আট দশক পর দেশের মাটিতে ফিরে যাওয়া

চট্টগ্রামে গাছপালা ঘেরা শান্ত পরিবেশে অজানা সৈনিকদের সমাধিছবি: সংগৃহীত

জাপানের টোকিওর নগরকেন্দ্রের ব্যস্ত এক জায়গাজুড়ে আছে বিতর্কিত একটি শিন্তো মন্দির। জাপানে যেটা ইয়াসুকুনি মন্দির নামে পরিচিত। ১৮৬৯ সালে যাত্রা শুরু করা শিন্তো ধর্মের এই মন্দির তৈরি করা হয়েছিল মূলত এক বছর আগে গৃহযুদ্ধের মধ্য দিয়ে সামন্ত্রতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে আধুনিক জাপানের ভিত্তি তৈরি করে নেওয়া মেইজি পুনরুত্থানের সময় গৃহযুদ্ধে নিহত বিজয়ী পক্ষের সৈন্যদের ‘দেবতুল্য’ ভাবমূর্তি তুলে ধরার উদ্দেশ্যে। ফলে বিজয়ী পক্ষের নিহত সব সৈনিকের নাম সেখানে দেবতার সারিতে সন্নিবেশিত আছে, পরাজিতদের নয়।

দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জীবন বিসর্জন দেওয়ার বিনিময়ে পাওয়া এ রকম প্রতিদানের মধ্যে বিতর্কের কিছু থাকার কথা নয়। দীর্ঘকাল ধরে এটা নিয়ে কোনো রকম বিতর্কও ছিল না। তবে সেই হিসাব পাল্টে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুদ্ধাপরাধী হিসেবে সর্বোচ্চ সাজা পাওয়া জাপানের সেই সময়ের কয়েকজন নেতাকে ১৯৭০–এর দশকের শেষ দিকে ইয়াসুকুনির দেবতার তালিকায় যুক্ত করার প্রচেষ্টা চালানোর মধ্য দিয়ে।

ফলে যুদ্ধের পুরো সময় ধরে জাপানের যে কয়েক লাখ তরুণ দেশপ্রেমে নিবেদিত থেকে নিজেদের প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, ইয়াসুকুনির সেই ঘটনার আলোকে তাঁদেরও এখন ধরে নেওয়া হচ্ছে ‘বিতর্কিত’ হিসেবে। জাপানের জন্য দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পরাজয়ের বাইরে অন্য একটি মর্মান্তিক দিক হচ্ছে এটা।

যেকোনো যুদ্ধের বলি সর্বাগ্রে হতে হয় যুদ্ধে জড়িত কোনো একটি দেশের তরুণদের। নিজেরা না চাইলেও দেশপ্রেমের দোহাই দিয়ে যুদ্ধে যোগ দিতে যাঁদের সাধারণত বাধ্য করা হয়। এর পরোক্ষ ফলশ্রুতিতে নেতৃত্বের স্খলনের জন্য নেতারাই কেবল নয়, সেসব তরুণকেও চিহ্নিত করা হয় ‘খলনায়ক’ হিসেবে।

এমনটাই সম্ভবত ঘটেছে আট দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের মাটিতে চিরনিদ্রায় শায়িত জাপানের কয়েকজন তরুণ সৈনিকের জীবনে। তাঁদের অনেকেরই সম্ভবত জানা ছিল না কেন তাঁরা যুদ্ধে জড়িত। আর যাঁরা তাঁদের যুদ্ধের ময়দানে পাঠিয়েছিলেন, তাঁরা ধরে নিয়েছিলেন যে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা সেই তরুণদের ভাগ্যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটে, তা নিয়ে খুব বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করার দরকার সম্ভবত নেই।

সমাধিতে চিরনিদ্রায় শায়িত জাপানিদের নামফলক
ছবি: সংগৃহীত

কেননা, সাধারণ এই সৈনিকদের সবাই প্রায় ছিলেন সেই অবহেলিত শ্রেণির প্রতিনিধি, সামাজিক জীবনে যাঁদের প্রভাব ছিল খুবই সীমিত। সম্ভবত এ কারণেই দেশের জন্য লড়াই করতে গিয়ে বিদেশের মাটিতে চিরনিদ্রায় শয্যাশায়ী সেসব তরুণ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর প্রায় ৮৫ বছর ধরে অনেকটা যেন পর্দার আড়ালে থেকে গিয়েছিলেন, যাঁদের খোঁজখবর বলতে গেলে কোনো পক্ষ থেকেই নেওয়া হয়নি।

এর কারণ অবশ্য এমন নয় যে জাপান ইচ্ছা করেই তাঁদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, তা জানতে চায়নি। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরবর্তী সময়ে জাপান হয়ে পড়েছিল পরাধীন এক দেশ। দেশের অর্থনীতি ও সামাজিক কাঠামোর অনেকটাই ভেঙে পড়েছিল। ফলে বিদেশে নিজেদের সৈনিকদের জীবনে কী ঘটেছে, তা খুঁজে বের করার সামর্থ্য কিংবা সংগতি পরাজিত দেশের নেতাদের ছিল না।

১৯৬০–এর দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে জাপান আবারও যুদ্ধের ক্ষত কাটিয়ে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশ হিসেবে বিশ্বরাজনীতিতে নিজের জায়গা খুঁজে পেতে শুরু করলে যুদ্ধ চলাকালে হারিয়ে যাওয়া নাগরিকদের সন্ধান পুনরায় শুরু করেছিল। সেই সূত্র ধরে দীর্ঘ বিরতির পর বাংলাদেশেও নিখোঁজ জাপানিদের সন্ধান সরকার শুরু করে এবং সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে যুদ্ধে নিহতদের দেহাবশেষ খুঁজে বের করা ও দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া জাপানের উদ্যোগে শুরু হয়।

দীর্ঘ আট দশকের বেশি সময় ধরে কোনো ধরনের খোঁজখবর না নেওয়ার পর জাপান সরকার অবশেষে জাপানি সেনাদের দেহাবশেষ দেশে ফিরিয়ে নিয়েছে। আর এই কাজে সরকারের বাইরে সহযোগিতার হাত যাঁরা সম্প্রসারিত করেছেন, সেই তালিকায় সর্বাগ্রে রয়েছেন বাংলাদেশের একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। বিজয়ের মাসের ঠিক আগে তাঁর এই অবদান নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয় এক কাজ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত পরিচয়হীন সৈনিকদের যে দুটি সমাধি বাংলাদেশে রয়েছে, সেখানে শায়িত অধিকাংশই হলেন জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সেই সময়ের ব্রিটিশ উপনিবেশের বিভিন্ন দেশের লোকজন। কেবল নামের বাইরে যাঁদের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। ব্রিটিশ উপনিবেশের বাইরের দেশ জাপানের কয়েকজন সৈনিক কীভাবে সেখানে জায়গা পেয়েছিলেন, তার পেছনেও আছে মর্মান্তিক অন্য এক কাহিনি।

মাটি খুঁড়ে দেহাবশেষের সন্ধান করছেন জাপানি বিশেষজ্ঞ
ছবি: সংগৃহীত

আমরা জানি, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলা অবস্থায় চট্টগ্রামের দিকে দু–একটি বিমান হামলা চালানোর বাইরে জাপানের রাজকীয় সেনাবাহিনী বর্তমান বাংলাদেশের মাটিতে প্রবেশ করতে পারেনি। বাংলাদেশের ভূখণ্ডের সবচেয়ে কাছাকাছি যে জায়গা পর্যন্ত তারা অগ্রসর হতে পেরেছিল, সেটা হচ্ছে ভারতের মণিপুর রাজ্যের কোহিমা।

কোহিমার যুদ্ধে ভারতীয় ব্রিটিশ বাহিনীর হাতে পরাজিত হয়ে জাপানকে শেষবারের মতো পিছু হটতে হয়। সেই যুদ্ধে জাপানি পক্ষের নিহত সৈনিকদের প্রায় সবাইকেই সমাহিত করা হয়েছে কোহিমাতে।

জাপানের রাজনীতিবিদদের মধ্যে যুদ্ধের তথাকথিত গৌরবগাথা যাঁরা জনগণের সামনে তুলে ধরতে প্রয়াসী, তাঁদের অনেকেই কোহিমার সেই সমাধি সফর করেছেন। তাহলে যে প্রশ্ন এখানে থেকে যায় তা হলো, ময়নামতি আর চট্টগ্রামে যুদ্ধে নিহত সৈনিকদের সমাধিতে জাপানের নিহত তরুণ সৈনিকদের জায়গা কীভাবে করে দেওয়া হয়েছিল?

এর পেছনের বেদনাদায়ক দিকটি হচ্ছে ওই সৈনিকেরা ছিলেন যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত সৈনিক। যুদ্ধ ফ্রন্টের হাসপাতালে চিকিৎসার পর্যাপ্ত সুব্যবস্থা না থাকায় যাঁদের নিয়ে আসা হয়েছিল সেই সময় ব্রিটিশ বাহিনীর পরিচালিত কুমিল্লার ময়নামতি ও চট্টগ্রাম সেনানিবাসের হাসপাতালে।

সেনাদের আঘাত এতটাই মারাত্মক ছিল যে সবাই চিকিৎসাধীন অবস্থায় অল্প দিনের মধ্যেই প্রাণ হারান। যুদ্ধের মোড় তত দিনে পুরোপুরি ঘুরে যাওয়ায় মৃতদেহ প্রতিপক্ষের কাছে হস্তান্তর করার মতো অবস্থা তখন আর ছিল না। শেষ পর্যন্ত ময়নামতি আর চট্টগ্রামের অজানা সৈনিকদের দুই সমাধিস্থলে এঁদের জন্যও জায়গা করে দেওয়া হয়।

তাঁদের মধ্যে ময়নামতিতে সমাহিত করা হয়েছে ২৩ জনকে এবং চট্টগ্রামে জায়গা হয়েছে অবশিষ্ট ১৮ জনের। সমাধিফলকে নামের তালিকার পাশাপাশি তাঁদের প্রায় সবার মৃত্যুর সাল উল্লেখ আছে ১৯৪৫, অর্থাৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের একেবারে শেষ দিকে।

প্রায় এক শতাব্দীর কাছাকাছি সময় বাংলাদেশের দুটি স্থানে জাপানি সেনারা সমাহিত। তাঁদের পরিবারের অনেকেই মৃত্যুবরণ করায় তাঁরাও হয়ে পড়েছেন অনেকটা নাম-পরিচয়হীন। তাঁদের প্রায় সবাই বয়সে তরুণ হওয়ায় ধরে নেওয়া যায় পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে ইয়াসুকুনির স্বপ্ন দেখিয়ে তাঁদের নিয়ে আসা হয়েছিল যুদ্ধের হাতিয়ার হিসেবে লড়াই করে স্বর্গলাভের প্রত্যাশায়।

ফলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের পরাজয় ইয়াসুকুনি মন্দিরকে বিতর্কিত করে তোলায় জাপানের যুদ্ধ-পরবর্তী নেতৃত্বও তাঁদের দেহাবশেষ ফিরিয়ে নিতে খুব বেশি উদ্যোগী হয়নি। সময়ের বিবর্তনে যা অবশ্য ধীরে ধীরে কেটে যায়।

জাপান থেকে আগত দলকে খননকাজে সাহায্য করছেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সাজ্জাদ আলি জহির
ছবি: সংগৃহীত

শুরুতে জাপান সরকারের নজর পূর্ব ও দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে কেন্দ্রীভূত ছিল। কয়েক বছর আগে বাংলাদেশের দুটি সমাধিস্থল থেকে নিহত সৈনিকদের দেহাবশেষ ফিরিয়ে নিতে উদ্যোগী হয় এবং বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

দুটি সমাধিস্থল কমনওয়েলথের পরিচালনাধীন থাকায় অনুমোদনের জন্য কমনওয়েলথ সচিবালয়ের সঙ্গেও জাপান সরকারকে যোগাযোগ করতে হয়েছিল। সবকিছু ঠিক হয়ে যাওয়ার পর ২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে জাপান থেকে একটি বিশেষজ্ঞ দল শুরুতে ময়নামতির সমাধি থেকে দেহাবশেষ তুলে নেওয়ার কাজ শুরু করে।

সেই কাজে জাপানি বিশেষজ্ঞ দলকে সাহায্য করতে এগিয়ে এসেছিলেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর দুই সেনানিবাসের কর্মকর্তারা। আর সরকারের সেই উদ্যোগে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন আমাদের সেই বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়ে যাওয়ার পর যুদ্ধে নিহত মুক্তিযোদ্ধাদের সমাহিত করার স্থান চিহ্নিত করে অবহেলিত বিভিন্ন সমাধি থেকে দেহাবশেষ উদ্ধার করে সঠিক জায়গায় তা সমাহিত করার মহান দায়িত্ব পালন করা সেই মুক্তিযোদ্ধা হচ্ছেন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট কর্নেল সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীক। জাপানি বিশেষজ্ঞ দলের সঙ্গে সার্বক্ষণিকভাবে থেকে জাপানি সৈন্যদের দেহাবশেষ উত্তোলন করে জাপানের কাছে সেগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন তিনি।

দুই দেশের যৌথ উদ্যোগে চালানো কর্মকাণ্ড শেষে গত বছর ময়নামতি থেকে উদ্ধার করা ২৩ জন জাপানি সৈনিকের দেহাবশেষ দেশে ফেরত পাঠানো হয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে চট্টগ্রামের সমাধি থেকে আরও ১৮ জনের দেহাবশেষ গত মাসের ২৮ তারিখে জাপানের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

সমাধিতে বসানো নামফলক থেকে নামের বাইরে খুব বেশি কিছু জানা যায় না। ফলে আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব নয় একজন সার্জেন্ট শিনাকা কিংবা পদাতিক সৈনিক তানাকা মিতসুও কোন স্বপ্ন বুকে ধারণ করে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। কিংবা যুদ্ধ শেষে ঘরে না ফেরায় তাঁদের জন্য কেউ বিলাপ করেছিলেন কি না।

তাঁদের জীবনের সেই ফেলে আসা অধ্যায়ের সবটাই এখন যেন ইতিহাসের ঝাপসা হয়ে আসা একটি দিক। যেখানে নেই ইয়াসুকুনিতে জায়গা পেয়ে যাওয়ার স্বপ্নও। ফলে ইয়াসুকুনি বিতর্কের সঙ্গে তাঁদের যুক্ত করা অনেকটাই যেন অর্থহীন।