রোবট কুকুর এবং এআই চালিত ড্রোন: যুদ্ধে কীভাবে ডিপসিক ব্যবহারের চেষ্টা করছে চীন
চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন আগ্নেয়াস্ত্র প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান নরিনকো গত ফেব্রুয়ারিতে নতুন একটি সামরিক যান উন্মোচন করেছে। এ যানটি ঘণ্টায় ৫০ কিলোমিটার গতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে যুদ্ধ-সহায়ক কার্যক্রম পরিচালনা করতে সক্ষম। চীনের প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ডিপসিকের পৃষ্ঠপোষকতায় এ সামরিক যান তৈরি করা হয়েছে। কোম্পানিটির তৈরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মডেলকে চীনের প্রযুক্তি খাতের গর্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
দ্য নরিনকো পি সিক্সটি নামের সামরিক যান উন্মোচনকে কেন্দ্র করে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির কর্মকর্তারা একটি সংবাদ বিবৃতি দিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ডিপসিক ও এআই ব্যবহার করে বেইজিং কীভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অস্ত্র প্রতিযোগিতায় নামতে যাচ্ছে, তার আগাম প্রদর্শনী এটি।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতারা যখন সম্ভাব্য সংঘাত মোকাবিলার জন্য তাঁদের সামরিক বাহিনীকে প্রস্তুত হতে বলছেন, তখনই এ সামরিক যানটিকে সামনে আনল বেইজিং।
শত শত গবেষণাপত্র, পেটেন্ট এবং ক্রয়-নথি পর্যালোচনার মধ্য দিয়ে রয়টার্স খতিয়ে দেখেছে, চীন আসলে কীভাবে সামরিক কাজে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ব্যবহারের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।
চীনের পরবর্তী প্রজন্মের অস্ত্রব্যবস্থা কীভাবে কাজ করে এবং এগুলো কতটা ব্যবহার করা হচ্ছে, তা রাষ্ট্রের গোপনীয় বিষয়। তবে ক্রয়-নথি এবং পেটেন্টগুলো পর্যালোচনা করে কিছুটা ধারণা পাওয়া যায়। স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিশানা নির্ধারণ এবং যুদ্ধক্ষেত্রে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার সক্ষমতার ক্ষেত্রে বেইজিং কতটা অগ্রসর হচ্ছে, তা এ ক্ষেত্রে আঁচ করা যায়।
তবে নথিতে উল্লেখ থাকা সব পণ্যই তৈরি হয়েছে কি না, তা রয়টার্স নিশ্চিত হতে পারেনি। উল্লিখিত প্রযুক্তিটি কার্যকর আছে কি না, তা তার পেটেন্ট পর্যালোচনা করে বোঝার উপায় নেই।
২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য দপ্তর চীনে মার্কিন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়ার জনপ্রিয় এ১০০ এবং এইচ১০০ চিপ রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
বিভিন্ন কাগজপত্র, টেন্ডার ও পেটেন্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চীনা সেনাবাহিনী (পিএলএ) এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এখনো এনভিডিয়ার চিপ ব্যবহার করছে এবং এগুলোর সন্ধান করে যাচ্ছে। এমনকি যেসব মডেল যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে, সেগুলোও ব্যবহার করা হচ্ছে।
ওই চিপগুলো ওয়াশিংটনের নিষেধাজ্ঞা জারির আগেই মজুত করা হয়েছিল কি না, তা রয়টার্স নিশ্চিত করতে পারেনি। কারণ, ব্যবহৃত হার্ডওয়্যার কখন রপ্তানি করা হয়েছে, তা নথিগুলোতে উল্লেখ নেই। সর্বশেষ জুনে দাখিল করা পেটেন্টে দেখা গেছে, এসব চিপ এখনো সামরিক বাহিনীর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিষ্ঠানে ব্যবহৃত হচ্ছে।
এনভিডিয়ার মুখপাত্র জন রিজ্জো রয়টার্সকে বলেন, কোম্পানিটি আগে বিক্রি করা পণ্য আলাদা করে পুনর্বিক্রয় হয়েছে কি না, তা শনাক্ত করতে পারে না। তবে তাঁর দাবি, ‘পুরোনো বা ব্যবহৃত পণ্যকে অল্প পরিমাণে পুনর্ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে নতুন কিছু তৈরি করা যাবে না এবং এতে জাতীয় নিরাপত্তার কোনো ঝুঁকিও নেই। সীমিত পণ্য সামরিক কাজে ব্যবহার করা কার্যত অসম্ভব। কারণ, সহায়ক উপকরণ, সফটওয়্যার বা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা না থাকলে নিষিদ্ধ পণ্যগুলো সামরিক কাজে ব্যবহার করে সুফল পাওয়া যায় না।’
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাণিজ্য দপ্তর রয়টার্সের এই অনুসন্ধান নিয়ে কোনো মন্তব্য করেনি।
ওয়াশিংটনভিত্তিক প্রতিরক্ষা নীতিবিষয়ক থিঙ্কট্যাংক জেমসটাউন ফাউন্ডেশনের গবেষক সানি চুয়াং বলেন, ২০২৫ সালে চীনা সেনাবাহিনী এমন সব প্রতিষ্ঠানকে চুক্তিভিত্তিক কাজ দেওয়া বৃদ্ধি করেছে, যারা কেবল দেশীয় হার্ডওয়্যার ব্যবহার করছে বলে দাবি করে থাকে। যেমন হুয়াওয়ের এআই চিপ।
চলতি বছরের ছয় মাসে পিএলএর প্রকিউরমেন্ট নেটওয়ার্ক থেকে ইস্যু করা কয়েক শ দরপত্র বিশ্লেষণ করে চুয়াং এই তথ্য পেয়েছেন। রয়টার্স স্বাধীনভাবে এই দাবির সত্যতা যাচাই করতে পারেনি। তবে দেশীয় কোম্পানিগুলোর ওপর ‘চীনের নির্মিত প্রযুক্তির ব্যবহার’ বৃদ্ধি করতে বেইজিং প্রকাশ্য চাপ দিচ্ছে বলে যে কথাটি শোনা যাচ্ছে, তার সঙ্গে এ দাবি সামঞ্জস্যপূর্ণ।
বিভিন্ন কাগজপত্র, টেন্ডার ও পেটেন্ট পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, চীনা সেনাবাহিনী (পিএলএ) এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এখনো এনভিডিয়া চিপ ব্যবহার করছে এবং এগুলোর সন্ধান করে যাচ্ছে। এমনকি যে মডেলগুলো যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার আওতায় রয়েছে, সেগুলোও ব্যবহার করা হচ্ছে।
চীন সরকারের ক্রয় বিজ্ঞপ্তি এবং দেশটির পেটেন্ট অফিসে দাখিল করা পেটেন্টগুলো পর্যালোচনা করে রয়টার্স দেখতে পেয়েছে, পিএলএর সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো হুয়াওয়ের চিপ ব্যবহার করছে এবং এর চাহিদা রয়েছে। তবে তারা জেমসটাউনের সব দরপত্র যাচাই করতে পারেনি। জেমসটাউন চলতি সপ্তাহে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করতে যাচ্ছে। তারা আগেই রয়টার্সকে প্রতিবেদনটি পাঠিয়ে দিয়েছে।
হুয়াওয়ে সামরিক খাতে তাদের চিপের ব্যবহারের বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হয়নি। সামরিক কাজে এআইয়ের ব্যবহারের বিষয়ে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, ডিপসিক এবং নরিনকো কর্তৃপক্ষের বক্তব্য জানার চেষ্টা করেছিল রয়টার্স। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি।
রয়টার্স যে পেটেন্ট ও গবেষণাপত্রগুলো পর্যালোচনা করেছে, সেগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রতিরক্ষা কোম্পানিগুলোও একই ধরনের প্রশ্ন করে উত্তর পাওয়া যায়নি।
ডিপসিকের ওপর নির্ভরতা
চলতি বছর পিএলএর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু দরপত্র বিশ্লেষণ করে রয়টার্স দেখতে পেয়েছে, সেখানে ডিপসিক মডেল ব্যবহারের ইঙ্গিত আছে। মাত্র একটি দরপত্রে আরেক চীনা প্রতিষ্ঠান আলিবাবার কোয়েনমডেল ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
সামরিক খাতে কোয়েনের ব্যবহার নিয়ে আলিবাবার মন্তব্য জানার চেষ্টা করেছিল রয়টার্স। তবে সাড়া পাওয়া যায়নি।
জেমসটাউনের মতে, ২০২৫ সালে ডিপসিক সংক্রান্ত ক্রয় বিজ্ঞপ্তি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। পিএলএ নেটওয়ার্কে নিয়মিত নতুন নতুন সামরিক অ্যাপ্লিকেশন দেখা যাচ্ছে।
চীনা সেনাবাহিনীর এআই ব্যবহারের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা দপ্তরের মন্তব্য জানার চেষ্টা করেছিল রয়টার্স। তবে তারা মন্তব্য করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের এক মুখপাত্র রয়টার্সকে বলেন, ‘ডিপসিক কর্তৃপক্ষ স্বেচ্ছায় চীনের সামরিক ও গোয়েন্দা কার্যক্রমে সহযোগিতা করছে এবং সম্ভবত ভবিষ্যতেও তা করে যাবে।’
মুখপাত্র আরও বলেন, ‘ওয়াশিংটন বিশ্বজুড়ে নির্ভরযোগ্য দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে মার্কিন এআই প্রযুক্তির জন্য একটি সাহসী এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক কৌশল গ্রহণ করবে। একই সঙ্গে আমাদের প্রতিপক্ষের হাতে এই প্রযুক্তি পৌঁছাতে দেওয়া হবে না।’
চলতি বছর পিএলএর বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের বেশ কিছু দরপত্র বিশ্লেষণ করে রয়টার্স দেখতে পেয়েছে যে সেখানে ডিপসিক মডেল ব্যবহারের ইঙ্গিত আছে। মাত্র একটি দরপত্রে আরেক চীনা প্রতিষ্ঠান আলিবাবার কোয়েনমডেল ব্যবহারের কথা উল্লেখ করা হয়েছে।
এআই চালিত পরিকল্পনা ও ব্যবহার
নথি অনুযায়ী, চীন এআই চালিত রোবট কুকুর ব্যবহারের কথা ভাবছে। এটি দিয়ে একই সঙ্গে নজরদারি চালানো যাবে এবং স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিশানা নির্ধারণ করা যাবে।
২০২৪ সালের নভেম্বরে পিএলএ একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল। সেখানে এআই চালিত রোবট কুকুর ব্যবহার করে একই সঙ্গে হুমকি শনাক্ত করা ও বিস্ফোরকজনিত ঝুঁকি দূর করতে পারবে—এমন কাজের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। ওই দরপত্রের শর্তগুলো পূরণ হয়েছে কি না, তা রয়টার্স নিশ্চিত করতে পারেনি।
এর আগে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ছবিতে দেখা গেছে, এআই রোবোটিকস প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ইউনিট্রি সামরিক মহড়ায় তাদের সশস্ত্র রোবট কুকুর ব্যবহার করেছে।
পিএলএর কাজে ব্যবহারের জন্য রোবট তৈরির বিষয়ে ইউনিট্রিকে প্রশ্ন করে উত্তর পাওয়া যায়নি।
গত দুই বছরে প্রকাশিত পেটেন্ট, দরপত্র এবং গবেষণাপত্র বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সামরিক পরিকল্পনা উন্নত করতে পিএলএ এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলো এআই ব্যবহার করতে চাইছে। এর মধ্যে আছে স্যাটেলাইট ও ড্রোন দিয়ে তোলা ছবি দ্রুত বিশ্লেষণ করার প্রযুক্তি তৈরি।
স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র
নথি অনুযায়ী, চীনা সামরিক সংস্থাগুলো ক্রমাগত যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ করছে।
রয়টার্স যে দরপত্র এবং পেটেন্টগুলো দেখেছে, তার মধ্যে দুই ডজন দরপত্রে দেখা গেছে, লক্ষ্য শনাক্ত করতে সামরিক বাহিনী ড্রোনে এআই সংযুক্ত করার চেষ্টা করছে। তারা এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করার চেষ্টা করছে, যেন অস্ত্রগুলো ব্যবহারে মানুষের হস্তক্ষেপ কম করতে হয়।