পানির তলদেশে যে মাছ হেঁটে বেড়ায়
মাছ চোখ খুলেই ঘুমায়, তারা পাখনা ও লেজের সাহায্যে সাঁতার কেটে বেড়ায়—এগুলো জানা কথা। তাই বলে মাছ হেঁটে বেড়ায়, এমনটা কী সম্ভব! সত্যি! এমন বিরল দৃশ্য ধরা পড়েছে ফ্রান্সের আলোকচিত্রী নিকোলাস রেমির ক্যামেরায়।
অস্ট্রেলিয়ার তাসমানিয়ার ডারওয়েন্ট নদীর অন্ধকার ও কাদামাটির তলদেশে তিন দিনে মোট ৯ ঘণ্টা অবস্থান করে বিরল এই মাছের ছবি ধারণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন নিকোলাস।
প্রথমে দেখলে মনে হবে, মাছটি হাতে ভর দিয়ে হাঁটছে। অন্য মাছেরা পাখনা ও লেজ দিয়ে পানিতে সাঁতার কেটে বেড়ালেও এই প্রজাতির মাছের বুকের পাখনা (পেকটোরাল ফিনস) ও পেটের পাখনার গঠন আলাদা। হাতের মতো পাখনায় ভর করে অনেকটা হামাগুড়ির মতো এসব মাছ হেঁটে বেড়ায়। তাই এই মাছগুলোকে ‘হ্যান্ডফিশ’ বলা হয়। এই মাছ থাকে নদী বা জলাশয়ের তলদেশে কাদামাটির কাছাকাছি ঘোলা পানিতে, যাতে সহজে চোখে না পড়ে।
এই মাছের আরেকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এটির ঠোঁটের ওপরের দিকে সরু একটি দণ্ডের মতো আছে। দণ্ডের মাথায় আছে ফুলের কলির মতো দেখতে তুলতুলে এক জিনিস। মাছটি কাদায় লুকিয়ে কলি আকৃতির তুলতুলে সেই জিনিসটিতে নাড়াতে থাকে। মূলত এটিকে শিকার ধরার টোপ হিসেবে ব্যবহার করে এই প্রজাতির মাছ। যখনই কোনো শিকার ওই কলি আকৃতির জিনিসটিকে খাবার ভেবে এগিয়ে আসে, তখনই সেটিকে ছোঁ মেরে ধরে ফেলে হ্যান্ডফিশ।
বিজ্ঞানীরা বলছেন, হ্যান্ডফিশ প্রজাতির এই মাছ এখন বিপন্নপ্রায়। বিশ্বব্যাপী এখন মাত্র তিন হাজারের মতো হ্যান্ডফিশ বেঁচে আছে।
মাছের গায়ে ক্রিম রঙের ওপর গাঢ় বাদামি ও কমলা রঙের ফোঁটা ফোঁটা দাগ। এটি নদীর তলদেশে মাটির সঙ্গে মিশে থাকে, যাতে চোখে না পড়ে। এই অবস্থায় এদের ছবি তোলাকে কঠিন করে তোলে।
ফ্রান্সের আলোকচিত্রী নিকোলাস রেমি নাছোড়বান্দা। তিনি যে করেই হোক, এই মাছের ছবি তুলবেন। ২০২২ সালে তিনি সিডনি থেকে অস্ট্রেলিয়ার শীতলতম রাজ্য তাসমানিয়াতে যান। সেখানে ১১ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ডারওয়েন্টের পানিতে ডুব দিয়েছিলেন। পানির নিচে এক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি হ্যান্ডফিশ দেখতে পান। কিন্তু ক্যামেরা ফ্লাশ করতে না করতেই এই মাছ হারিয়ে যায়। এর মধ্যেও যে কটি ছবি তুলেতে পেরেছিলেন, সেগুলোর সবই ছিল ঘোলা। নিকোলাস বুঝতে পারেন, এই প্রজাতির মাছের ছবি তুলতে গেলে তাঁকে আরও উন্নত কৌশল ব্যবহার করতে হবে। এরপর ভাবনাচিন্তা করে পরপর তিন দিনে মোট ৯ ঘণ্টা তিনি নদীতে কাটিয়ে হ্যান্ডফিশের ছবি তুলতে সক্ষম হন।
নিকোলাস তাঁর ফ্লিপার দিয়ে সাঁতারের এক বিশেষ কৌশল রপ্ত করেন। ফলে নদীর তলার কাদায় আর নিকোলাসের পা লাগেনি। পাশাপাশি তিনি ভিন্ন ধরনের লাইটিং ডিভাইস ব্যবহার করেছেন। এরপরই তিনি তাঁর কাঙ্ক্ষিত সেই ছবি তুলতে সক্ষম হন। এসব ছবির জন্য তিনি আন্ডারওয়াটার ফটোগ্রাফি গাইডস ওশান আর্ট ২০২২ প্রতিযোগিতায় ঠান্ডা পানির ছবি বিভাগে প্রথম পুরস্কার পান।
নিকোলাস আশা করেন, এসব ছবি বিরল প্রজাতির এই মাছগুলোকে আলোচনায় নিয়ে আসবে। ছবি এই মাছ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তুলবে। বিপন্ন প্রজাতির এই মাছ রক্ষায় তারা এগিয়ে আসবে।