ভারতের সেলুন-রেস্তোরাঁয় কাজ করছেন আফগানিস্তানের সাবেক সেনা কর্মকর্তারা

নয়াদিল্লির একটি ছোট্ট ঘরে সাবেক আফগান সেনা কর্মকর্তা জাকি মারজাইছবি: আল–জাজিরার সৌজন্যে

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লির নিউ ফ্রেন্ডস কলোনিতে তখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। চারপাশে হইচই। দিল্লি শহরতলির কোলাহলপূর্ণ এলাকাটির একটি সেলুনে এক খদ্দেরের চুল কাটায় ব্যস্ত ২৯ বছর বয়সী তরুণ জাকি মারজাই।

অন্য দেশের সেলুনে এভাবে চুল কাটার কথা ছিল না মারজাইয়ের। কাঁচি আর রেজরের বদলে দেশের স্বার্থে তাঁর হাতে থাকার কথা ছিল অস্ত্র। কিন্তু নিয়তি তাঁকে সুদূর আফগানিস্তান থেকে টেনে এনেছে ভারতে। করতে হচ্ছে ‘নাপিতের’ কাজ।

২০১৫ সালে সার্জেন্ট হিসেবে আফগান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন মারজাই। তিন বছর আগেও সেনাবাহিনীর এলিট ফোর্সে ছিলেন। যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সমর্থিত আফগান সরকারের হয়ে তালেবানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লড়ছিলেন। কিছুদিন পর হতেন সেনাবাহিনীর একজন কমিশনড অফিসার।

২০১৮ সালের ২০ জুন হঠাৎ তাঁর জীবনের সবকিছু এলেমেলো হয়ে যায়। এদিন রাত ২টার ঘটনা। গজনি প্রদেশে একটি সেনাশিবিরে ছিলেন মারজাই। আচমকা সেখানে হামলা হয়। গুলিবিদ্ধ হন মারজাই ও অন্য সেনাসদস্যরা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ২৫ সেনাসদস্য নিহত ও আরও ৬ জন আহত হন। সৌভাগ্যক্রমে সেদিন বাঁচলেও মারজাইয়ের চিবুক ও ডান পায়ে গুলি লাগে।

ভয়ংকর সেই দিনের স্মৃতিচারণা করে মারজাই বলেন, ‘হামলা এত ব্যাপক ছিল যে আমরা কিছুই করতে পারিনি। আমরা ছিলাম নিরুপায়।’ তালেবান সেদিন হামলা চালিয়ে গোটা সেনাশিবির ধ্বংস করে ফেলে বলে জানান মারজাই।

তালেবানের হামলায় জাকি মারজাইয়ের চিবুক ও ডান পা গুলিবিদ্ধ হয়। এখনো রয়ে গেছে সেই ক্ষতচিহ্ন
ছবি: আল–জাজিরার সৌজন্যে

ওয়াশিংটনভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা ইউনাইটেড স্টেটস ইনস্টিটিউট অব পিসের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, দুই দশক ধরে চলা আফগান যুদ্ধে দেশটির সামরিক বাহিনী ও পুলিশের আনুমানিক ৭০ হাজার সদস্য নিহত হয়েছেন।  

হামলার ৮ ঘণ্টা পর মারজাইসহ হতাহত সেনাদের উদ্ধার করা হয়। মারজাইকে নেওয়া হয় গজনির একটি হাসপাতালে। পরে অবস্থার আরও অবনতি হলে তাঁকে রাজধানী কাবুলের একটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

প্রায় এক বছর আফগানিস্তানেই তাঁর চিকিৎসা চলে। এরপরও সুস্থ না হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য তাঁকে ভারতে পাঠায় তৎকালীন আফগান সরকার। মা–বাবা, এক বোন ও সাত ভাইকে ছেড়ে মারজাই পাড়ি জমান নয়াদিল্লিতে।  

২০১৯ সালে দিল্লির গুরগাঁওয়ের একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে এবং পরে দিল্লির আরও দুটি হাসপাতালে চিকিৎসা নেন মারজাই। অস্ত্রোপচারে মুখমণ্ডল কিছুটা ঠিক হওয়ার পর ২০২১ সালের আগস্টে দেশে ফেরার কথা ছিল তাঁর। কিন্তু আগস্টেই তালেবান আবারও রাষ্ট্রক্ষমতায় ফেরায় মারজাইয়ের স্বপ্নভঙ্গ হয়।

স্বপ্নভঙ্গ

২০২১ সালে তালেবানের একের পর এক প্রদেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার খবর মুঠোফোনে দেখছিলেন মারজাই। ওই বছরের ১৫ আগস্ট কাবুলে ঢোকে তালেবান। এতে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো জোটের সেনারা আফগানিস্তান ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন। সেদিন পরিবারের সদস্য ও সহকর্মী অন্য সেনাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও দেশে নেটওয়ার্ক না থাকায় ব্যর্থ হন মারজাই।

মারজাই ভেবেছিলেন, তালেবানের বিরুদ্ধে একটা শক্ত লড়াই হবে। তাদের কাছে সরকার ও সেনাবাহিনী এভাবে অসহায় আত্মসমর্পণ করবে, তা কল্পনাও করেননি তিনি। এ জন্য তৎকালীন আফগান সরকারকে দোষারোপ করলেন তিনি। বললেন, সব লুটের পর সে সময় রাজনীতিকেরা দেশ ছেড়ে পালান।

মারজাই বলেন, ‘তালেবান আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করার পর সেদিন আমি সারা রাত কেঁদেছিলাম। আমার হৃদয় ভেঙে গিয়েছিল। আমি তখন দেশে পরিবারের কাছে ও সেনাবাহিনীতে ফেরার আশায় ছিলাম। কিন্তু এর বদলে এখনো আমি এখানে (ভারতে) আটকে রইলাম।’  

আফগানিস্তানের শিয়া অধ্যুষিত একটি প্রদেশ গজনি। তালেবানরা সুন্নি হওয়ায় প্রদেশটির বাসিন্দারা দীর্ঘদিন তালেবানের নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন।

ক্ষমতায় আসার পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেছিল তালেবান। কিন্তু এরপরও এই সময়ে অন্তত ২০০ জন সাবেক সেনাসদস্য ও সরকারি কর্মকর্তা হত্যার শিকার হয়েছেন। কারণ, তৎকালীন সরকারকে শত্রু মনে করত তালেবান।

আফগান সেনা কর্মকর্তা খলিল শামাস এখন দিল্লির একটি রেস্তোরাঁয় কাজ করেন
ছবি: আল–জাজিরার সৌজন্যে

আছেন আরও অনেকে

মারজাইয়ের মতো আরও অনেক সাবেক আফগান সেনাসদস্য তালেবানের প্রত্যাবর্তনের কারণে দেশে ফিরতে পারেননি। আফগান সেনাবাহিনীর লেফটেন্যান্ট ছিলেন ২৭ বছর বয়সী তরুণ খলিল শামাস। এখন তিনি নয়াদিল্লিতে রেস্তোরাঁকর্মীর কাজ করেন। ২০২০ সালে তিনি ভারতে আসেন দেরাদুনে ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমিতে প্রশিক্ষণ নেওয়ার জন্য। তাঁদের প্রশিক্ষণ শেষ হয়েছে এমন সময়ে আফগান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করে।

খলিল শামাস জানালেন, ইন্ডিয়ান মিলিটারি একাডেমিতে তাঁর সঙ্গে আরও প্রায় ২০০ আফগান সেনা প্রশিক্ষণ নিতে এসেছিলেন। তাঁদের মধ্যে অল্প কয়েকজন দেশে ফিরতে পেরেছেন। তিনি জানালেন, আফগান সেনাবাহিনীর আরও অনেক সেনা ইরান, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে পাড়ি জমিয়েছেন।

ভারতে যেসব আফগান সেনা রয়ে গেছেন, তাঁদের মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। বিশেষ করে থাকা–খাওয়ার জন্য নয়াদিল্লিতে অবস্থিত আফগান দূতাবাস অর্থ দেওয়া বন্ধের পর থেকে পরিস্থিতি খারাপ হতে থাকে। তালেবান ক্ষমতায় আসার পরই দূতাবাস তাঁদের অর্থসহায়তা বন্ধ করে দেয়।

মারজাই বলেন, ‘২০২১ সালের পর আমরা দূতাবাস থেকে কোনো ধরনের সাহায্য পাইনি। এর পর থেকে থাকা–খাওয়ার খরচ নিজেদেরই জোগাড় করতে হচ্ছে আমাদের। এটা করতে গিয়ে যে যা কাজ পাচ্ছে তা–ই করছে এখানে।’

সেনাবাহিনীর উর্দি পরা এই ছবি খলিল শামাসের কাছে এখন শুধুই স্মৃতি
ছবি: আল–জাজিরার সৌজন্যে

দূতাবাস থেকে আর্থিক সহায়তা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর নিজের জমানো অর্থ দিয়ে চলছিলেন মারজাই। কিন্তু একসময় তা–ও ফুরিয়ে যায়। এরপর চুল কাটানো বিষয়ে ছয় মাসের একটি কোর্স করে এখন সেলুনে কাজ করছেন।

দক্ষিণ দিল্লির ভোগাল নামের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় দুই কক্ষের বাড়িতে কোনোমতে নিজ দেশের আরও তিনজনের সঙ্গে আছেন মারজাই। সেখান থেকে একটু দূরে মালবিয়া নগর নামের একটি এলাকায় আরও সাত আফগান নাগরিকের সঙ্গে একটি ছোট বাসায় থাকছেন খলিল শামাস। আফগান সেনাবাহিনীর এই সাবেক কর্মকর্তার বড় ভাই আলী শামাস আফগানিস্তানের একটি জেলার গভর্নর ছিলেন। তালেবান যোদ্ধারা আলী শামাসকে হত্যা করে।

খলিল শামাস বলেন, ‘সরকারি অর্থসহায়তা ছাড়া বিদেশে জীবন চালানো খুব কঠিন। আমাদের পরিবার বেশ সচ্ছল ছিল। কিন্তু এখন দুর্দশা চলছে। নিজের থাকা–খাওয়ার বাইরে দেশে পরিবারের জন্যও অর্থ পাঠাতে হচ্ছে আমাকে।’