ঘটনায় বেশ কিছু মানুষের প্রাণহানি সম্পর্কেও জানা যায়। এই ছবিতে সেটিই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

ভূমিকম্পের কয়েক দিন পর হঠাৎ শহরে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে টোকিওবাসী কোরীয়রা দুর্যোগ–পরবর্তী বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ নিয়ে জাপানিদের মেরে ফেলতে বিভিন্ন কুয়ার পানিতে বিষ মিশিয়ে দিচ্ছে। কোরিয়া উপদ্বীপ তখন ছিল জাপানের উপনিবেশ।

জাপান সরকার শ্রমিক হিসেবে কাজ করার জন্য কোরিয়ার অনেক লোককে জাপানে নিয়ে এসেছিল। এদের বড় এক অংশের বসবাস ছিল টোকিও ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি শহরে। কে বা কারা সেই গুজব রটিয়েছিল, সে সম্পর্কে পুরোপুরি নিশ্চিত না হওয়া গেলেও জাপানের উগ্র জাতীয়তাবাদী গোষ্ঠী এর সঙ্গে জড়িত ছিল বলে সন্দেহ করা হয়।

অনেকে আবার বলেন, সরকারও এর পেছনে মদদ দিয়ে থাকবে। তবে ঘটনা যা–ই হোক না কেন, উগ্র জাতীয়তাবাদী চেতনা মানুষকে কতটা অন্ধ করে দিতে পারে, তার প্রমাণ মনে হয় কোরীয়দের ওপর হামলার সেই ঘটনা তুলে ধরছে। পরে অবশ্য নিহত কোরীয়দের স্মরণে একটি স্মৃতিফলক সেই পার্কের অন্য প্রান্তে বসিয়ে নেওয়া হয়।

প্রতিবছর সেখানে আয়োজিত সমাবেশ সামনে রেখে টোকিওর নগর সরকারের পক্ষ থেকে বিবৃতি প্রদানের যে রীতি কিছুদিন আগে পর্যন্ত চালু ছিল, বর্তমান গভর্নর ইউরিকো কোইকে নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তা স্থগিত করে দিয়েছেন। কারণ হিসাবে যে যুক্তি তিনি দেখিয়েছেন, তা হলো, নিহত সবাইকে স্মরণ করে স্থানীয় সরকার যে বিবৃতি প্রচার করে আসছে, সেই তালিকায় কোরীয়রাও অন্তর্ভুক্ত থাকায় তাঁদের জন্য ভিন্নভাবে বিবৃতি প্রদানের যৌক্তিকতা তিনি দেখছেন না।

তবে সমালোচকেরা বলছেন, অতীতের জাতীয়তাবাদী চেতনা থেকে জাপান যে এখনো পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পারেনি, টোকিওর গভর্নরের অবস্থান সেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

টোকিওর নগর কেন্দ্রের উয়েনো পার্ক থেকে অতীতের সনাতন নগর কেন্দ্র আসাকুসার দিকে এগিয়ে গেলে চোখে পড়বে ইয়োশিওয়ারা মন্দির। মন্দিরের অতীতের জৌলুশ এখন আর নেই। এই মন্দিরের পাশেই ছিল নগরের সবচেয়ে পরিচিত প্রমোদকেন্দ্র ইয়োশিওয়ারার অবস্থান। প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের জন্য নানা রকম বিনোদনের ব্যবস্থা সেখানে এক সময় ছিল। যেসব বিনোদনের অন্যতম অবশ্যই হচ্ছে নারীর সান্নিধ্য।

ইয়োশিওয়ারায় নাচ-গানের আসর বসত। এর আবশ্যকীয় কুশীলবদের মধ্যে ছিলেন গেইশা নারীরা। জাপানের এদো সংস্কৃতি হিসেবে পরিচিত মঞ্চ উপস্থাপনার শিল্পকলার অনেকটাই একসময় ইয়োশিওয়ারার সাহচর্যে হয়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ।

সমাজের অপেক্ষাকৃত উচ্চশ্রেণির মানুষের ভোগবিলাসের কেন্দ্র হিসেবে ইয়োশিওয়ারার যাত্রা শুরু ১৬১৭ সালে। শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে–ছিটিয়ে থাকা যৌনকর্মীদের একক একটি জায়গায় কেন্দ্রীভূত করে নেওয়ার উদ্দেশ্যে তোকুগাওয়া প্রশাসন লাইসেন্স দিলে ইয়োশিওয়ারার আয়তন ধীরে সম্প্রসারিত হতে শুরু করে। এটি নানা রকম বিনোদনের অংশ হয়ে ওঠে।

এদো সংস্কৃতি নামে পরিচিত নগরায়ণের সঙ্গে সম্পর্কিত সংস্কৃতির বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা এলাকাটি রাখতে শুরু করে। তবে এই সবকিছুর আড়ালে মর্মান্তিক অনেক ঘটনার সাক্ষীও হয়ে ওঠে টোকিওর বিনোদনকেন্দ্রটি। যে নারীরা বিভিন্ন সময়ে ইয়োশিওয়ারার বিনোদনকেন্দ্রে পুরুষের সেবা করতেন, তাঁদের অনেককেই নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোর করে সেখানে নিয়ে আসা হয়। সেই ফাঁদে আটকা পড়ে যাওয়া নারীদের প্রায় সবাইকেই বাকি জীবনটা সেখানে কাটাতে হয়েছে।

দালালেরা অর্থের বিনিময়ে দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের কিনে নিয়ে ইয়োশিওয়ারায় জড়ো করেছিল। ১৯২৩ সালে ভূমিকম্প আঘাত হানার সময় পর্যন্ত ইয়োশিওয়ারা ছিল সক্রিয়। তবে ভূমিকম্প থেকে ছড়িয়ে পড়া আগুন দ্রুত ইয়োশিওয়ারার কাঠের তৈরি বিভিন্ন ভবনে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনেক মানুষ সেই আগুনে আটকা পড়ে যান। সেখানে নিহতের সংখ্যা দাঁড়ায় আনুমানিক ৫০০।

তাঁদের অনেকেই ছিলেন নারী। ফলে ভূমিকম্পের পর ইয়োশিওয়ারার অব্যবস্থাপনার জন্য ব্যাপক সমালোচনার মুখে সরকারকে পড়তে হয় এবং এর ফলেই এদো সংস্কৃতির কয়েক শতক ধরে চলা সেই ঐতিহ্য শেষ হয়ে যায়।

তাই এমনও বলা হয়, আধুনিক শহর হিসেবে টোকিওর যাত্রা শুরু হয়েছিল ভূমিকম্প–পরবর্তী সময়ের পুনর্নির্মাণপ্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।